বৃহস্পতিবার পাকিস্তানে নতুন পার্লামেন্টের জন্য নির্বাচন হচ্ছে। জাতীয় পরিষদ বা সংসদের নিম্নকক্ষে ২৬৬টি আসন দখলের জন্য ৪৪টি রাজনৈতিক দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। আরো ৭০টি আসন নারী ও সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষিত আছে।
কিন্তু এমন একটি দেশ যেখানে বেসামরিক সরকারগুলি সামরিক শাসনের দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে এবং যেখানে সেনাবাহিনী দেশের স্বাধীনতার ৭৬ বছরের অর্ধেক সময়ই দেশটিকে শাসন করেছে, সেখানে প্রথাগত অভিজাতরাই প্রায়ই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে।
নির্বাচনে কারা সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলবেন এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ভয়েস অব আমেরিকা।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ, পাকিস্তান মুসলিম লীগ
প্রতাপশালী ব্যবসায়ী, কোটিপতি এবং তিনবারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ পাকিস্তানের রাজনীতিতে কয়েক দশক ধরে আধিপত্য বিস্তারকারী শীর্ষ দুটি পরিবারের একটি পরিবার থেকে এসেছেন। তার পাকিস্তান মুসলিম লীগ দল ২০০৭ এবং ২০১৩ সালে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে।
কিন্তু ৭৪ বছর বয়সি শরিফ কখনোই ক্ষমতায় থাকার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি এবং প্রত্যেকবার তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। একবার সামরিক বাহিনী দ্বারা, একবার সুপ্রিম কোর্ট এবং একবার প্রেসিডেন্ট কর্তৃক ক্ষমতা থেকে অপসারিত হয়েছেন তিনি।
পাকিস্তানের অন্যান্য প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীদের মতো শরিফও মামলা এবং কারাদণ্ডের শিকার হয়েছেন। পাকিস্তানের একটি আদালত ২০২০ সালে তার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে এবং দুর্নীতির অভিযোগের মুখোমুখি হওয়ার জন্য যুক্তরাজ্যে স্বেচ্ছা-নির্বাসন থেকে ফিরে না এলে তাকে আইনের হাত থেকে পলাতক ঘোষণা করার হুমকি দেয়। বছরের পর বছর বিতর্ক সত্ত্বেও, তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন এবং দলীয় সমাবেশে হাজার হাজার সমর্থক জড়ো করেন।
গত অক্টোবরে দেশে ফেরার পর আদালত তার দোষী সাব্যস্ত হওয়া এবং কারাদণ্ডের রায় বাতিল করার পর, চতুর্থ মেয়াদে তার ক্ষমতায় যাবার পথ সুগম হয়েছে।
তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এবং তার পতনের মুল নায়ক ইমরান খান এখন কারাগারে থাকায়, ২০১৮ সালের নির্বাচন থেকে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্র তৈরি হয়ে গেছে। শরিফ ২০১৮ সালে আইনি মামলায় লড়াই করছিলেন এবং ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী হন। ইমরান খান কারাগারে থাকায় বিশ্লেষকরা শরিফের জন্য আরেকটি জয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করছেন।
জেনারেল আসিম মুনির, ক্ষমতাবান সেনাপ্রধান
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী সবসময় গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কাজে নিজেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হিসাবে উপস্থাপন করে, যদিও তা প্রায়ই পর্দার আড়ালে থেকে করে। বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির, একজন ফিটনেস ফ্যানাটিক এবং সাবেক গুপ্তচর নেতা, নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না, কিন্তু সামরিক প্রধান হিসেবে তিনি বিশাল প্রভাব বিস্তার করেন।
মুনির তার পূর্বসূরিদের তুলনায় খুব কমই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন কিন্তু বেসামরিক নাগরিকদের জন্য সামরিক বিচার এবং অবৈধভাবে দেশে বসবাসকারী বিদেশি নাগরিকদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর ব্যবস্থা করেছেন।
মুনিরের এই পদক্ষেপটি আন্তর্জাতিক এবং স্থানীয় অধিকার গোষ্ঠীগুলো নিন্দা করেছে, যার মূল লক্ষবস্তু ছিল পাকিস্তানে বসবাসকারী এক কোটি ৭০ লাখ আফগান। মুনির, যার বয়স ৫০-এর ঘরে, এই মাসের শুরুতে একটি আক্রমণের জবাবের ধারাবাহিকতায় ইরানের অভ্যন্তরে একটি প্রতিশোধমূলক বিমান হামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যা তেহরান এবং ইসলামাবাদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলে।
তার আপোষহীন অবস্থান দেশটির দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।
বন্দী ইমরান খানকে ঘটনাপ্রবাহের বাইরে রাখার পেছনেও তার ব্যক্তিগত ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়। ইমরান খানের ক্ষমতায় থাকা সময়ে মুনির দেশে গুপ্তচর সংস্থা চালাতেন কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কোনো রকম ব্যাখ্যা ছাড়াই তাকে বরখাস্ত করেন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টি
একজন প্রাক্তন ক্রিকেট তারকা থেকে ইসলামপন্থী রাজনীতিবিদে পরিণত হওয়া ইমরান খান, ২০১৮ সালের নির্বাচনে দুর্নীতি-বিরোধী, প্রতিষ্ঠান-বিরোধী প্ল্যাটফর্মে বিজয়ী হয়ে একটি জোট সরকার গঠন করেন। কিন্তু তার প্রশাসন বিরোধী দলীয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দমন করায় তার প্রধানমন্ত্রীত্ব সমস্যায় পড়ে। অনেকে বলেন যে কট্টরপন্থী আলেমদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কারণে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আক্রমণের মুখে পড়ে; তার সমালোচক এবং মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলেন যে তিনি বাক স্বাধীনতা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
একাত্তর বছর বয়সী খান, যৌন সহিংসতার বৃদ্ধির জন্য আপাতদৃষ্টিতে ‘খুব কম পোশাক পরা’ নারীদের দায়ী করার পর দেশব্যাপী নিন্দা পেয়েছিলেন।
তিনি বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাকিস্তানের সাহায্যের জন্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে যুক্তরাষ্ট্রকে অকৃতজ্ঞ বলে অভিহিত করেন এবং আল-কায়দা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে ২০১১ সালে পাকিস্তানে আমেরিকার অভিযানে নিহত একজন ‘শহীদ’ বলে অভিহিত করেন, যা যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত একজন ব্যক্তির জন্য একটি সম্মানজনক শব্দ।
খানকে শেষ পর্যন্ত ২০২২ সালের এপ্রিলে পার্লামেন্টের এক ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়, যেই পদক্ষেপটি তিনি রাস্তায় প্রতিবাদের মাধ্যমে লড়াই করার চেষ্টা করেন এবং দাবি করেন যে এটি ওয়াশিংটন এবং তার বিরোধীদের দ্বারা পরিকল্পিত ছিল।
এখন তার বিরুদ্ধে ১৫০টিরও বেশি মামলা রয়েছে এবং তিনি আগস্ট থেকে কারারুদ্ধ রয়েছেন। তাকে চারটি দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা প্রকাশ এবং বিবাহ আইন ভঙ্গ করার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে তিন দশ, চৌদ্দ, এবং সাত বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে, যা তাকে একই সাথে ভোগ করতে হবে।
তার আইনি সাজা তাকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে নিষিদ্ধ করে কিন্তু তার দল অংশ নিচ্ছে এবং এখনও তার ব্যাপক তৃণমূল অনুসারী রয়েছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ, পাকিস্তান মুসলিম লীগ
নওয়াজ শরীফের ছোট ভাই, ৭২ বছর বয়সী শাহবাজ শরীফ, ২০২২ সালের এপ্রিলে ইমরান খানের স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি এর আগে তিনবার পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, যেটি পাকিস্তানের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রদেশ যেখানে দেশের ২৪ কোটি জনসংখ্যার অর্ধেক মানুষ বসবাস করে।
যখন তার ভাই লন্ডনে সেচ্ছা-নির্বাসনে ছিলেন তখন তিনি তাদের দলের নেতৃত্ব দেন এবং সংসদে অনাস্থা ভোটে খানকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করার পর তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। শরিফের ক্ষমতায় থাকাকালীন পাকিস্তান ২০২২ সালের গ্রীষ্মে অভূতপূর্ব বৃষ্টিপাত এবং আকস্মিক বন্যার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যা ১,৭০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটায় এবং এক পর্যায়ে দেশের এক তৃতীয়াংশ নিমজ্জিত করে ফেলে, দেশটিকে বিধ্বস্ত করে তুলে। অথচ, তিনি আগস্টের শেষের দিকের আগে জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেননি, যখন শত শত মানুষের মৃত্যু হয়ে গেছে।
তিনি পাকিস্তানের ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সঙ্কট সামলাতেও অনেক হিমশিম খান এবং শুধুমাত্র জ্বালানি শুল্কের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধিতে সম্মত হওয়ার পরেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করেন। এর ফলে দৈনন্দিন পণ্যের মূল্য ব্যয়বহুল হয়ে উঠে। যার ফলে তিনি এবং তার দল উভয়েই জনপ্রিয়তা হারায়।
পাকিস্তানের সংবিধানের অধীনে, গত আগস্টে পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেয়া হলে শরীফ পদত্যাগ করেন এবং নির্বাচনের আগ পর্যন্ত একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নেন। যদি বৃহস্পতিবার তাদের দল জেতে, তাহলে শাহবাজ শরিফ সম্ভবত তার ভাইয়ের মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন।
বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি, পাকিস্তান পিপলস পার্টি
পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর জন্য সবচেয়ে কনিষ্ঠ আশাবাদী প্রার্থী হলেন বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি, যিনি নিহত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর ছেলে এবং দেশের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর নাতি, যিনি ১৯৭০-এর দশকে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং সামরিক বাহিনী দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত ও মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।
ভুট্টো-জারদারির মা এবং পিতামহ উভয়ই এখনও দলের সমর্থকদের মধ্যে বিপুল শ্রদ্ধার অধিকারী, যা তাকে একটি বিমুগ্ধ শ্রোতাবৃন্দ নিশ্চিত করে।
তার মা ২০০৭ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদে তার তৃতীয় প্ররোচনার সময় নিহত হওয়ার কয়েকদিন পর তিনি তার পরিবারের রাজনৈতিক দলের চেয়ারম্যান হন। রাজনীতিতে ভুট্টো-জারদারির জীবনও তার পিতা আসিফ আলি জারদারি প্রভাবিত করে, যিনি ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, যা মূলত একটি অলঙ্কারিক পদ ছিল।
তিনি ২০১৮ সালে তার প্রথমবার সংসদে আসন লাভ করেন এবং ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন।
ভুট্টোর ক্ষমতার ঘাঁটি হল মূলত কৃষি ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র দক্ষিণ সিন্ধু প্রদেশে, কিন্তু তাকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য তার দলের পর্যাপ্ত ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা কম। তারা শরিফ নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের অংশও হতে পারে।
ভুট্টো-জারদারি, ৩৫, ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যা পাকিস্তানের রাজনীতির একটি বৈশিষ্ট্য এবং দেশটির টিকে থাকার চাবিকাঠি হিসাবে জলবায়ু স্থিতিশীলতায় বিনিয়োগের জন্যও আহ্বান জানিয়েছেন।