হজরত মুহাম্মদ (সা.) যেসব কাজ করতেন-যা আহার বা পানীয় রূপে গ্রহণ করতেন তাই আল্লাহতায়ালা সুন্নাত করে দিয়েছেন। আল্লাহর আদেশমতে, যে রাসূল (সা.)-এর আদর্শকে জীবনে বাস্তবায়িত করতে পারবে সেই হবে দুনিয়া ও আখিরাতে সফলকাম। রাসূল (সা.) বেশ কিছু খাবার খেতে বেশি পছন্দ করতেন এবং আহারের সময় বিশেষ কিছু নিয়ম মেনে চলতেন।
চলুন তবে জেনে নেয়া যাক রাসুল (সা.)-এর পছন্দের খাবারগুলো সম্পর্কে-
(১) খেজুর : নবী করিম (সা.) এর প্রিয় ফল ছিল খেজুর। খেজুর যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টিগুণে অপরিসীম। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.) থেকে বর্ণিত, আমি রাসূল (সা.)-কে বার্লির এক টুকরো রুটির ওপর একটি খেজুর রাখতে দেখেছি। তারপর বলেছেন, ‘এটিই সালন-মসলা।’ (আবু দাউদ: ৩৮৩০)।
অন্য হাদিসে আছে, প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, ‘যে বাড়িতে খেজুর নেই, সে বাড়িতে কোনো খাবার নেই।’ এমনকি প্রিয়নবী (সা.) সন্তান প্রসবের পর প্রসূতি মাকেও খেজুর খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। খেজুরে রয়েছে খনিজ লবণের উপাদান যা শরীর সতেজ রাখে।
(২) আঙ্গুর : নবীজি (সা.) আঙ্গুর খেতে ভালোবাসতেন। আঙ্গুররের পুষ্টিগুণ ও খাদ্যগুণ অপরিসীম। এটির উচ্চ খাদ্য শক্তির কারণে এটি থেকে আমরা খুব দ্রুত শক্তি পাই। আঙ্গুর স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ভালো। তাছাড়াও এটি আমাদের কিডনির জন্য খুবই উপকারী।
(৩) কিসমিস : কিসমিস অত্যন্ত সুস্বাদু একটি খাবার। এটির পুষ্টিগুণও অনেক। রাসূল (সা.) এর পছন্দের খাবারের তালিকার মধ্যে কিসমিস একটি। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, ‘রাসূল (সা.) এর জন্য কিসমিস ভিজিয়ে রাখা হতো এবং তিনি সেগুলো পান করতেন।’ (মুসলিম)।
(৪) ডুমুর বা ফিগস : ডুমুর অত্যন্ত পুষ্টিকর ও ভেষজ গুণসম্পন্ন। এটি মহানবী (সা.) এর খুবই প্রিয় ছিল। যাদের পাইলস ও কোষ্ঠকাঠিন্য আছে, তাদের জন্য ডুমুর একটি অত্যন্ত উপযোগী খাবার। এতে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান রয়েছে।
(৫) বার্লি বা জাউ : বার্লি হলো গমের মতো এক প্রকার শস্য। এটি মহানবী (সা.) এর প্রিয় খাবারগুলোর মধ্যে একটি। এটি অত্যন্ত পুষ্টিকর খাবার। রাসূল (সা.) বার্লি দিয়ে রুটি বানিয়ে খেতেন। এবং তার সঙ্গে সবসময় একটি করে খেজুর খেতেন। তাছাড়াও এটি জ্বরের এবং পেটের পীড়ার জন্য উপকারী।
(৬) মাখন : মাখন প্রচুর পুষ্টিসম্পন্ন। এটি দেহের তাপ ও কর্মশক্তি বাড়ায়। তাছাড়াও এটি দেহের প্রোটিনকে ক্ষয় থেকে রক্ষা করে। হজরত ইবনাই বিসর আল মুসলিমাইন (রা.) থেকে বর্ণিত, তারা উভয়ে বলেন, ‘একবার আমাদের ঘরে রাসূলুল্লাহ (সা.) আগমন করেন। আমরা তার সম্মুখে মাখন ও খেজুর পরিবেশন করি। তিনি মাখন ও খেজুর পছন্দ করতেন।’ (তিরমিজি : ১৮৪৩)।
(৭) মিষ্টি ও মধু : মিষ্টি খুবই মজাদার একটি খাবার। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূল (সা.) মিষ্টান্ন ও মধু পছন্দ করতেন।’ (বুখারি, ৫১১৫; মুসলিম, ২৬৯৫)।
মধুর নানা পুষ্টিগুণ ও ভেষজ গুণ রয়েছে। মধুকে বলা হয় খাবার পানীয় ও ওষুধের সেরা। ডায়রিয়া হলে হালকা গরম পানির সঙ্গে মধু মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যাবে। বুখারি শরিফের আরেকটি হাদিসে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘মধু হলো উত্তম ওষুধ।’ (হাদিস নম্বর : ৫৩৫৯)।
(৮) ঘি মাখা রুটি : ঘি আমাদের শরীরের তাপ ও কর্মশক্তি বাড়ায়। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) একদিন বলেন, ‘যদি আমাদের কাছে বাদামি গমে তৈরি ও ঘিয়ে সিক্ত সাদা রুটি থাকত, তাহলে সেগুলো আহার করতাম।’ আনসারি এক সাহাবি এই কথা শুনে এ ধরনের রুটি নিয়ে আসেন…। (ইবনে মাজাহ : ৩৩৪০)।
(৯) দুধ : হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, ‘মেরাজের রাতে বায়তুল মাকদিসে আমি দুই রাকাত নামাজ পড়ে বের হলে জিবরাইল (আ.) আমার সম্মুখে শরাব ও দুধের আলাদা দু’টি পাত্র রাখেন। আমি দুধের পাত্রটি নির্বাচন করি। জিবরাইল (আ.) বললেন, ‘আপনি প্রকৃত ও স্বভাবজাত জিনিস নির্বাচন করেছেন।’ (বুখারি: ৩১৬৪, তিরমিজি, ২১৩)।
(১০) সারিদ : সারিদ হলো গোশতের ঝোলে ভেজানো টুকরো টুকরো রুটি দিয়ে তৈরি বিশেষ খাদ্য। আর হায়স হলো মাখন, ঘি ও খেজুর দিয়ে যৌথভাবে বানানো খাবার। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসূল (সা.) এর কাছে রুটির সারিদ ও হায়সের সারিদ অত্যন্ত প্রিয় ছিল।’ (আবু দাউদ : ৩৭৮৩)।
(১১) মোরগ : হজরত জাহদাম (রা.) থেকে বর্ণিত, একদিন আবু মুসা একটি মোরগ নিয়ে আসেন। ফলে উপস্থিত একজন গলার স্বর ভিন্ন করে আওয়াজ করল। হজরত আবু মুসা জিজ্ঞেস করলেন, কী হলো তোমার? লোকটি বলল, মোরগকে আমি বিভিন্ন খাবার খেতে দেখে আমার অপছন্দ হওয়ায় শপথ করেছি, কোনো দিন মোরগ খাব না। হজরত আবু মুসা তাকে বললেন, ‘কাছে আসো। খাওয়ায় অংশগ্রহণ করো। কারণ আমি রাসূল (সা.)-কে মোরগ খেতে দেখেছি। আর তুমি তোমার শপথ ভঙ্গের কাফফারা আদায় করে দেবে।’ (বুখারি: ৫১৯৮, ৪৬৬২; মুসলিম: ১৬৪৯)।
(১২) সামুদ্রিক মাছ : মহানবী (সা.) সাগরের মাছ পছন্দ করতেন। তাছাড়াও সাগরের মাছে রয়েছে খনিজ লবণ এবং এটি চোখের জ্যোতি বাড়ায়। এ বিষয়ে আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা.) এর একটি দীর্ঘ হাদিস আছে। হাদিসটি বুখারি (৪৩৬১) ও মুসলিম (১৯৩৫) শরিফে বর্ণিত হয়েছে।
(১৩) তরমুজ ও শসা : তরমুজ ও শসায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি উপাদান। এ দু’টি খাবার গরমে শরীর ঠাণ্ডা রাখতে সহায়তা করে। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) তরমুজের সঙ্গে ‘রাতাব’ বা (পাকা-তাজা) খেজুর খেতেন। (বুখারি : ৫১৩৪, তিরমিজি : ১৮৪৪)।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জাফর (রা.) থেকে বর্ণিত, আমি রাসূল (সা.)-কে শসার সঙ্গে ‘রাতাব’ খেতে দেখেছি। (মুসলিম : ৩৮০৬)।
(১৪) লাউ বা কদু : লাউয়ের পুষ্টিগুণ অনেক। এটি শরীর ঠাণ্ডা রাখে। তাছাড়াও এটি আমাদের শরীরের পানির ঘাটতি পূরণ করে। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার একজন দর্জি রাসূল (সা.)-কে খাবারের দাওয়াত করে। আমিও মহানবী (সা.) এর সঙ্গে সেই খাবারে অংশগ্রহণ করি। রাসূল (সা.) এর সামনে বার্লির রুটি এবং গোশতের টুকরা ও কদু মেশানো ঝোল পরিবেশন করে। আমি দেখেছি, রাসূল (সা.) প্লেট থেকে খুঁজে খুঁজে কদু নিয়ে খাচ্ছেন। আর আমিও সেদিন থেকে কদুর প্রতি আসক্ত হয়ে উঠি। (মুসলিম, ২০৬১; বুখারি, ৫০৬৪)। লাউ খাওয়া সুন্নত।
আমাদের উচিত নবী করিম (সা.) এর পছন্দের খাবারগুলো গ্রহণ করা। কারণ এগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত। আল্লাহ! আমাদের নবী করিম (সা.) এর পছন্দের খাবারগুরো খাওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।