অনলাইন ডেস্ক: করোনাভাইরাস মোকাবেলায় চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন তাদের পুরস্কৃত করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে এ সময়ে যারা কাজ না করে নিজেদের সুরক্ষার জন্য পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তাদের প্রতি তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
দেশের করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের ১৫ জেলার প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশাপাশি প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ যারা প্রত্যক্ষভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তাদের সবার জন্য স্বাস্থ্যবীমার ব্যবস্থা করে দেবেন বলেও তিনি ঘোষণা দেন।
গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১০টায় শুরু হওয়া ভিডিও কনফারেন্সে গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সরকারি চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী যারা আছেন তারা করোনাভাইরাস চিকিৎসায় শুরু থেকে অবদান রাখছেন। আমি তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি শুরু থেকে দেখছি, সরকারি চিকিৎসকরা কোনো গাফিলতি করেননি। জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও তারা এগিয়ে এসেছেন। নিজেদের জীবনের ঝুঁকি থাকলেও জীবন বাজি রেখে কাজ করেছেন। আমি মনে করি তারা বড় অবদান রেখেছেন।
চিকিৎসক ও নার্সদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনার বিরুদ্ধে আমরা যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি, আপনারা সামনে থেকে সেই যুদ্ধ করে চলেছেন। আমি আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাই। শুধু ধন্যবাদ নয়, আপনাদের পুরস্কৃতও করতে চাই। সরকারি চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী যারা কোভিড-১৯ সংক্রমণের শুরু থেকে চিকিৎসাসেবা দিতে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করছেন, তাদের তালিকা করার জন্য এরই মধ্যে নির্দেশ দিয়েছি। যারা এ ধরনের সাহসী স্বাস্থ্যকর্মী, তাদের উৎসাহ দেয়া প্রয়োজন। উৎসাহের সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিশেষ সম্মানীও দিতে চাই। সে জন্যই তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছি। তালিকা তৈরির কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে শুরু থেকে যেসব চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীসহ মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের সবাইকে বিশেষ বীমার আওতায় আনার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ক্ষেত্রে কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ সরকারি পদমর্যাদাভেদে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকার বীমা করে দেয়া হবে। আর কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে এই বীমার অঙ্ক হয়ে যাবে পাঁচগুণ।
তিনি বলেন, কোভিড-১৯ প্রতিরোধে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য এবং প্রত্যক্ষভাবে নিয়োজিত কর্মচারী যারা রয়েছেন, তাদের জন্য বিশেষ ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থা করে দেব। অর্থমন্ত্রী ও অর্থ সচিবের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমরা এ ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থা করছি। মার্চে যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন, এ প্রণোদনাটুকু তাদের জন্য। যারা কাজ করেননি, তারা এ প্রণোদনা পাবেন না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এখন কেউ যদি শর্ত দেন, প্রণোদনা দিলে কাজে আসব, আমি বলব তার দরকার নেই। আগামীতে দুঃসময় আসছে। সেই দুঃসময়ে আপনারা কিভাবে কাজ করেন, সেটি দেখব। আগামী তিন মাস কী কাজ করেন, সেটি পর্যবেক্ষণ করব।
এ সময়ে সত্যি সত্যি মানুষের জন্য সেবা দিলে চিন্তা করব। তবে শর্ত দিয়ে কাউকে কাজে আনব না। যাদের মধ্যে মানবতাবোধ নেই, তাদের প্রণোদনা দিয়ে কাজে আনার যৌক্তিকতা আছে বলে মনে করি না। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে যেসব চিকিৎসক চিকিৎসা দেননি, তাদের প্রতি ক্ষোভ জানিয়ে তিনি বলেন, রোগী এলে চিকিৎসা দেবেন না- এ মানসিকতা কেন? রোগী এলে চিকিৎসা দিতে হবে। রোগী যেখানে যেখানে গিয়ে চিকিৎসককে পায়নি সেখানকার নামও জানতে চাই। তাদের চিকিৎসা করার যোগ্যতা নেই- তাদের চাকরি থেকে বের করে দেয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষার প্রয়োজন আছে। কোভিড-১৯ রোগ নিয়ে ভয় থাকতে পারে। কিন্তু একজন চিকিৎসকের দায়িত্ব থাকে রোগীকে চিকিৎসা দেয়ার। আর তাদের সুরক্ষার জন্য সবকিছু তো দিয়ে যাচ্ছি। দেশে পিপিই তৈরি করছি, বিদেশ থেকে আনছি। এখন তো বিশ্বব্যাপী একই সমস্যা। সেটা তো সবাই জানেন। এর মধ্যেও আমরা চিকিৎসকদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করে যাচ্ছি। এর পরও কেন চিকিৎসা দেবে না? দেশের চিকিৎসকরা ভয় পেয়ে চিকিৎসা না দিলে প্রয়োজনে দেশের বাইরে থেকে চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী নিয়ে আসবেন বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, যদি বাংলাদেশে এরকম দুর্দিন আসেই, প্রয়োজনে বাইরে থেকে আমরা চিকিৎসক নিয়ে আসব। বাইরে থেকে নার্স নিয়ে আসব। কিন্তু এ ধরনের দুর্বল মানসিকতা দিয়ে আমাদের কাজ হবে না, এটা হল বাস্তবতা। কাজেই তারা এখন মিটিং করুক আর শর্ত দিক, ওই শর্তে আমার কিছু আসে যায় না। বরং ভবিষ্যতে তারা ডাক্তারি করতে পারবে কিনা, সেই চিন্তা করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ডাক্তার আমাদের প্রয়োজন আছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এ মানসিকতা থাকবে কেন? মানবতাবোধ হারাবে কেন? তিনি বলেন, একজন রোগী এলে তার চিকিৎসা করতে হবে। তার জন্য নিজেকে সুরক্ষিত করা যায়। অ্যাপ্রোন পরে নেন, মুখে মাস্ক লাগান, হাতে গ্লাভস দেন, অথবা স্যানিটাইজার ব্যবহার করেন, হাত ধোন, রোগী দেখেন। রোগী কেন ফেরত যাবে? আর একজন রোগী দৌড়াদৌড়ি করে, ঘুরে ঘুরে কেন মারা যাবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের কয়েকটি হাসপাতালে ঘুরেও ভর্তি হতে না পেরে বাড়িতে মারা যাওয়া প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র কেন মারা যাবে?
এ রোগী যেখানে যেখানে গেছে, সেখানে কোন কোন ডাক্তার দায়িত্বে ছিলেন, আমি তাদের নামটাও জানতে চাই। তাদের ডাক্তারি করার মতো বা চাকরি করার মতো সক্ষমতা নেই। তাদের বের করে দেয়া উচিত চাকরি থেকে, এটা আমি মনে করি। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, অন্য সব দেশ থেকে আমরা যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করছি, তাতে আমাদের দেশেও এপ্রিলে বড় একটি ধাক্কা আসতে পারে। এরকমই আলামত পাওয়া যাচ্ছে। এ মাসটি নিয়ে খুব চিন্তায় আছি। কাজেই আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
এ অবস্থায় সবার করণীয় জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সবাইকে বলব, কেউ করোনা লুকাতে যাবেন না। সুরক্ষিত থাকুন। কোনো ধরনের অসুস্থতা মনে হলে, করোনার লক্ষণ মনে হলে ডাক্তারের কাছে যাবেন। চিকিৎসা নিন, দ্রুত আরোগ্য লাভ করুন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বাইরেও অনেকে বর্তমান পরিস্থিতিতে উপার্জনহীন হয়ে পড়েছে। কিন্তু তারা মুখ ফুটে সহায়তা চাইতে পারছে না। তাদের জন্য সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে। তালিকা করে বাড়ি বাড়ি তাদের কাছে খাবার পৌঁছে দিতে হবে।
চট্টগ্রামের ১১টি ও সিলেট বিভাগের ৪টিসহ মোট ১৫টি জেলার জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তারা এতে অংশ নেন। জেলাগুলো হল- সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনপ্রান্ত থেকে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালন করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমেদ কায়কাউস।
ওবায়দুল কাদেরকে বাসা থেকে বের হতে মানা করেছি : নোয়াখালী জেলার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা জানান, দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে বাসা থেকে বের হতে তিনি নিষেধ করেছেন। নোয়াখালী জেলার সন্তান সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ সময় গণভবনে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ে উপস্থিত ছিলেন না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সঙ্গে অবশ্য মন্ত্রী থাকতে পারত। কিন্তু তাকে (ওবায়দুল কাদের) আমি বাসা থেকে বের হতে মানা করেছি।