সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০২:৪৬ পূর্বাহ্ন
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ::
সিটিজেন নিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে। যারা আগ্রহী আমাদের ই-মেইলে সিভি পাঠান
সংবাদ শিরোনাম ::

কেন ভয়ংকর রূপ নিলো ডেঙ্গু?

  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ১ আগস্ট, ২০২৩
  • ৫৭ বার পঠিত

ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে বছরের শুরুতেই ছিল বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা। তারপরও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ছিল গাছাড়া ভাব। বর্তমানে ডেঙ্গু ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। এতে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে শুধু জুলাই মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে মারা গেছেন ২০৪ জন। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছে: হঠাৎ কেন ডেঙ্গু এত ভয়ংকর রূপ নিয়েছে?

বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ এবং এই রোগের ভাইরাস আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠার পরও সেদিকে নজর না দেয়ায় চলতি বছর ডেঙ্গু মারাত্মক হয়ে উঠেছে বলে জনস্বাস্থ্যবিদরা মনে করছেন।

তারা বলছেন, এক সময় বাংলাদেশে ডেঙ্গু মৌসুমি রোগ বলে মনে করা হলেও কয়েক বছর ধরে বছরজুড়েই এর প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। এর ফলে এই রোগের চার ধরনের ভাইরাস আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং এটি দেশের সব জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে।

তবে ডেঙ্গু আক্রান্তের ভয়াবহ বছর ২০১৯ সাল এবং মৃত্যুর দিক থেকে বিভীষিকাময় বছর ২০২২ কে-ও হার মানিয়েছে চলতি বছর। বিশেষ করে জুলাই মাস। এ সময় মারা গেছেন ২০৪ জন ডেঙ্গু রোগী, যা কিনা জুন মাসের তুলনায় সাত গুণ বেশি।

ডেঙ্গু নিয়ে এখন দেশজুড়ে হাহাকার ধ্বনি। রোগী নিয়ে স্বজনের ছোটাছুটি, ভর্তির তোড়জোড়। আর তীব্র শয্যা সংকটে চিকিৎসা নেয়াই অনেকটা দুরূহ হয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়ে মেঝেতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন রোগীরা। দেশের অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালের চিত্রই এমন ভয়াবহ। বাদ যায়নি বেসরকারি হাসপাতালও। সংকট সেখানেও।

দেশে ক্রমবর্ধমান হারে ডেঙ্গু রোগী বাড়তে থাকায় বর্তমান পরিস্থিতি একপ্রকার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এখন পর্যন্ত সরকারি হিসাবমতে, চলতি বছর সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে। মারা গেছে আড়াই শতাধিক মানুষ। বাধ্য হয়ে ভ্যাকসিন দেয়ার কথা ভাবছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর জানান, শিগগিরই ভ্যাকসিন ট্রায়ালের কথা ভাবা হচ্ছে। এ বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনাও হয়েছে।

ডেঙ্গু ভ্যাকসিন কী?

ডেঙ্গু ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ শুরু হয় ১৯২০ সালের দিকে। ১০৪ বছরে এখন পর্যন্ত বাজারে অনুমোদিত ভ্যাকসিনের সংখ্যা মাত্র দুটি। বর্তমানে বাজারে প্রচলিত ভ্যাকসিনের মধ্যে রয়েছে ডেনভ্যাক্সিয়া ও কিউডেঙ্গা। যারা আগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে তাদের মূলত ডেনভ্যাক্সিয়া দেয়া হয়, আর যারা এখনও ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়নি তাদের দেয়া হয় কিউডেঙ্গা।

বাজারে ডেনভ্যাক্সিয়া এসেছে মূলত সানোফি কোম্পানির হাত ধরে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসিপি) দেয়া তথ্যানুযায়ী, যারা আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়নি তাদের ডেনভ্যাক্সিয়া দিলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।

যারা আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে বা যেসব এলাকায় ডেঙ্গু মহামারি আকার ধারণ করেছে, সেখানে এ ভ্যাকসিন প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। প্রতি ছয় মাস অন্তর তিন ডোজে একজন মানুষকে শূন্য দশমিক ৫ মিলিলিটার পরিমাণ ডেনভ্যাক্সিয়া প্রয়োগ করতে হয়।

ডেনভ্যাক্সিয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সামাল দিতে বাজারে এসেছে নতুন ভ্যাকসিন কিউডেঙ্গা। গত চার বছরে কিউডেঙ্গা ১৯টি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মধ্য দিয়ে বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। যদিও বলা হয়, কিউডেঙ্গা তাদেরই দেয়া উচিত, যারা আগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়নি। তবে বর্তমানে যে কেউ কিউডেঙ্গা নিতে পারে বলে অভিমত দিয়েছেন চিকিৎসকরা।

ইউরোপিয়ান মেডিসিন এজেন্সির তথ্যানুযায়ী, দুই ডোজে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে হয়। ডেঙ্গুর বিপক্ষে কিউডেঙ্গার কার্যকারিতা ৮০ শতাংশের ওপরে। অন্যদিকে এ ভ্যাকসিন প্রয়োগ করলে হাসপাতালে ভর্তির হার ৯০ শতাংশের নিচে নেমে আসে। যেখানে সেরোটাইপ-১ এবং ২-এর ক্ষেত্রে ডেনভ্যাক্সিয়ার কার্যকারিতা কম, সেখানে ৭০ থেকে ৯৫ শতাংশ কার্যকারিতা নিয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে কিউডেঙ্গা।

ডেঙ্গু পরিস্থিতি কেন এত ভয়াবহ হয়ে উঠেছে?

কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটলেও সেদিকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ফলে চলতি বছর মৌসুমের আগে আগে সেটা প্রকট হয়ে উঠেছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গু রোগীদের অবস্থা খুব তাড়াতাড়ি অবনতি হচ্ছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘বর্তমানে ডেঙ্গুর যে পরিস্থিতি তাতে আমরা শিগগিরই এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব বা ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কমানো যাবে, বিষয়টা তেমন নয়। বর্তমান পরিস্থিতি ২০১৯ সালের চেয়েও ভয়াবহ দিকেই যাচ্ছে।’

বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় ডেঙ্গু রোগীর ব্যবস্থাপনায় বেশি জোর দেয়ার পরামর্শ দিয়ে এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আমাদের ঢাকার হাসপাতালগুলোতে ডাক্তারের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এ ছাড়া ডেঙ্গু রোগীর ব্যবস্থাপনায় ডাক্তার ও নার্সদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।’

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে সারা বছরই প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম জারি রাখার কথা বলা হচ্ছে।

ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি রোগীর মৃত্যু হয় ২০২২ সালে। সে বছর ৬১ হাজার রোগীর মধ্যে মারা যান ২৮১ জন। তার আগের বছরেও ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক ছিল। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছিল ২০১৯ সালে। আর এ বছর মৌসুমের আগেই ২০২২ সালের পরিসংখ্যানের কাছাকাছি চলে এসেছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘আসলে গত বছরের সঙ্গে এ বছরের মধ্যে ডেঙ্গু রোগী আসার ক্ষেত্রে কোনো বিরতি ছিল না। শীতকালেও আমরা রোগী পেয়েছি। এবার মৌসুম শুরু হওয়ার এক-দেড় মাস আগে থেকেই আমরা অনেক বেশি রোগী পাচ্ছি।’

তিনি বলেন, ‘আক্রান্তদের মধ্যে ডেঙ্গুর চারটি ধরন বা সেরোটাইপ পাওয়া যাচ্ছে। যারা আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের মধ্যে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যাই বেশি। ২০০০ সালের আগে আমরা দেখেছি, মানুষজন ডেঙ্গুর একটা ধরনে আক্রান্ত হতো। ফলে তাদের মধ্যে একটা প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে উঠত। কিন্তু যখন মানুষ চারটি ধরনেই আক্রান্ত হতে শুরু করে, তখন প্রতিরোধক্ষমতা তেমন কাজ করে না। তখন সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি তিন গুণ বেড়ে যায়।’

ডা. বে-নজির বলেন, ‘ডেঙ্গু মোকাবিলায় যে ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, তা অনেকটা গতানুগতিক। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এটা হয়তো সাময়িক একটা রোগ, কিছুদিন পরই চলে যাবে। ফলে কার্যকর বা দীর্ঘমেয়াদি কোনো ব্যবস্থা কোথাও নেয়া হচ্ছে না। ফলে ডেঙ্গু একেবারে জেঁকে বসেছে। যে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের ঝাঁপিয়ে পড়া দরকার, তা হচ্ছে না। এটা যে একটা মহামারি, তেমন করে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।’

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্য বছরের তুলনায় এই বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব অনেক আগেই এসেছে। এটা এখন সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে এটা মহামারির দিকে যাচ্ছে। এখন দেশে একটা জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এটা মোকাবিলায় গতানুগতিক পদক্ষেপ বাদ দিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা নেয়া দরকার। না হলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে না।

ডেঙ্গুর সর্বশেষ পরিস্থিতি

বর্তমানে ঢাকার সব কটি সরকারি হাসপাতালে ধারণক্ষমতার বেশি ডেঙ্গু রোগী রয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও এখন প্রতিদিন যত রোগী ভর্তি হচ্ছে, তাদের বেশির ভাগই ডেঙ্গু আক্রান্ত।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেশের ৬৪টি জেলাতেই ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। দেশে যে সময়কালকে ডেঙ্গুর মৌসুম বলে ধরা হয়, তার আগেই আক্রান্তের সংখ্যা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ২৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী ব্যক্তিরা ডেঙ্গুতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। আক্রান্তদের বেশির ভাগই ঢাকা শহরের বাসিন্দা।

ঢাকার বাইরে বেশির ভাগ মানুষ প্রথমবারের মতো আক্রান্ত হচ্ছে, ফলে খুবই খারাপ ধরনের রোগীর সংখ্যা শহরের তুলনায় বা ঢাকার তুলনায় কম। তবে গত দু-বছরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। এভাবে ছড়াতে থাকলে অদূরভবিষ্যতে গ্রামাঞ্চলেও এর ভয়ংকর রূপ দেখা যাবে।

শুধু ঢাকা মহানগরীতেই সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে এখন ৫৩টি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছে। সবচেয়ে বেশি রোগী রয়েছে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, এসএসএসএমসি ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতাল, বেসরকারি হলি ফ্যামিলি, রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে অনেক রোগী ভর্তি রয়েছেন। বড় হাসপাতালগুলোয় জায়গা না হওয়ায় অনেক রোগী মেঝেতে থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন।

স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে যে তথ্য দেয়া হয়, তাতে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের প্রকৃত তথ্য আসছে না বলে কর্মকর্তারাই স্বীকার করেছেন। কারণ, যারা আক্রান্ত হয়ে ঘরে বসে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাদের তথ্য এখানে যুক্ত হয় না। এমনকি সব বেসরকারি হাসপাতালের তথ্যও এখানে নেই।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved  2019 CitizenNews24
Theme Developed BY ThemesBazar.Com