তৌহিদ আহমেদ রেজা: বাংলাদেশে অর্ধেকেরও বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসিয়ে রেখে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রভাড়া বাবদ গচ্চা দিচ্ছে সরকার। চাহিদার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনোমিকস ফাইনান্সিয়াল অ্যানালিসিসের (আইইইএফএ) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ক গবেষণাকারী এই প্রতিষ্ঠান সোমবার এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশে চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র বেশি স্থাপন করা হয়েছে। সে কারণে মোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাত্র ৪৩ শতাংশ ব্যবহার করা হয়, বাকি ৫৭ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসিয়ে রেখে কেন্দ্র ভাড়া দেওয়া হয়। এ কারণে বাংলাদেশে বিদ্যুতে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ছে। গত অর্থ বছরে অলস বসিয়ে রেখে এসব বেসরকারি কেন্দ্রগুলোকে ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। এ কারণে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের প্রকৃত চাহিদা পুনরায় নিরুপণ করার সুপারিশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এ সংস্থাটি। এর আগে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা অর্থনীতির জন্য ভাল হবে না বলে মত দিয়েছে তারা।
সোমবার আইইইএফএ তাদের ওয়েব সাইটে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের ওপর ‘বাংলাদেশ পাওয়ার রিভিউ ওভার ক্যাপাসিটি, ক্যাপাসিটি পেমেন্ট, সাবসিডিজ অ্যান্ড ট্যারিফ আর সেট টু রাইজ ইভেন ফাস্টার’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এর নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়া বেসরকারি ও সরকারি কোম্পানির বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ কেনার স্বল্প (রেন্টাল) ও দীর্ঘমেয়াদি (আইপিপি বা ইন্ডিপেডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) চুক্তি করে থাকে। এসব কেন্দ্রগুলোতে ব্যবহৃত তেল, গ্যাস, কয়লা বা জ্বালানির মূল্য দেয় পিডিবি, দেওয়া হয় বিদ্যুতের দাম, সারা বছর কেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি ইউনিট অর্থ বরাদ্দ থাকে। এ ছাড়া কেন্দ্রটির একটি ভাড়া দেওয়া হয় যা ক্যাপাসিটি পেমেন্ট নামে পরিচিত। যখন কোনো কেন্দ্র থেকে সরকার বিদ্যুৎ নেয় না তখন এনার্জি ও বিদ্যুতের দাম দেওয়া বন্ধ থাকে কিন্তু ক্যাপাসিটি চার্জ বা কেন্দ্রভাড়া ও রক্ষণাবেক্ষণের অর্থ ঠিকই পরিশোধ করতে হয়। একটি ১০০ মেগাওয়াটের কেন্দ্রকে বছরে শুধু কেন্দ্র ভাড়াই দিতে হয় প্রায় ৯০ কোটি টাকা। সে কারণে বিদ্যুতের প্রয়োজন না থাকলে কেন্দ্র অলস বসে থাকলে বিপুল পরিমাণ অর্থ সরকারের লোকসান হয়।
দেশে এখন বিদ্যুৎখাতের সর্বমোট উৎপাদন সক্ষমতা ১৯ হাজার ৬৩০মেগাওয়াট। গড়ে এ সময় উৎপাদন হচ্ছে সাত থেকে আট হাজার মেগাওয়াট। চাহিদা না থাকায় বাকি ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো বসে থাকছে। অথচ একই সময় পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের অধীনে সারা দেশে বিশেষত গ্রাম ও মফস্বলে বিদ্যুৎ এখনো অনেক লোডশেডিং হয়।
আইইইএফএ’র প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ২০১০ সালে একটি বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনা করে। ২০১৬ সালে ফের এটি সংশোধন করে। এই মহাপরিকল্পনায় দেশটি দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা বাড়াতে আমদানিকৃত কয়লা এবং তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি ) ওপর জোর দিয়েছে। এ ধরনের পরিকল্পনায় অন্যান্য দেশে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এটি বাংলাদেশের বিদ্যুৎখাতের আর্থিক সক্ষমতা তলানিতে নিয়ে যাবে। করোনাভাইরাস মহামারি এ পরিস্থিতি আরও শোচনীয় করে তুলবে।
বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনা অনুসারে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ অব্যাহত থাকলে ২০২৯-৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা হবে প্রকৃত চাহিদার চেয়ে ৫৮ শতাংশ বেশি। অলস পড়ে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপুল পরিমাণ কেন্দ্রভাড়া গুনতে হবে। বিশ্বের বিভিন্নদেশে প্রয়োজনের তুলনায় বাড়তি বিদ্যুৎ বড় উদ্বেগ তৈরি করেছে। এ কারণে বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎপ্রকল্প বাতিলের নজির তৈরি হচ্ছে। সম্প্রতি চীনা বিনিয়োগে মিশরে ৬ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক একটি বিদ্যুৎপ্রকল্প অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছে দেশটি।
গবেষণার প্রধান বিশ্লেষক সাইমন নিকোলাস বলেন, অর্থনীতিতে কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব আমলে নিয়ে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধির যে পূর্বাভাস আমরা করেছি, সে অনুসারে হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, ২০৩০ সালে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রয়োজনের তুলনায় ৫৮ শতাংশ বেশি থাকবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদাও কমে যাবে এবং ২০২৯-৩০ সাল নাগাদ চাহিদা আগের পূর্বাভাসের চেয়ে অনেক কম হবে। এতে অলস বসে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্র অর্থনীতির জন্য অসনীয় হয়ে উঠবে।কোভিড-১৯ মহামারীর আগে থেকেই পিডিবি ব্যাপক লোকসানে ছিল। গত অর্থ বছরে পিডিবিকে দেওয়া সরকারের ভর্তুকি আট হাজার কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকে। উৎপাদন খরচের চেয়ে কমদামে বিদ্যুৎ বিক্রি এবং লোকসান সামলানো ও নগদ অর্থের ঘাটতি মেটানোর জন্য এই ভর্তুকি দিতে হয়েছে।
বাংলাদেশের জন্য তিন শিক্ষা:আইইইএফএ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কয়লাবিদ্যুতের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতার জন্য ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত্ব বিদ্যুৎ কোম্পানী পিএলএন আর্থিক খেসারত দিচ্ছে। এটা বাংলাদেশের জন্য একটি সতর্কবার্তা। ইন্দোনেশিয়ার পরিণতি থেকে বাংলাদেশের তিনটি বিষয় শেখার আছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
এক. ইন্দোনেশিয়ায় কয়লাভিত্তিক আইপিপিগুলোর ওপর জোর দেওয়া হয়। এতে ব্যাপকভাবে সরকারি ভর্তুকি বাড়তে থাকে। ২০১৮ সালে দেশটির সরকারের ভর্তুকি ৭৫ শতাংশ বাড়াতে হয়। ২০১৮ সালে এই অঙ্ক ৪২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা যা ২০২১ সালে ৬০ হাজার কোটিতে গিয়ে ঠেকতে পারে। পিএলএনের ভর্তুকির পরিমাণ এই মুহূর্তে বাংলাদেশের পিডিবির চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি।
দুই. ইন্দোনেশিয়ার বর্তমান পরিকল্পনায় ২০১৯-২০২৮ সালের বিদ্যুতের চাহিদার বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৬.৪ শতাংশ। যদিও ২০১৮ সালের প্রকৃত চাহিদা বৃদ্ধির হার ছিল ৫.১ শতাংশ এবং ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গড় বৃদ্ধির হার ছিল ৪.৬ শতাংশ। এই ধরনের ভুল অনুমানের কারণে নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রতৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়, যার ফলে বাড়তি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে কেন্দ্র ভাড়া, ভর্তুকি ও বিদ্যুতের দাম বাড়তে থাকে।
তিন. কয়লার ওপর দিকভ্রান্ত আস্থা রাখার পর আর্থিক বিপর্যয়ের অভিজ্ঞতার পর ইন্দোনেশিয়ায় এখন আধুনিক পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ প্রযুক্তির ওপর ঝোঁকার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, যা বাংলাদেশের জন্য আরেকটি শিক্ষা। ইন্দোনেশিয়ার সরকার বলেছে যে , নবায়নযোগ্য শক্তিকে তারা জাতীয়ভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে এবং তারা নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নতুন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
আইইইএফএ’র প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে এখন নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে বিদ্যুতের দাম কমছে। ব্যয়বহুল, আমদানিকৃত কয়লা ও এলএনজি এবং বিপুল অঙ্কের ভর্তুকি ও উচ্চ মূল্যের বিদ্যুতের পথ থেকে সরে আসতে গেলে সৌর বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনে জমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে।নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের কেন্দ্র ভাড়া থাকে না। এতে একদিকে দেশের বিদ্যুতের চাহিদা মিটবে, অন্যদিকে জ্বালানী নিরাপত্তা আরও সুসংহত হবে।
আইইইএফএ’র প্রতিবেদনের বিষয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় বিদ্যুতের স্থাপিত ক্ষমতা অনেক বেশি, সে কারণে বিদ্যুতে যে ভর্তুকি সরকার দিচ্ছে তা বেসরকারি কোম্পানির মালিকদের পকেটে চলে যাচ্ছে। আইইইএফএ নতুন কিছু বলেনি, এটি আমরা অনেকদিন ধরেই বলে আসছি। এখন দরকার গোটা বিদ্যুৎ খাতের পুনঃমূল্যায়ন। বাস্তবে বাংলাদেশের কতটুকু বিদ্যুৎ দরকার সেটা আগে নির্ধারণ করা দরকার। তা না হলে বিদ্যুৎ খাতের এই লোকসান গোটা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরুপ প্রভাব ফেলবে।