নিজস্ব প্রতিবেদক:
ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সাইফারকে নিয়ে সামাজিক গণমাধ্যম ফেসবুকে কুৎসা রটনার অভিযোগ আছে শিকদার লিটনের বিরুদ্ধে। এই অভিযোগে আলফাডাঙ্গা থানায় শুরুতে সাধারণ ডায়েরি করেন সাইফুর রহমান। এটি গত বছরের শেষ দিকের কথা। পরে আদালতের অনুমতি নিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে অভিযোগটি তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা পায় পুলিশ। সেই প্রতিবেদনও আদালতে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিস্ময়কর কারণে এখনো আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে আছেন শিকদার লিটন। এছাড়াও একাধিক সাইবার অপরাধের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। আছে প্রায় অর্ধডজন মামলায় গ্রেপ্তার পরোয়ানা। তাতে গ্রেপ্তার করা যায়নি তাকে। প্রশ্ন উঠেছে, এত অপরাধ করে বার বার পার পেয়ে যাবেন শিকদার লিটন?
স্থানীয় সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিকদার লিটনের বাড়ি আলফাডাঙ্গা উপজেলার টগরবন্দ ইউনিয়নের চর আজমপুর গ্রামে। ওই গ্রামের সিদ্দিক শিকদারের ছেলে শিকদার লিটন। স্থানীয়দের কাছে তিনি প্রতারক ও ছদ্মবেশী অপরাধী বলেই বেশি পরিচিত।
আলফাডাঙ্গা থানায় শিকদার লিটনের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা এস এম আকরাম হোসেনকে নিয়ে ফেসবুকে নানা ধরনের অপপ্রচার ও সম্মানহানিকর তথ্য প্রচারের অভিযোগ আছে শিকদার লিটন ও তার ইন্ধনদাতাদের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ২০১৯ সালের ২ ডিসেম্বর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন আকরাম হোসেন। যার নং- ৯৬। ফেসবুকে অসত্য ও মানহানীকর তথ্য প্রচারের অভিযোগে আলফাডাঙ্গা উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ও উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি এনায়েত হোসেনও শিকদার লিটনের বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন। এই দুটো অভিযোগ তদন্তের জন্য আদালতের অনুমতির অপেক্ষায় আছে পুলিশ।
এছাড়া শিকদার লিটনের বিরুদ্ধে প্রতারণা, চাঁদাবাজি এবং প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগে পাঁচটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা হয়েছে। পাবনা, খুলনা এবং ফরিদপুর জেলায় এসব মামলা হয়েছে। এসব পরোয়ানা আছে আলফাডাঙ্গা থানায়। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, পরোয়ানা আসার পর শিকদার লিটনের খোঁজে একাধিকবার গেলেও তার বাড়িতে পাওয়া যায়নি তাকে। পুলিশের ভয়ে সে দীর্ঘদিন ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আইনের হাত থেকে বাঁচতে তার দিন কাটছে আত্মগোপনে। অজ্ঞাতস্থান থেকে ফেসবুক লাইভ আসছে। তবে তাকে গ্রেপ্তারে পুলিশের সব ধরনের প্রস্তুতি অব্যাহত আছে বলেও জানা গেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, শিকদার লিটন ঘন ঘন নিজের বেশ বদল করেন। ছদ্মবেশ নিয়ে ঘুরে বেড়ান। কখনো আলগা গোঁফ-দাড়ি লাগিয়ে ঘুরে বেড়ান। আবার কখনো মহিলাদের বোখরাও ব্যবহার করেন মাদক ও চোরকারবারসহ আন্ডারগ্রাউন্ড অপরাধে জড়িত এই ব্যক্তি। তবে নিজেকে পরিচিতজনদের কাছে নির্ভার উপস্থাপন করতে অজ্ঞাত স্থান থেকে ফেসবুকে সক্রিয়তা দেখান। এটিও তার পালিয়ে বেড়ানোর একটা বড় কৌশল বলে মনে করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
২০১৯ সালের ১৮ নভেম্বর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে শিকদার লিটন ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে আলফাডাঙ্গা থানায় একটি অভিযোগ করেন সাইফুর রহমান সাইফার। যেটি সাধারণ ডায়েরি হিসেবে নিবন্ধিত হয়। যার নম্বর- ৮৭৫। ওইদিনই আলফাডাঙ্গার উপপরিদর্শক স্বপন কুমার ফরিদপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অভিযোগটি তদন্তের অনুমতি চান। তাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এর অধীনে ২৫/২৯ ধারায় অধর্তব্য অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। যেটি তদন্ত করা প্রয়োজন বলে মত দেয় পুলিশ। এর প্রেক্ষিতে গত বছরের ২৪ নভেম্বর আদালত তদন্তের অনুমতি দেয়। সেই সঙ্গে, ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দিতে বলা হয়। পরে পুলিশি তদন্তে অপরাধের প্রমাণ পাওয়া যায় এবং প্রতিবেদনটি আদালতেও জমা দেওয়া হয়। কিন্তু এখনো ওই মামলায় শিকদার লিটনকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আলফাডাঙ্গা পৌরসভার মেয়র সাইফুর রহমান সাইফার বলেন, শিকদার লিটন একজন বাটপার ও প্রতারক। এটা আলফাডাঙ্গার প্রতিটি মানুষ জানে। এলাকায় বিভিন্ন ধরনের চুরি-বাটপারি করে হাতেনাতে ধরা খেয়ে পালিয়েছিল। গত পাঁচ-সাত বছর এলাকায় ঠিকমতো থাকে না। রাতের অন্ধকারে আসে। আবার চলে যায়। সে দূরে থেকে বিভিন্ন সম্মানিত মানুষের নামে ফেসবুকে কুৎসা ছড়ায়। এসব করে সে মানুষকে হেনস্তা করে। সে নিজে অপামানিত হয়ে এলাকায় ছেড়েছে বলে অন্যদেরও অপমানিত করে মজা পায়। তবে তাকে একবার আইনের আওতায় আনতে পারলে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও অসত্য তথ্য প্রচারের অভিযোগে শুরুতে আলফাডাঙ্গা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছিলাম। পরে সেটি আদালতের নির্দেশে তদন্ত হয়েছে। এখন বিষয়টি সাইবার ক্রাইম বিভাগে তদন্তনাধীন আছে।’
জানতে চাইলে আলফাডাঙ্গা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এস এম আকরাম হোসেন বলেন, ‘আমার রাজনৈতিক ভাবর্মূতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে শিকদার লিটন নানা ধরনের কুৎসা রটাচ্ছে। বিএনপি-জামায়াতের কুচক্রীদের সঙ্গে এক হয়ে সে এসব কাজ করছে। ব্যক্তি হিসেবে সে একজন প্রতারক ও দুষ্ট প্রকৃতির লোক। এক সময় সে এলাকায় নানান অপকর্ম করে বেরিয়েছে। এখন সে এখানে সেখানে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।’
স্থানীয় সূত্র খোঁজ নিয়ে ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফরিদপুর, খুলনা, নড়াইল, বরিশাল ও বেনাপোল অঞ্চলের মাদকবাণিজ্যের বড় চক্রের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ আছে শিকদার লিটন। তবে অধিকাংশ জায়গাতেই তিনি নিজের সঠিক পরিচয় দেন না। একেক জায়গায় একেক নাম ও পরিচয়ে পরিচিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকাভুক্ত এই মাদককারবারি।
তার এক ঘনিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, মাদক বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন শিকদার লিটন। এসব টাকার বড় অংশ যশোরের বেনাপোলে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের চোরাকারবারে বিনিয়োগ করা আছে। ভারত থেকে অবৈধপথে বাংলাদেশ ঢোকা মাদকের চালান খুলনা, বরিশাল ও ফরিদপুরের বিভিন্ন জায়গায় কখনো নিজে, কখনো তার বাহিনী দিয়ে সরবরাহ করে।
বিশেষ করে বেনাপোল, নড়াইল, কালনাঘাট, ভাটিয়াপাড়া, মুকসুদপুর, ভাঙ্গা এবং বরিশাল অঞ্চলে মাদকের বড় বড় চালান ছড়িয়ে দেওয়ার পেছনে আছে শিকদার লিটনের বড় ভূমিকা। নিজেকে স্বচ্ছ ভাবমূর্তি মানুষ হিসেবে সমাজের মানুষের চোখে ধুলো দিলেও ভেতরে ভেতরে সমাজকে ধ্বংস করে দেওয়ার কাজে লিপ্ত আছে শিকদার লিটন। আলফাডাঙ্গা ও কাশিয়ানিতে কান পাতলে তার অপকর্মের এসব ফিরিস্তি শোনা যায়।
জানতে চাইলে আলফাডাঙ্গা থানার অফিসার ইনচার্জ রেজাউল করিম বলেন, ‘শিকদার লিটনের নানা অপকর্মের অভিযোগ শুনেছি। কিন্তু সে খুবই চালাক প্রকৃতির লোক। একেক সময় একেক জায়গায় থাকে। আমরা তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি।’
স্থানীয় পর্যায়ে অনুসন্ধানে জানা যায়, মানুষকে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরে চাকরি দেওয়ার নাম করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে শিকদার লিটন। একবার তার হাতে টাকা গেলে সেই টাকা কেউ ফেরত পেয়েছেন এমন নজির নেই। চাকরি দূরের কথা, টাকা চাইতে গেলে প্রাণনাশের হুমকি-ধমকি দেওয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। এসব অপরাধের দায়ে একাধিক মামলাও আছে তার বিরুদ্ধে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফরিদপুর খুলনা ও পাবনা জেলায় শিকদার লিটনের বিরুদ্ধে প্রায় ডজনখানেক মামলা রয়েছে। চাঁদাবাজি, প্রতারণা ও প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগে এসব মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে খুলনার সোনাডাঙ্গা মডেল থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ২০১৮ সালের ১৯ মার্চ। মামলা নং-২৪। চাঁদাদাবি এবং প্রাণনাশের হুমকির অপরাধে এ মামলা করা হয়েছে। এছাড়া পাবনা জেলার আটঘরিয়ায় একটি সি.আর মামলার আসামিও সে। মামলার নং-৪৯/১৪। এই মামলাটি করা হয়েছে প্রতারণার অভিযোগে। পাবনার আমিনপুর থানাতেও করা প্রাণনাশের একটি মামলার আসামি তিনি। ২০১৪ সালের ১৮ মে মামলাটি করা হয়। দুস্কর্মের অভিযোগে ২০১৬ সালের ৯ মে তা বিরুদ্ধে একটি মামলা হয় আলফাডাঙ্গা থানায়।