ঢাকা-ভাঙ্গা রেলপথ প্রস্তুত। সুন্দরবন, বেনাপোল ও মধুমতি ট্রেনও প্রস্তুত। এই রুটের ট্রেন ভাড়া নির্ধারণ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে। ১ নভেম্বর থেকেই পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকা-ভাঙ্গা রেলপথে ছুটবে যাত্রী ও পণ্যবাহী ট্রেন।
ট্রেনের টিকিট কেটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর রেলপথ উদ্বোধন করার পরই কমলাপুর থেকে ভাঙ্গা রেল স্টেশন পর্যন্ত ৮২ দশমিক ৩০ কিলোমিটার পথ প্রস্তুত করা হয়েছে। চলছে যাত্রী ও পণ্যবাহী ট্রেন চলাচলের সিডিউল তৈরির কাজ। নতুন রুটের সিডিউল অনুযায়ী ১ নভেম্বর থেকে ঢাকা-ভাঙ্গা রেলপথে বাণিজ্যিক রেল চলাচলের কথা জানিয়েছেন পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. আফজাল হোসেন।
প্রকল্প পরিচালক বলেন, প্রথম পর্যায়ে সুন্দরবন, বেনাপোল ও মধুমতি ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। মধুমতি পদ্মা উত্তর অতিক্রম করে ভাঙ্গা হয়ে যাবে রাজশাহী। আর সুন্দরবন যাবে পদ্মা সেতু হয়ে খুলনা। বেনাপোল এক্সপ্রেস যাবে পদ্মা সেতু হয়ে যশোরের বেনাপোল।
বাণিজ্যিক ট্রেন চলাচলের অপেক্ষায় এখন পদ্মা পাড়ের মানুষ। ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ১০টি স্টেশনের সাতটিই নতুন। বাকি তিনটি আধুনিকায়ন করা হয়েছে। তবে গেন্ডারিয়া-কেরাণীগঞ্জ উড়াল পথে পাঁচ গুণ এবং পদ্মা সেতুতে ভাড়া ২৫ গুণ করার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের দাবি তাদের। স্বপ্ন জয়ের পদ্মা সেতু দিয়ে দ্রুত গতির রেল চলাচল শুরুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রেল নেটওয়ার্কের একটি যুগান্তকারী ঘটনা।
দেশের সবচেয়ে নয়নাভিরাম ও অত্যাধুনিক রেলপথের নাম এখন ঢাকা-ভাঙ্গা রেলপথ। মঙ্গলবার দুপুরে মাওয়া স্টেশন থেকে ঢাকা-ভাঙ্গা ৮২ কিলোমিটার রেলপথ উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী নিজে টিকিট কেটে নতুন রেলপথে ট্রেনে চড়ে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা রেলওয়ে জংশনে পৌঁছান। এতে পদ্মা সেতুতে যাত্রী চলাচল পূর্ণতা পেল।
এ রেলপথকে কেন্দ্র করে রাজধানীর কমলাপুর থেকে শ্যামপুর পর্যন্ত রেল লাইনের চিত্রটাই পালটে গেছে। কমলাপুরের ৮ থেকে ১১ নম্বর প্ল্যাটফরম অত্যাধুনিক আদলে তৈরি করা হয়েছে। প্ল্যাটফরম থেকে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন পৌঁছেছে শ্যামপুর আউটার পর্যন্ত। শ্যামপুর থেকে রেলপথটি উড়াল দিয়ে নারায়ণগঞ্জের আলীগঞ্জ পয়েন্ট দিয়ে ৪০০ মিটার দীর্ঘ বুড়িগঙ্গা রেল সেতু হয়ে কেরাণীগঞ্জের পানগাঁও অতিক্রম করে উড়ালপথে রেললাইন প্রায় ১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সিরাজদিখানের কুচিয়া মোড়া পর্যন্ত। ধলেশ্বরীর দুটি শাখা নদীতে ৩০০ মিটার দীর্ঘ পোরাহাটি রেল সেতু ও ৩০০ মিটার দীর্ঘ বিবিরবাজার সেতু পাড়ি দিয়ে পলাশপুর ও কুচিয়ামোড়াকে যুক্ত করা ৫০০ মিটার ধলেশ্বরী রেল সেতু। উড়ালপথের এই ১৭ কিলোমিটারই পাথরবিহীন রেল লাইন। এরপরই উড়ালপথ শেষে বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ের সেতুর নিচ দিয়ে পাথরসহ রেললাইন যুক্ত হয়েছে নিমতলী রেল স্টেশনে। বাণিজ্যিকভাবে এই স্টেশনে নানান সুবিধা রাখা হয়েছে। এটি প্রকল্পে ভাঙ্গা জংশনের পরই সর্ববৃহৎ স্টেশন। নতুন রেল লাইন শ্রীনগর স্টেশন হয়ে যুক্ত হয়েছে মাওয়ার সঙ্গে। মাওয়া স্টেশন থেকে সামান্য আগালেই পদ্মা সেতুর ভায়াডাক্ট থেকে আবার উড়ালপথ শুরু। পদ্মা সেতু হয়ে শরীয়তপুরের জাজিরা পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচসহ পদ্মা সেতু পাথরবিহীন। তাই ৮২ কিলোমিটারের প্রায় ৩০ কিলোমিটারই পাথরবিহীন রেললাইন।
উড়াল রেলপথটি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। এ উড়াল পথটির আশপাশের মনোরম দৃশ্য যাত্রীদের বাড়তি আনন্দও দেবে। এদিকে প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে তিন তলাবিশিষ্ট দেশের সর্ববৃহৎ ভাঙ্গা রেলওয়ে জংশন। ১২টি প্ল্যাটফরমের সমন্বয়ে এক ধরনের `হাব’ সিস্টেমের এ স্টেশনে যাত্রী সুরক্ষা ও সেবা নিশ্চিত করাসহ সব ধরনের ব্যবস্থাই থাকছে। স্টেশন ভবনের নিচ তলা দিয়ে ট্রেন চলাচল করবে।
নতুন রেলস্টেশনে রাখা হয়েছে অত্যাধুনিক কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলিঙ্ক সিস্টেম, যা ট্র্যাকের সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি ট্রেন চলাচলের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করবে।
এ রেলপথ নির্মাণের ফলে ঢাকা থেকে খুলনায় যাত্রার দূরত্ব প্রায় ২১৫ কিলোমিটার কমে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
বর্তমানে পশ্চিমাঞ্চল রেলে ঢাকা থেকে খুলনা যেতে যেখানে প্রায় ১০-১২ ঘণ্টা সময় লাগে, সেখানে নতুন এই রেলপথে মাত্র ৩ ঘণ্টায় যশোর ও ৪ ঘণ্টায় খুলনায় পৌঁছানো যাবে। এই রেলপথে ঢাকার সঙ্গে যশোরের দূরত্ব কমবে ১৯৩ কিলোমিটার।
প্রকল্প পরিচালক মো. আফজাল হোসেন জানিয়েছেন, নতুন এই রেলপথ দেশীয় সংযোগের পাশাপাশি আন্তর্দেশীয় রুট হিসেবেও ব্যবহৃত হবে। ট্রান্স এশিয়ান করিডরে যুক্ত হওয়ায় ভবিষ্যতে পণ্য পরিবহনের সক্ষমতাও বাড়বে। ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমারসহ অনেক দেশের সঙ্গে যুক্ত হবে পদ্মা সেতুতে রেল নেটওয়ার্ক।
দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, এই বিস্তৃত নেটওয়ার্ককে ঘিরে সরকার দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রায় ১৮টি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করছে। তৈরি পোশাক, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, কৃষিপণ্য এবং পাটজাত পণ্যের মতো ছোট-বড় কারখানা স্থাপন হলে এ অঞ্চলে প্রায় সাড়ে সাত লাখ নতুন চাকরির সংস্থান তৈরি হবে।
এই দ্রুত যোগাযোগব্যবস্থার কারণে পচনশীল খাদ্যপণ্য ও মাছ ব্যবসারও প্রসার ঘটবে। এ অঞ্চলে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা যায়, তাহলে অত্যাধুনিক রেলপথটি দেশের তিনটি সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা বন্দর এবং সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোলের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন পণ্য পরিবহনের সুযোগ তৈরি করবে।
প্রকল্প পরিচালক জানান, বাণিজ্যিক রেল চালু করতে এখন টিকিটিং সিস্টেম চালুসহ জনবল নিয়োগেরও কাজ চলছে। আর গেন্ডারিয়া থেকে মাওয়া পর্যন্ত ঢাকা অংশের জিআইবিআরের সনদ প্রক্রিয়ার কাজও এরই মধ্যে শেষ হবে বলে তিনি জানান।
তিনি আরও জানান, ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত অংশের কাজও দ্রুত এগুচ্ছে। পুরো প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৮৫ শতাংশের বেশি। যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের জন্য উন্মুক্ত করা হবে আগামী জুনে।
যেসব সুবিধা থাকছে পদ্মা রেল সংযোগে
রেলখাতে দেশের সবচেয়ে বড় এই প্রকল্প দক্ষিণাঞ্চলবাসীর কাছে উন্মুক্ত হতে যাচ্ছে রেল সংযোগের দখিনা দুয়ার। শুধু আধুনিকই নয়, দৃষ্টিনন্দন এ রেল সংযোগ প্রকল্পটির কারণে জিডিপি আরও এক শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
পদ্মা সেতু হয়ে দেশের দক্ষিণের পথে নতুন রেলপথটি ঢাকার গেন্ডারিয়া, কেরানীগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ থেকে পদ্মা সেতু হয়ে শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও ফরিদপুরে যুক্ত হয়েছে এখন। অংশ ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত চালু করতে সেনাবাহিনীর তদারকিতে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ।
অর্ধ যুগেরও বেশি সময় ধরে নির্মাণের পর এ প্রকল্প এখন বাস্তব। সুপ্রশস্ত পিচঢালা পথের পাশেই ব্র্যান্ড নিউ রেলট্র্যাক তৈরি করছে চীনা ঠিকাদার। নতুন এ লাইনটিকে দেশের সবচেয়ে আধুনিক রেলট্র্যাক আশা করা হচ্ছে, পুরোপুরি বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু হলে এই ট্র্যাক অন্তত ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতিতে ছুটতে পারবে ট্রেন। এখন পর্যন্ত মাওয়া-ভাঙ্গা অংশের অগ্রগতি হয়েছে ৯৭.৫ শতাংশ। ঢাকা-মাওয়া অংশের অগ্রগতি ৮৫ শতাংশ এবং ভাঙ্গা থেকে যশোর সেকশনের অগ্রগতি ৮০ শতাংশ। নতুন এ রেলপথের পুরো প্রকল্পে রয়েছে ২০টি স্টেশন। এর মধ্যে নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে ১৪টি স্টেশন এবং আগে থেকে রয়েছে ছয়টি স্টেশন। সবগুলো স্টেশনের কাজই চূড়ান্ত পর্যায়ে।
আশা করা হচ্ছে, ১ নভেম্বর বাণিজ্যিক ট্রেন চালুর দিন ঢাকা- ভঙ্গা অংশের ১০ টি স্টেশনই অপারেশনে যাবে।
পূর্ণাঙ্গ যাত্রী সেবা দেয়ার জন্য লিফট এবং চলন্ত সিঁড়িসহ যাবতীয় যাত্রী সেবার কাজও এগিয়ে নেয়া হচ্ছে।