মানুষের পাঁচটি মৌলিক অধিকারে খাদ্য এবং বস্ত্রের পরেই বাসস্থান। যেখানে মানুষের মাথা গোজার ঠাঁই, সেই স্থানটিই যদি নিরাপদ না হয়, তাহলে মানসম্মত জীবনধারণ অলীক কল্পনাই থেকে যাবে।
একটি উন্নত বিশ্ব গড়ার প্রত্যয়ে টেকসই উন্নয়নের (এসডিজি) লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে জাতিসংঘ। আর এই টেকসই উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারা হচ্ছে টেকসই আবাসন। প্রায় প্রতিটি দেশেই টেকসই বাসস্থানের জন্য রয়েছে কিছু নীতিমালা যা বিল্ডিং কোড নামে পরিচিত।
বিল্ডিং কোড কতটা জরুরি তা চলতি বছরের তুরস্কের ভূমিকম্প থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায়। ভূমিকম্প পরবর্তী নানা পর্যালোচনা থেকে দেখা যায়, তুরস্কের ভূমিকম্পে এত বেশি ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার প্রধান কারণ ছিল ভূমিকম্পে আক্রান্ত শহরগুলোতে যে ইমারত নির্মাণ করা হয়েছে তাতে মানা হয়নি কোনো বিল্ডিং কোড।
শুধু ভূমিকম্প না, দেশে ২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ধস কিংবা চলতি বছর সিদ্দিকবাজার বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধান করে রাজউক জানিয়েছে, এসব ভবনে মানা হয়নি কোনো ধরনের বিল্ডিং কোড। একটি কোডবিহীন বিল্ডিংয়ে থাকা মানে টাইম বোমার বক্সের ভেতরে বসবাস।
জাতিসংঘের এসডিজির ১১ নম্বর লক্ষ্য হচ্ছে, টেকসই নগর ও জনপদ গড়ে তোলা। একটি টেকসই নগর ও জনপদ গড়ে তুলতে চাইলে সেখানে বিল্ডিং কোড মানার কোনো বিকল্প নেই।
জাতীয় বিল্ডিং কোড
বাংলাদেশকে একটি পূর্ণাঙ্গ বিল্ডিং কোড পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে বহুকাল। ১৯৯৩ সালে প্রথমবারের মতো বিল্ডিং কোড প্রণীত হলেও এটিকে ইমারত নির্মাণ আইনে রূপ দিতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ২০০৬ সাল অবধি।
আইনে পরিণত হওয়ার পর ২০০৯ সাল থেকে শুরু হয় বিল্ডিং কোড সংশোধন। ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে জাতীয় বিল্ডিং কোড গেজেট আকারে প্রকাশ করতে।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) ২০২০‘ গেজেট আকারে প্রকাশ হয়, যেখানে স্পষ্টত বলা আছে, দেশের সব ভবন এ কোড মোতাবেক নির্মাণ করতে হবে। গেজেট আকারে প্রকাশের পর বেশ কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের জন্য, যারা এ বিল্ডিং কোডের বাস্তবায়নের দায়িত্ব নেবে।
বর্তমানে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আদেশক্রমে দেশের, উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভা বিল্ডিং কোড বাস্তবায়নের দায়িত্বে আছে।
এর মধ্যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (খউক), রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাউক), চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক), কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক), ১২টি সিটি করপোরেশন এবং ৩২৯টি পৌরসভার বাইরে যেসব ভবন নির্মাণ হবে তা যেন কোড বাস্তবায়ন করে হয় সেলক্ষ্যে এলাকাভিত্তিক বিল্ডিং কোড কমিটি (বিসি কমিটি) তৈরি করা হয়েছে।
আদৌ মানা হয়?
প্রশ্ন হচ্ছে, দেশে গেজেট আকারে বিল্ডিং কোড থাকলেও সেটি কতটুকু মানা হয়? এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খোদ রাজধানী শহরেই প্রতিবছর এমন অনেক ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে যেখানে বিল্ডিং কোড অমান্য করা হয় কিংবা আংশিক মানা হয়।
রানা প্লাজা এবং সিদ্দিক বাজার দুর্ঘটনা ছাড়াও ২০২১ সালে বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের পর রাজউক থেকে জানানো হয়, এ ইমারতটি নির্মাণের সময় নকশা জালিয়াতি করা হয়েছে এবং মানা হয়নি বিল্ডিং কোড। পরবর্তীতে রাজউকের এক জরিপে উঠে আসে, ঢাকায় প্রায় ২ হাজার ভবন রয়েছে যা বিল্ডিং কোড না মেনেই নির্মাণ হয়েছে।
অগ্নিকাণ্ড, বিস্ফোরণ ও ভবন ধস থেকে শুরু করে এসব কোডবিহীন নির্মিত ইমারতের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি ভূমিকম্প। ২০০৯ সালে সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) ও জাইকার এক জরিপে দেখা যায়, ঢাকায় ৭ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে শহরের ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে; ১ লাখ ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এ ব্যাপারে স্থাপত্যবিদ হাবিবুর রহমান বলেন, মানুষ যখন থাকার জন্য নিজে ভবন নির্মাণ করে তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিয়ম মেনে নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে নির্মাণ করে। কিন্তু বর্তমানে রাজধানীর বেশিরভাগ ভবন নির্মাণ করে রিয়েল স্টেট বা ডেভলপার কোম্পানি। পরগাছার মতো ঢাকায় কয়েকশ ডেভলপার কোম্পানি গড়ে উঠেছে। এদের মধ্যে যারা প্রসিদ্ধ নন এমন ডেভলপার নামধারী ছোট ঠিকাদার কোম্পানিগুলোর লক্ষ্য থাকে কত কম খরচ করে নিজেদের লাভ তুলে নেয়া যায়। লাভ তুলে নেয়ার এই প্রতিযোগিতায় প্রথমেই লঙ্ঘন করা হয় বিল্ডিং কোড। এতে করে শুরুতেই নির্মিত একটি নতুন ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে।
হাবিব বলেন, নিয়ম অনুযায়ী ভবন নির্মাণের পর থাকা বা ভাড়া দেয়ার আগে রাজউক থেকে অনুমোদন এবং সনদ নিতে হবে। ঢাকার সিংহভাগ ভবন শুরুতে রাজউকের অনুমোদন নিলেও ভবন নির্মাণের পর এ সনদ নেন না। কেননা নির্মাণের আগে যাই বলা হোক না কেন, নির্মাণের সময় বিল্ডিং কোড লঙ্ঘন করা হয়।
ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা
রাজধানী শহরের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে ধরা হয় পুরান ঢাকাকে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলেও সত্য, শহরের যেসব এলাকাকে অভিজাত বলে অ্যাখ্যায়িত করা হয়, সেসব এলাকার ভবন নির্মাণেও মানা হয় না বিল্ডিং কোড।
২০১৮ সালে রাজউকের এক জরিপে দেখা যায়, রাজধানীর অভিজাত এলাকা ধানমন্ডির প্রায় ৮৯ শতাংশ ভবন নির্মাণে মানা হয়নি বিল্ডিং কোড। এর বাইরে মতিঝিল, রামপুরা, খিলগাঁও এলাকার ৯৭ শতাংশ ভবন কোডবিহীন তরিকায় নির্মিত হয়েছে।
এছাড়া মিরপুর এবং মোহম্মদপুর এলাকার ৯৫ শতাংশ ভবনে হয় বিল্ডিং কোড মানা হয়নি, আর না হয় আংশিক মানা হয়েছে।
মনিটরিংয়ের বিকল্প নেই
বিল্ডিং কোড মানার ক্ষেত্রে সরকারি সংস্থাগুলো যথাযথ মনিটরিং না করলে ছোট দুর্যোগে বড় রকমের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। রাজধানীর গাঁথুনি যদি দুর্বল হয়, সেখানে যতই উন্নয়ন করা হোক না কেন ইতিবাচক ফলাফল আসবে না বলে মতামত পরিকল্পনাবিদদের।
এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহম্মদ খান বলেন, সরকারের দায়িত্ব জনগণকে বিল্ডিং কোড নিয়ে অবগত করা এবং যারা ভবন নির্মাণের সঙ্গে জড়িত তাদের কার্যাবলি সর্বদা পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখা। ইমারত নির্মাণের শুরুতে যেমনি অনুমোদন দেয়া হয়, তেমনি আদৌ সব মেনে ইমারত নির্মাণ হলো কিনা সেটিও শক্তভাবে মনিটরিং করতে হবে।
টেকসই উন্নয়নে বিল্ডিং কোডের গুরুত্ব সম্পর্কে আদিল বলেন, নিরাপদ আবাসন ছাড়া টেকসই উন্নয়ন অসম্ভব। আর নিরাপদ আবাসন গড়তে চাইলে বিল্ডিং কোড মেনে মানসম্মত ইমারত নির্মাণের কোনো বিকল্প নেই।