জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক: আজ রোববার আর্মি স্টেডিয়ামে নেয়া হবে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের মরদেহ। শেষ যাত্রার আগে এখানে সবার প্রিয় ‘আবেদ ভাইকে’শ্রদ্ধা জানাবেন সর্বস্তরের মানুষ। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সেখানেই মরহুমের জানাজা অনুষ্ঠিত হবে বলে। ব্র্যাকের পক্ষ থেকে এসব জানানো হয়েছে।
শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) এই কিংবদন্তির মহাপ্রয়াণের পর শনিবার কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। তবে আজ রোববার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে শুরু হবে তার শেষযাত্রার আনুষ্ঠানিকতা।
সাড়ে ১০টায় আর্মি স্টেডিয়ামে আনার পর থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত তার মরদেহ সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হবে। এরপর দুপুর সাড়ে ১২টায় আর্মি স্টেডিয়ামেই জানাজা সম্পন্ন হবে। জানাজার পরে বনানী কবরস্থানে শায়িত হবেন বাংলাদেশের এই মেধাবী সন্তান।
শুক্রবার রাত ৮টা ২৮ মিনিটে রাজধানীর বসুন্ধরার অ্যাপোলো হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। তিনি স্ত্রী, এক মেয়ে, এক ছেলে এবং তিন নাতি-নাতনি রেখে গেছেন।
তার প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক মাত্র এক লাখ কর্মী নিয়ে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর ১১টি দেশের ১২০ মিলিয়ন মানুষকে বিভিন্ন সেবা দিয়ে চলেছে।
স্যার আবেদের মৃত্যুর পরে এক শোক বার্তায় ব্র্যাকের পক্ষ থেকে দুই নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ এবং ডা. মুহাম্মাদ মুসা বলেন, ‘আমরা গভীর দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ (আমাদের প্রিয় আবেদ ভাই) আর আমাদের মাঝে নেই।’
তারা বলেন, ‘এ মুহূর্তে কোনো সমবেদনা বা সান্ত্বনার ভাষাই তাকে হারানোর কষ্ট কমাতে পারবে না। যেকোনো কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে শান্ত থাকা ও এগিয়ে যাওয়ার শিক্ষাই তিনি সবসময় আমাদের দিয়েছেন। জীবনভর যে সাহস আর ধৈর্যের প্রতিচ্ছবি আমরা তার মাঝে দেখেছি, সেই শক্তি নিয়েই আমরা তার স্মৃতির প্রতি যথাযথ সম্মান জানাব।’
ফজলে হাসান আবেদের মৃত্যুর সংবাদে বাংলাদেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। বিশ্বসেরা এই বাংলাদেশির জন্য শোক জানাচ্ছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আলোচিত ব্যক্তিরা। শোক নেমে এসেছে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর ১১টি দেশের পরিচালিত ব্র্যাক পরিবারে।
প্রসঙ্গত, চলতি বছর স্যার ফজলে আবেদ ব্র্যাকের চেয়ারম্যানের পদ থেকে অব্যাহতি নেন। তাকে প্রতিষ্ঠানটির ইমেরিটাস চেয়ার নির্বাচিত করা হয়।
১৯৭২ সালে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করার পর সংস্থাটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় পরিণত হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচন ও উন্নয়নে ভূমিকা রাখায় স্যার আবেদ বাংলাদেশ ও বিশ্বের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অ্যাওয়ার্ড ও সম্মাননা পেয়েছেন।
১৯৮০ সালে র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার, ২০১১ সালে ওয়াইজ প্রাইজ অব এডুকেশন, ২০১৪ সালে লিও তলস্টয় ইন্টারন্যাশনাল গোল্ড মেডেল, স্প্যানিশ অর্ডার অব সিভিল ম্যারিট, ২০১৫ সালে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি পুরস্কার অর্জন করেন। সর্বশেষ চলতি বছর তিনি সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে সাউথ এশিয়ান ডায়াসপোরা অ্যাওয়ার্ড, শিক্ষায় ভূমিকা রাখায় ইয়াডান পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন।
ফজলে হাসান আবেদ ১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচংয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন একজন জমিদার। তার মায়ের নাম সৈয়দা সুফিয়া খাতুন।
তার পূর্বপুরুষরা ছিলেন ওই অঞ্চলের জমিদার। আবেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান বিষয়ে ও পরে ব্রিটেনের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে তিনি শেল অয়েল কোম্পানিতে অর্থনৈতিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন।
ফজলে হাসান আবেদের শিক্ষাজীবন শুরু হয় হবিগঞ্জে। হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। পরবর্তীতে দেশভাগের ঠিক আগে তার বাবা পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে হবিগঞ্জ থেকে গ্রামের বাড়ি বানিয়াচংয়ে চলে আসেন। পরবর্তীতে তিনি চাচার চাকরিস্থলে ভর্তি হন কুমিল্লা জেলা স্কুলে। সপ্তম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানেই লেখাপড়া করেন। এরপর চাচা জেলা জজ হিসেবে পাবনায় বদলি হওয়ায় তিনিও চাচার সঙ্গে পাবনায় চলে যান এবং পাবনা জেলা স্কুলে ভর্তি হোন। সেখান থেকেই ১৯৫২ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন।
১৯৫৪ সালে এইচএসসি পাস করেন নটরডেম কলেজ থেকে। সেবছরই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্স বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন।
১৯৫৬ সালের অক্টোবর মাসে তিনি স্কটল্যান্ডে গিয়ে গ্লাসগো ইউনিভার্সিটিতে নেভাল আর্কিটেকচারে ভর্তি হন। নেভাল আর্কিটেকচারের কোর্স ছিল চার বছরের। দুবছর লেখাপড়া করে কোর্স অসমাপ্ত রেখে ১৯৫৬ সালে গ্লাসগো ইউনিভার্সিটি ছেড়ে লন্ডন চলে যান এবং সেখানে ভর্তি হন অ্যাকাউন্টিংয়ে। এখানে কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টিংয়ের ওপর চার বছরের প্রফেশনাল কোর্স পাস করেন ১৯৬২ সালে। এ ছাড়া তিনি ১৯৯৪ সালে কানাডার কুইনস ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ডক্টর অব ল’ এবং ২০০৩ সালে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ডক্টর অব এডুকেশন’ ডিগ্রি লাভ করেন।