অনলাইন ডেস্ক : করোনাভাইরাসের এই মহামারির সময়ে বাংলাদেশে আঘাত হেনেছিলো সুপার সাইক্লোন আম্ফান। এই ঘূর্ণিঝড় ও করোনা মোকাবিলার অভিজ্ঞতা নিয়ে ইংলিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে কলাম লিখেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কলামটির শিরোনাম করা হয়েছে ‘Fighting cyclones and coronavirus: how we evacuated millions during a pandemic’ (সাইক্লোন ও করোনার বিরুদ্ধে লড়াই: আমরা যেভাবে মহামারির সময়ে ১০ লক্ষাধিক মানুষকে উদ্ধার করেছি’।
সেখানে তিনি বাংলাদেশ কিভাবে করোনাভাইরাস, আম্ফান ও আর্থিক ক্ষতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে সে বিষয়টি তুলে ধরেন।
প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, ‘ভারত মহাসাগরে মে মাসে যখন সাইক্লোন আম্ফান সৃষ্টি হতে লাগলো, তখন আমাদের হাতে সময় খুবই কম ছিলো। কিন্তু আশ্রয়কেন্দ্রগুলো তো আর সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে তৈরি করা ছিলো না। এ সময় দেশ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হল— কিভাবে ২৪ লক্ষ মানুষকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে নিরাপদ আশ্রয়স্থলে নিয়ে যাওয়া যায় করোনার ঝুঁকি এড়িয়ে। গণউদ্ধার সব সময়ই চ্যালেঞ্জিং। মানুষ তাদের ঘর-বাড়ি অরক্ষিত রেখে আশ্রয়কেন্দ্র যেতে চায় না। এবার চ্যালেঞ্জটা ছিলো আরো জটিল। কারণ, লোকজন করোনাভাইরাসের ভয়ে আশ্রয়কেন্দ্র যেতে ভয় পাচ্ছিলো। উদ্ধারকর্মীদেরও নিশ্চিত করতে হয়েছিলো যে উদ্ধার কার্যক্রম ও নিরাপদ আশ্রয়স্থলে নিয়ে যাওয়াটা করোনা সংক্রমণ মুক্ত। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার লক্ষ্যে বাংলাদেশ রাতারাতি ১০ হাজার ৫০০ নতুন আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করেছে। তার সঙ্গে আগের ৪ হাজার ১৭১টি আশ্রয়কেন্দ্র তো ছিলোই। উপকূলবর্তী এলাকায় ৭০ হাজার স্বেচ্ছাসেবীকে প্রস্তুত রাখা হলো। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মাস্ক, নিরাপদ পানি, সাবান ও স্যানিটাইজার সরবরাহ করা হলো।’
উদ্ধার তৎপরতার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকে। আমাদের রয়েছে ৫৫ হাজার উদ্ধারকর্মীর নেটওয়ার্ক। সে কারণে আম্ফানে খুব বেশি হতাহত হয়নি। যদিও প্রত্যেকটা মৃত্যুই পীড়াদায়ক ও কষ্টের। কিন্তু দেশের আগে-ভাগে সতর্ককরণ পদ্ধতি, পরিকল্পিত উদ্ধারকাজ বছরের পর বছর ধরে হাজার হাজার মানুষের জীবন রক্ষা করছে। সাইক্লোন আক্রান্ত এলাকাগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও তাদের জীবিকার ব্যবস্থা করা ভিন্ন বিষয়। বাংলাদেশ সাইক্লোন পরবর্তী পুনঃনির্মাণ কাজ বছরে বহুবার করে আসছে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড়প্রবণ ও সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ বাংলাদেশ, এই দেশের দুই-তৃতীয়াংশ ভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৫ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। সে কারণে ঘূর্ণিঝড় ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ শেষে মানুষের আশ্রয়স্থল পুনঃনির্মাণ করাটা একটি মহাযজ্ঞ ও চলমান প্রক্রিয়া। জলবায়ু সংকট এই সমস্যাটাকে আরো প্রকট করেছে। সে কারণে ঘূর্ণিঝড়গুলো এখন অনেক বেশি শক্তিশালী হচ্ছে ও মাঝে মাঝেই আঘাত হানছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে নলকূপ ও চাষের জমি বিষাক্ত হয়ে উঠছে। ঘূর্ণিঝড়, করোনাভাইরাস মহামারি সরকারকে এমন একটি অবস্থান দাঁড় করিয়ে দিয়েছে যেখান থেকে স্বাস্থ্য, জলবায়ু ও আর্থিক জরুরি বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে।’
কলামের নিচের দিকে ‘গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপ্টেশন’ এর প্রধান নির্বাহী প্যাট্রিক ভেরকুইজেন আম্ফানের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ রেকর্ড ছাড়িয়েছে। আম্ফানের প্রভাবে ১৩ বিলিয়ন ডলারের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বাংলাদেশের ৪১৫ কিলোমিটার রাস্তা, ২০০ সেতু, ১০ হাজার বাড়ি-ঘর, বিস্তর এলাকাজুড়ে ফসলের ক্ষেত ও মাছের খামারের ক্ষতি হয়েছে। ১৫০ কিলোমিটারের বেশি বাঁধ ঝড়ের কারণে তৈরি জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আম্ফান ছিলো সর্বনাশা। কিন্তু পরিকল্পনার কারণে যখনই এই ধরনের দুযোর্গ আসে তখনই সেটাকে ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারে দেশটি। অবশ্য একটি ঘূর্ণিঝড়ের তাৎক্ষণিক প্রভাব মোকাবিলাই যথেষ্ট নয়, দেশটির প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোর মানুষদের পরবর্তী ঝড় থেকে রক্ষা করতেও ভালোভাবে প্রস্তুত থাকতে হয়।’
এরপর তিনি ‘ক্লাইমেট ফিসক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক’, ‘ক্লাইমেট অ্যাডাপ্টেশন প্লান’ ও ‘ডেল্টা প্লান ২১০০’ নিয়ে আলোচনা করেন।
কলামের সমাপ্তি টানা হয় এভাবে, ‘বাংলাদেশই সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র দেশ যেটাকে এ বছর স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও জলবায়ু পরিবর্তনগত সমস্যার সঙ্গে একযোগে লড়াই করতে হচ্ছে। সুতরাং এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহযোগিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাফল্য থেকে শিখতে পারি এবং একে-অপরকে সহযোগিতা করতে পারি। একসঙ্গে, কাঁধে-কাঁধ রেখে এগোলে আমরা আরো শক্তিশালীভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করতে পারবো।’