নিজস্ব প্রতিবেদক: এবার সেই মেগাপ্রকল্পে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগে (পিডি) আরেক এলাহি কাণ্ড ঘটালো কৃষি মন্ত্রণালয়। আলোচিত বঁটি-ড্রামকাণ্ডের ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প’-এ পিডি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে নীতিমালা লংঘন করে। পিডি নিয়োগে সচিবের অনুমোদন নেই। ওয়েবসাইটে প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়নি, রাখা হয়েছে গোপন। পঞ্চম গ্রেডের এই পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তৃতীয় গ্রেডের কর্মকর্তাকে। আবার ওই কর্মকর্তার চাকরির বয়স আছে মাত্র দুই বছর। আট-নয় মাসের মধ্যেই তিনি পাবেন পদোন্নতি। অপর একটি প্রকল্পের পিডি থেকেও অব্যাহতি নেননি তিনি। ওই প্রকল্পেরও রয়েছে অনিয়ম–দুর্নীতির অভিযোগ। এসব ঘটনায় তোলপাড় চলছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিফতরসহ কৃষিবিদ মহলে।
এবিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (সম্প্রসারণ শাখা-১) মো. মশিউর রহমান বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী বেনজীর আলমকে পিডি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নীতিমালার কোনো ব্যত্যয় ঘটানো হয়নি। আর প্রজ্ঞাপন ওয়েবসাইটে দিতে হবে এমন কোনো কথা নেই।
পিডি নিয়োগের প্রজ্ঞাপনে দেখা গেছে, সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পে গত ১৪ অক্টোবর পিডি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে। এতে সাক্ষর রয়েছে মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব (সম্প্রসারণ শাখা-১) মো. মশিউর রহমানের। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) অতিরিক্ত পরিচালক ও প্রেষণে নিযুক্ত ‘কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটসমূহের (এটিআই)
কার্যক্রম শক্তিশালীকরণ প্রকল্প’র পিডি বিসিএস কৃষি ক্যাডারের কর্মকর্তা মো. বেনজীর আলমকে সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের পিডি নিয়োগ দেওয়া হল। তবে নিয়ম থাকলেও এই প্রজ্ঞাপন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে গত ২২ অক্টোবর পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়নি। একেবারেই গোপন রাখা হয়েছে। অবশ্য নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তার আইডিসহ ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে প্রজ্ঞাপনটি।
জানা গেছে, এই প্রজ্ঞাপনে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সদ্য বিদায়ী সচিব মো. নাসিরুজ্জামানের সই বা অনুমোদন নেই। তিনি ১৫ অক্টোবর অবসরকালীন ছুটিতে (পিআরএল) যান। নিয়ম-বিধির মধ্যে না পড়ায় বেনজির আলমকে পিডি হিসেবে নিয়োগ দিতে আপত্তি করেন সচিব। একারণে তার অনুমোদন ছাড়াই গোপনে ওই প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। বিষয়টি মো. নাসিরুজ্জামান দাফতরিকভাবে পত্রের মাধ্যমে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে (হাসানুজ্জামান কল্লোল) ১৯ অক্টোবরসহ কয়েক দফা ডেকে নিয়ে কৈফিত চেয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, এটিআইসমূহের কার্যক্রম শক্তিশালীকরণ প্রল্পের পিডি মো. বেনজীর আলম ডিএইর অতিরিক্তি পরিচালক পদ মর্যাদার কর্মকর্তা। এই পদটি সরকারের টাইম স্কেলের তৃতীয় গ্রেডের পদ। আর পিডি পদটি দুই ধাপ নিচের পঞ্চম গ্রেডের। সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা বা ডিপিপিতেও (ডিএই’র মূল ডিপিপিতে পিডি ও ডিপিডির যোগ্যতায় বিসিএস কৃষি ক্যাডার কর্মকর্তা অথবা বিসিএস কৃষি প্রকৌশলী উল্লেখ ছিল। অবৈধভাবে এটি পরিবর্তন করা হয়।) পিডির পদ পঞ্চম গ্রেড এবং ডিএই থেকে প্রেষণে নিয়োগের কথা বলা হয়েছে এবং তাকে হতে হবে বিসিএস কৃষি প্রকৌশলী। প্রকল্পের কাজে থাকতে হবে কমপক্ষে ২০ বছরের অভিজ্ঞতা। কিন্তু কৃষিবিদ বেনজীর আলমের প্রকল্পের কাজে এই অভিজ্ঞতা নেই।
২০১৬ সালে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের জারি করা নীতিমালায় বলা হয়েছে, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৬ মাস পর্যন্ত যেসব কর্মকর্তার চাকরির মেয়াদ থাকবে না, তাদের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। খামার যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পে পিডি নিয়োগে এ বিষয়টিও চরমভাবে উপেক্ষিত হয়েছে। বেনজীর আলমের জন্ম ১৯৬৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর। এ হিসেবে তার চকরি জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে ২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর। অর্থাৎ তার চাকরির বয়স আছে প্রায় দুই বছর তিন মাস। এছাড়া জ্যেষ্ঠতার কারণে আগামী ৬-৭ মাসের মধ্যে পরিচালক পদ মর্যাদায় তার পদোন্নতি পাওয়ার কথা রয়েছে। সরকারী বিধি অনুসারে কখনই পরিচালক পদের কোনো কর্মকর্তা কোনো অবস্থায়ই পিডি থাকতে পারবেন না। তাহলে কীসের স্বার্থে নীতিমালা ও বিধি-বিধানের জলাঞ্জলি দিয়ে অল্প সময়ের জন্য বেনজীর আলমকে পিডি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে-এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সংশ্লিষ্টদের মাঝে।
সূত্র জানায়, প্রকল্পের কার্যক্রমের শুরুতেই কেনাকাটা ও জনবল নিয়োগের বিষয়টি থাকে। একে কেন্দ্র করেই তৈরি হয় আর্থিক ফায়দা লোটার সুযোগ। ডিপিপি সংশোধন না করেই প্রকল্প পাস হওয়ার তিন মাস পর পিডি নিয়োগ দেওয়া হল। মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে একটি প্রভাবশালী কৃষিবিদ মহলের তদবিরে বিতর্কিত ও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত বেনজীর আলমকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। নিয়োগ পাওয়ার পর উল্লাস ও মিষ্টি বিতরণ করেছেন বেনজীর আলম।
এদিকে ‘কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটসমূহের কার্যক্রম শক্তিশালীকরণ প্রকল্প’র কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ডিপিপি অনুয়ায়ী গত জুনে নির্ধারিত কাজ শেষ করতে পারেননি প্রকল্প পরিচালক বেনজীর আলম। যে কাজ সম্পন্ন হয়েছে তাও নিম্নমানের এবং সন্তোষজনক নয়। বাঞ্ছারামপুর, খুলনা, সাটুরিয়াসহ বিভিন্ন এটিআইতে কাজের মান খুবই খারাপ। দুই ফুটের পরিবর্তে বসানো হয়েছে এক ফুটের টাইলস। দরপত্রের স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী টাইলস লাগানো ও সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হয়নি। এমনকি কাজ অসম্পূর্ণ থাকলেও জুনে সম্পূর্ণ বিল দিয়ে দেওয়া হয়েছে ঠিকাদারদের। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের জুনে। ১১৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ব্যয়ের তিন বছর মেয়াদী এই প্রকল্পের দুই বছর অতিক্রান্ত হলেও সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৩২ শতাংশ। বাকী সময়ে কোনো অবস্থায়ই প্রকল্পের বাকি কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। যথাসময়ে কাজ সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রকল্পটি রিভিশন করে আরও এক বছর বাড়ানোর নির্দেশনা রয়েছে পরিকল্পনা বিভাগের।
এবিষয়ে কোনো পদক্ষেপ বা প্রক্রিয়া এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। বিষয়টি গত ১৯ অক্টোবর/২০ ডিএইতে অনুষ্ঠিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিবি) সভায়ও আলোচিত হয়েছে। বেনজীর আলমের দক্ষতা ও প্রকল্পের কাজে ক্ষোভ প্রকাশ করে ডিএইর মহাপরিচালক যথাযথভাবে কাজ সম্পাদন এবং প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করার নির্দেশ দেন বেনজীর আলমকে। এই প্রকল্পের আওতায় চলতি অর্থ বছরে ৩৫টি এয়ারকুলা, ৩২টি এলইডি টিভি, ফুট পাম্প ৪৮টি, স্প্রে মেশিন ৮০টি, লন মোয়ার ১৬টি, ফটোকপিয়ার ১৮টি, মাল্টিমিডিয়া ৬৬টি, ফ্রিজ ৪৮টি, কম্পিউটার ৩৩৮টি, পাওয়ার টিলার ১৬টি, আসবাবপত্র ৩৩১০ সেট কেনাকাট, চারটি ভবন মেরামত, ২০ হাজার ৭০০ এরএম সীমানা প্রাচীর নির্মাণ এবং ৯ হাজার ৪৩৫ ঘনমিটার ভূমি উন্নয়ন কাজের প্রস্তাব রয়েছে। আগের অর্থ বছরগুলোতে সরঞ্জাম কেনাকাটা ও কাজে অনিয়ম -দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ। এই অবস্থায় একজন অদক্ষ ও দুর্নীতিপরায়ন কর্মকর্তাকে মেগাপ্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়ায় হতবাক সংশ্লিষ্টরা। প্রকল্পটির যথাযথ বাস্তবায়ন নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন কৃষিবিদরা।
প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ অগ্রাধিকার তিন হাজার বিশ কোটি টাকা ব্যয়ের ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ প্রকল্পটি গত ১৪ জুলাই/২০ অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। এই প্রকল্পের ডিপিপিতে একটি ২০০ লিটারের পানির প্লাস্টিকের একটি ড্রাম (চাউলসহ) ও সবজি কাটার একটি বঁটির দাম ধরা হয়েছে ১০ হাজার টাকা করে। এক কেজি ধারণক্ষমতার একটি মসলাপাত্রের দাম দুই হাজার টাকা, একটি অ্যালুমিনিয়ামের চামচের দাম এক হাজার টাকা, একটি প্লেটের দাম এক হাজার টাকা, দেড় থেকে দুই টন ক্ষমতার একটি এসির দাম দুই লাখ টাকা, ইন্টেল কোর আই-৫ প্রসেসরের ১৪ ইঞ্চি মনিটরের একটি ল্যাপটপের দাম এক লাখ ৩০ হাজার টাকা ধরা হয়েছ। এরকম বিভিন্ন সরঞ্জামের অস্বাভাবিক দাম ধরা হয়।
এ বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। এঘটনায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. মো. আবদুর রৌফের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক একেএম মনিরুল আলমের নেতৃত্বে একটি তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটি গত ২০ আগস্ট তদন্ত প্রতিবেদন সচিবের কাছে জমা দেয়। ওই তদন্ত কমিটি প্রকল্পে বিভিন্ন সরঞ্জামের অস্বাভাবিক দামের প্রমাণ প্রায়। প্রতিবেদনে শুধু ডিপিপি প্রণয়নকারী বিলুপ্ত খামার যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের পিডি শেখ নাজিম উদ্দিনকে অভিযুক্ত করে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তির সুপারিশ করা হয়েছে। দুদকও তার অনিয়ম-দুর্নীতি খতিয়ে দেখছে। অথচ এর সঙ্গে জড়িত ওই প্রকল্পের ডিপিডি শফিকুল ইসলাম শেখ এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন, পরিকল্পনা ও মনিটরিং উইংয়ের ডেস্ক অফিসার রেহানা সুলতানাসহ কৃষি মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা বিভাগ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের দায়ী করা হয়নি। তারা রয়েছেন বহাল তবিয়তে। আর খামারবাড়ির তদন্ত কমিটি কাউকে দায়ী না করে দায়সারা প্রতিবেদন দিয়েছে।
এরপর কৃষি খাতে সরকারের এই প্রথম মেগাপ্রকল্পের পিডি নিয়োগ নিয়ে শুরু হয় নানান ঘটনা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিফতরের ইচ্ছুক কর্মকর্তাদের শুরু হয় ইঁদুর দৌঁড়। বিসিএস কৃষিবিদ ও কৃষি প্রকৌশলীকে পিডি নিয়োগ নিয়ে দেন-দরবার চলে, কয়েক দফা প্রস্তাব তৈরি করা হয়। কেউ কেউ বিতর্কিত এই প্রকল্পের পিডি হতে অপারগতা জানায়। আবার কেউ নামেন অর্থ নিয়ে। এদের বেশিরভাগই কোনো না কোনো প্রকল্পের পিডি। একারণে আর্থিকভাবেও তারা সবল।