রাজধানীর গুলশানের ফ্ল্যাট থেকে মরদেহ উদ্ধার হওয়া মোসারাত জাহান মুনিয়া (২১) সম্পর্কে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসছে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য। খোদ তার বড় বোন ও গুলশান থানায় করা মামলার বাদী নুসরাত জাহান বলেছেন, ‘মুনিয়ার সঙ্গে থাকা ছবি নিয়ে একজন শিল্পপতির ছেলেকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করেছিল হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর ছেলে নাজমুল হক চৌধুরী শারুন।’
নুসরাত আরও বলেন, ‘মুনিয়া তার বিপদ থেকে উদ্ধার হওয়ার জন্য শারুনের সহযোগিতা চেয়েছিল। শারুন তাকে (মুনিয়া) বিভিন্ন সময় সহযোগিতা করে।’ তবে শারুন এসব অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। এদিকে শারুন-মুনিয়ার সম্পর্ক নিয়ে মুখ খুলেছেন তার সাবেক স্ত্রী সাইফা রহমান মীম।
তিনি বলেন, ‘শারুনের শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের কারণে আমি কয়েক দফা সুইসাইড করার চেষ্টা করি। মোসারাত জাহান মুনিয়াসহ বহু নারীর সঙ্গে শারুনের ঘনিষ্ঠতা ছিল। মুনিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা নিয়ে কথা বললে সে আমাকে বেধড়ক মারধর করে। এমনকি আমি ও আমার মা-বাবাকে হত্যার হুমকি দেয়। তার সঙ্গে সবসময় পিস্তল থাকে, ওই পিস্তল উঁচিয়ে ভয় দেখায়।’
গত ২৬ এপ্রিল গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে মুনিয়ার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এরই মধ্যে তার বিষয়ে বহু তথ্য এসেছে পুলিশের হাতে। পুলিশ প্রাপ্ত তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করে এসব ঘটনার সঙ্গে মুনিয়ার আত্মহত্যার সংযোগ খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছে।
মুনিয়ার সঙ্গে শারুনের সম্পর্ক কী ছিল, পরিচয় কীভাবে, জানতে চাইলে তার বড় বোন নুসরাত জাহান বলেন, ‘মুনিয়ার সঙ্গে শারুনের পরিচয় ছিল। সেটা আমি জানতাম। মুনিয়া আমাকে বলেছে, শারুন তাদের একটি ছবি দিয়ে শিল্পপতি পুত্রকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেটা কী ছবি এটা আমি জানি না। তাছাড়া শারুনের স্ত্রী সাইফা রহমান মীমকেও আমি চিনতাম।’
শারুনের সঙ্গে মুনিয়ার চ্যাটিংয়ের কয়েকটি স্ক্রিনশট হাতে এসেছে। এতে লেখা ছিল, ‘তুমি কিছু করলে বসুন্ধরা গ্রুপ শেষ হয়ে যাবে। তারা আমার নামে নিউজ করতেছে, কী করতে পারছে। সো টাইম নাই, ইফতারির টাইম হয়ে যাচ্ছে, আমাকে টেলিগ্রামে নক দিও।’ জবাবে মুনিয়া লেখেন, ‘আপনি আসলেই ফেরেশতা, কেন যে আপনার মতো মানুষ আমি পাইনি লাইফে।’
এছাড়া মুনিয়ার টাকা চাওয়ার কয়েকটি চ্যাটের স্ক্রিনশট কাছে এসেছে। তবে ওই চ্যাটগুলো কার সঙ্গে সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এতে লেখা, ‘খুব বিপদে আছি, আমার টাকা দরকার। হাতে টাকা নাই। বড় লোক একটা ধরতে হবে আবার। তুমি অনেক মজা নিছ আমার সাথে, এখন বলছ নাই, মনে আছে সেই দিনের কথা, কত আদর করছ আমাকে, কত মজা নিছ, আর আমাকে এখন টাকা দিচ্ছ না, বাসা ভাড়া নাই, বড় আপুকে টাকা দিতে হবে। আবার এমন কাউকে ঠিক করতে হবে যাকে ব্ল্যাকমেইল করে অনেক কিছু নেওয়া যায়, যে সম্মানের ভয় পায়, সম্রাট জেলে যাওয়ার পর খুব বিপদে আছি। আপু-ভাইয়া (ভগ্নিপতি) ঝগড়া করে টাকার জন্য। সবই তো জানো। আমি একা মানুষ, কত করা যায়, টাকা না দিলেই ঝগড়া।’
জবাবে মুনিয়াকে লেখা হয়, ‘তুমি এখন কোথায়।’ মুনিয়া লেখেন, ‘এক বড় ভাইয়ের বাসায়।’ এরপর মুনিয়ার কাছে জানতে চাওয়া হয়, ‘কী করো?’ মুনিয়ার জবাব, ‘তুমি বুঝো না? প্লিজ (টাকা) রেডি করো।’ জবাবে লেখা হয়, ‘কী আজব, আমি কি এগুলো করি নাকি, আমি কোথা থেকে রেডি করব।’ এরপর মুনিয়া লেখেন, ‘ওকে তোমার বউকে সব বলব।’ এবার জবাবে আসে, ‘আবার শুরু করলা?’ মুনিয়া লেখেন, ‘না হলে তুমি টাকা দাও। নুসরাত আপু আমাকে খুব জ্বালাচ্ছে। টাকা না দিলে মাইর খাব। ভাইয়ারও (ভগ্নিপতি) বিপদ যাচ্ছে। টাকাটা লাগবে। দাও। আমার এই নম্বরে কিছু টাকা দাও। পার্সোনাল নম্বর। ৩০ মিনিটের মধ্যে দাও।’ জবাবে লেখা হয়, ‘কীভাবে, আমি বাসায়।’ মুনিয়া লেখেন, ‘জানি না লাগবে আমার। না হলে বউকে ফোন করে…।’ জবাবে ওই ব্যক্তি লেখেন, ‘মানুষকে এত কষ্ট দিও না, নিজে একদিন বিপদে পড়ে যাবে, এত ব্ল্যাকমেইল ভালো না। দিচ্ছি।’ এরপর মুনিয়া লেখেন, ‘ওকে, দাও পরে দেখছি। আমার কেউ কিছু করতে পারবে না।’
এ চ্যাটের স্ক্রিনশটের বিষয়ে পুলিশের কোনো কর্মকর্তাও কিছু জানাতে পারেননি। যে নম্বরে মুনিয়া চ্যাট করেন ওই নম্বরটি গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায়ও খোলা ছিল। সেখানে কয়েকবার কল দেওয়া হলেও কেউ রিসিভ করেনি। ট্রু কলারে ওই নম্বরের আইডি আসে ‘নুসরাত জাহান’।
এদিকে মুনিয়ার সঙ্গে শারুনের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে তার সাবেক স্ত্রী সাইফা রহমান মীম গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, ‘শারুনের সঙ্গে মুনিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। আমি সেটা জানতাম। মুনিয়ার বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে সে আমাকে বেধড়ক মারধর করে। এমনকি আমার মেয়ে সাইশা করিম চৌধুরীকে মারার হুমকিও দেয়। একপর্যায়ে আমি সুইসাইড করারও চেষ্টা করি।’
মীম আরও জানান, ২০১৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর শারুনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। পরের বছর ২৪ জুন তাদের একমাত্র মেয়ে সাইশা করিম চৌধুরীর জন্ম হয়। মীমের দাবি, এরপর থেকেই মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনসহ, বিচ্ছেদে ঠেলে দেওয়া এবং একমাত্র শিশুসন্তানকে আটকে রাখা, হত্যার হুমকি এবং আত্মহত্যা করার মতো গুরুতর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে শারুন।
সাইফা মীম বলেন, ‘সে (শারুন) আমাকে কথায় কথায় মারত। উঠতে-বসতে মারত। তার অনেক মেয়ের সঙ্গে ফ্রেন্ডশিপ ছিল। মুনিয়ার সঙ্গেও তার সম্পর্ক অনেক গভীর ছিল। আমি এসব বিষয় জেনে যাই। তার কাছে জানতে চাইলে সে আমাকে মারধর করত। আমার সঙ্গে বিভিন্নজনের নাম জড়িয়ে অনেক অপবাদ দিয়েছে। অনেক আজেবাজে কথা বলেছে। আমাকে নিয়ে অনেক নোংরা কথা বলেছে। আমার চেনা অনেকের সঙ্গেও আমাকে জড়িয়ে অপবাদ দিয়েছে। কাউকে চেনা মানেই তো পরকীয়া নয়।’
শারুনের সাবেক স্ত্রী আরও বলেন, ‘সে (শারুন) বিভিন্ন স্থানে আড্ডা দিয়ে অনেক রাতে বাসায় ফিরত। কোথায় ছিল, এটা তো আমি স্ত্রী হিসেবে জানতে চাইতেই পারি। আমি প্রশ্ন করলেই আমাকে মারধর করত। তার সঙ্গে অনেক মেয়ে এমনকি অনেকের স্ত্রীরও সম্পর্ক ছিল। আমি নাম বলতে চাই না। আমি একজন স্ত্রী হিসেবে এসব লাইক করতাম না। মুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি আমি জেনেছি এবং দেখেছি। এটা নিয়ে প্রশ্ন করাতেও সে আমাকে মারধর করে। সে (শারুন) অনেকবার আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করে। বালিশচাপা দেয় অনেকবার। পরে আমি বাবার বাসায় চলে আসি এবং তাকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিই।’
সাইফা মীম বলেন, ‘আমি ওই বাসায় (শারুনের বাসা) থাকতেই সুইসাইড করার চেষ্টা করি। আমি হাসপাতালেও ছিলাম। শারুন আমার বাবাকে খুবই ইনসাল্ট করত। সে আমাকে মারধর করার পর আমি বাসায় এসে পড়লেও সে আমার আব্বু-আম্মুকে কথা বলতে বাধ্য করত। সে আমাকে ফোন দিয়ে বলত, “তোর বাপকে ফোন ধরতে বল নইলে তোকে আর তোর বাপকে সুইসাইড করতে বাধ্য করব। আমার সামনেই সুইসাইড করবি।” তাছাড়া তার সঙ্গে সারাক্ষণ একটা পিস্তল থাকে। সে আমাকে নিয়ে ড্রাইভিংয়ে বেরিয়ে উল্টোপাল্টা গাড়ি চালিয়ে বলত, “তোরে আর তোর বাচ্চারে নিয়ে আমিসহ মরব।”’
শারুনকে ‘সাইকো’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তিন বছর ধরে তারা আমার মেয়েকে আটকে রেখেছে। সে আমাকে মেয়ের সঙ্গেও কথা বলতে দেয় না।’
যুক্তরাষ্ট্রে লেখাপড়া করা উচ্চশিক্ষিত নারী সাইফা মীমের গ্রামের বাড়ি ফেনীতে। তিনি এখন মা-বাবার সঙ্গে রাজধানীর লালবাগ এলাকায় থাকেন। সাইফা মীম বলেন, ‘আমি তাকে (শারুন) ডিভোর্স দেওয়ার পরও সে আমাকে নানাভাবে প্রেসার দিচ্ছে। বলছে তুই আমেরিকা চলে যা। আমাকে মেরে ফেলার থ্রেট দেয়। আমার বাবাকে মেরে ফেলবে, বাচ্চাকে কিডন্যাপ করবে ইত্যাদি। আমি বাচ্চাকে ফোন দিলে আমার সঙ্গে তাকে কথা বলতে দেয় না। বাচ্চাকে আমার দেওয়া আইপ্যাডটি পর্যন্ত বন্ধ করে রেখেছে। আমি আইনের দ্বারস্থ হব মেয়ের অভিভাবকত্ব চেয়ে।’
এছাড়া চলতি মাসের শুরুর দিকে চট্টগ্রামের ব্যাংকার আকতার মোর্শেদ চৌধুরীর আত্মহত্যার প্ররোচনায় জড়িতদের সহযোগী হিসেবে শারুনের নাম আসে। মোর্শেদের স্ত্রী শিক্ষিকা ইশরাত জাহান চৌধুরী মামলায় ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে করা সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, ‘আমার স্বামীকে মানসিক নির্যাতন, হুমকিসহ নানাভাবে আত্মহত্যার পরিস্থিতি তৈরি করার পেছনে শারুনের সম্পৃক্ততা রয়েছে।’
এদিকে সাইফা রহমান মীমের করা অভিযোগ ও স্ক্রিনশটের বিষয়ে নাজমুল হক চৌধুরী শারুন বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আমার সাবেক স্ত্রী যা অভিযোগ করেছে এসবই মিথ্যা বানোয়াট। আমি তাকে কখনই মারধর করিনি। রং ফর্সাকারী ক্রিম ব্যবহার করার কারণে তার চোখের ওপরে ব্রন জাতীয় গোটা ওঠে। সেটা দেখিয়ে সে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে বলেছে, মারধর করেছি।’
সাইফা মীমকে বিয়ে করাটা ছিল তার জীবনের বড় ভুল উল্লেখ করে শারুন বলেন, ‘আমি আমেরিকায় লেখাপড়া করতে গিয়ে তার সঙ্গে পরিচয়। সেখান থেকে পরিবারের অমতে বিয়ে করি।’
শারুন আরও বলেন, ‘যেসব স্ক্রিনশট দেখিয়ে আমার চ্যাটিং বলা হচ্ছে সেগুলো আমার নয়। আমি এর ফরেনসিক পরীক্ষা করার দাবি জানাই। তাছাড়া সেখানে বসুন্ধরা লেখা বানানটাও ভুল ছিল, আমি অন্তত এত অশিক্ষিত নই। তাছাড়া মুনিয়ার সঙ্গে আমার যে সম্পর্কের কথা বলা হচ্ছে সেগুলো সবই ভুয়া। সাইফার সঙ্গে দুই বছর আগেই আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। সে কীভাবে জানল, মুনিয়ার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল। উল্টো যে শিল্পপতির ছেলের কথা আপনারা বলছেন তার সঙ্গে সাইফার সম্পর্ক ছিল।’
মুনিয়ার বড় বোন নুসরাতের করা অভিযোগের ব্যাপারে শারুন বলেন, ‘আমি ওই মহিলাকে চিনিই না। সে কী বলেছে তা-ও জানি না।’
এদিকে শারুনের সঙ্গে মুনিয়ার সম্পর্কের বিষয়ে মামলার তদারকি কর্মকর্তা গুলশান বিভাগের উপকমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, ‘আমরা তদন্তে কিছু তথ্য পেয়েছি। সেগুলো যাচাই করা হচ্ছে। আমরা শারুনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি।’ সূত্র: দেশ রূপান্তর