রাশিয়া দাবি করেছে যে, ইউক্রেনের সাথে চুক্তির কিছু অংশ নিয়ে একটি শান্তি চুক্তি করা সম্ভব হতে পারে। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেছেন যে, ইউক্রেনের জন্য ‘নিরপেক্ষ অবস্থা’ এখন টেবিলে রয়েছে। ল্যাভরভ রাশিয়ান চ্যানেল আরবিকে টিভিকে বলেছেন, ‘নিরাপত্তার নিশ্চয়তার ক্ষেত্রে একটি নিরপেক্ষ অবস্থা গুরুত্বের সাথে আলোচনা করা হচ্ছে’। ‘এমন কংক্রিট ফর্মুলেশন রয়েছে যা আমার দৃষ্টিতে একমত হওয়ার কাছাকাছি’। তিনি যোগ করেছেন যে, আলোচনায় একটি ‘ব্যবসার মত চেতনা’ও উঠে আসছে। মঙ্গলবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির বক্তব্য ‘ইউক্রেনকে মেনে নেওয়া উচিত যে, তারা ন্যাটো নিরাপত্তা জোটের সদস্য হবে না’ আসার পর তিনি এ মন্তব্য করেছেন।
এক ভিডিও বার্তায় মি. জেলেনস্কি বলেছিলেন, ‘ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য নয়। আমরা সেটা বুঝি। আমরা কয়েক বছর ধরে শুনেছি যে, দরজা খোলা ছিল, কিন্তু আমরা এটাও শুনেছি যে, আমরা যোগ দিতে পারিনি। এটি একটি সত্য এবং এটি অবশ্যই স্বীকৃত হবে’।
মি. ল্যাভরভ অবশ্য সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে, ইউক্রেনের সাথে আলোচনা সহজ ছিল না, কিন্তু বলেন যে, ‘একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর কিছু আশা ছিল’। শত্রæতা বন্ধ করার আগে মস্কো অন্যান্য বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ইউক্রেনে রুশভাষী জনগণের অধিকার, দেশের নিরস্ত্রীকরণ এবং পূর্ব ইউক্রেনের মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ।
এদিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, ‘যুদ্ধের তিন সপ্তাহে এসে রাশিয়ার দাবিগুলো খুবই বাস্তবসম্মত হয়ে গেছে। ‘আলোচনার জন্য আরো সময় দরকার, আর এ আলোচনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে চলতে থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘আলোচনা চলতে থাকবে, আমাকে জানানো হয়েছে। এরই মধ্যে আলোচনার বিষয়বস্তু খুবই বাস্তবসম্মত মনে হচ্ছে। কিন্তু ইউক্রেনের স্বার্থরক্ষার মতো সিদ্ধান্তে আসতে আরো সময় দরকার।’ পাশাপাশি ইউক্রেনকে আরো অস্ত্র, আকাশসীমায় নো-ফ্লাই জোন ও রাশিয়াকে শাস্তি দিতে দেশটিকে আরো অবরোধ দেয়ার আহŸান জানান জেলেনস্কি। তিনি জানিয়েছেন, মঙ্গলবার রুশ সেনারা ইউক্রেনে অগ্রসর হতে পারেনি, তবে শহরগুলোর ওপর তাদের গোলাবর্ষণ অব্যাহত রয়েছে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি আগের থেকে অনেকটা নমনীয় হয়ে এসেছেন। ইতোমধ্যে তিনি ন্যাটোতে যোগদানের ইচ্ছা ত্যাগ করেছেন। এবার জানিয়েছেন, রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি আলোচনা এখন অনেক বেশি বাস্তবসম্মত জায়গায় এসেছে। তবে আলোচনা সফল হতে এখনো কিছুটা সময় লাগবে।
ওদিকে রাশিয়ার অভিযান ও তীব্র সঙ্ঘাতের মধ্যেই ইউক্রেনের পাশে থাকার বার্তা দিতে ট্রেনে করে মঙ্গলবার কিয়েভ সফর করেছেন পোল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র ও সেøাভেনিয়ার প্রধানমন্ত্রীরা। পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মোরাভিয়েৎস্কি সামাজিক মাধ্যমে ছবি শেয়ার করে লিখেছেন, ‘এখানে, এ যুদ্ধবিধ্বস্ত কিয়েভে, ইতিহাস তৈরি হচ্ছে। এখানেই স্বাধীনতা সংগ্রামীরা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়ছেন। আমাদের ভবিষ্যৎ একটা সরু সুতোর ওপর ঝুলছে।’ এই তিন নেতাই ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রতিনিধি হিসাবে গেছেন। তারা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে দেখা করেছেন, কথা বলেছেন। পোল্যান্ডের উপ-প্রধানমন্ত্রী কাচয়েনস্কি দাবি করেছেন, ইউক্রেনে একটি আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করতে হবে। তিনি বলেছেন, ‘আমি মনে করি, ইউক্রেনে একটা শান্তি মিশন জরুরি। ন্যাটোর একটা আন্তর্জাতিক কাঠামো আছে। এ বাহিনীর নিজেদের রক্ষা করার ক্ষমতা থাকবে এবং তা ইউক্রেনের মাটিতে দাঁড়িয়ে কাজ করবে।’ তার বক্তব্য, ‘এটা হবে শান্তিপ্রতিষ্ঠার জন্য মিশন। তারা মানবিক সাহায্য পৌঁছে দেবে। একই সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনী তাদের রক্ষা করবে।’
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাইডেন, জার্মানির চ্যান্সেলার শলৎস আগে জানিয়েছেন এবং ন্যাটোর পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে, তারা ইউক্রেনে সেনা পাঠাবেন না। ইউক্রেনে আসার আগে পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মোরাভিয়েৎস্কি টুইট করে বলেছিলেন, ‘ইউরোপ যেন ইউক্রেনের স্বাধীনতার গ্যারান্টি দেয়। তারা যেন ইউক্রেনের পুনর্গঠনে সাহয্য করে।’ পোল্যান্ডের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, এই নেতারা ইইউ-র তরফে সাহায্যের প্যাকেজও ইউক্রেনকে দেয়ার কথা জানাবেন। কিয়েভে তাদের উপস্থিতির অর্থই হলো, ইউক্রেনকে সমর্থনের বার্তা দেয়া। তার পাশাপাশি প্যাকেজের কথাও তারা ঘোষণা করবেন।
চেক প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী ফিয়ালা টুইট করে বলেছেন, ‘এই সফরের উদ্দেশ্য হলো, ইউক্রেন এবং তাদের স্বাধীনতার প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সুস্পষ্ট সমর্থন জানানো।’ সেøাভেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী জানসাও টুইট করে বলেছেন, ‘আমাদের এই মহাদেশে ইউক্রেনের থেকে বড় ইউরোপীয় দেশ আর নেই। ইউক্রেনের মানুষ যেভাবে জীবন দিয়ে ইউরোপীয় মূল্যবোধ রক্ষা করছেন তার প্রশংসাও করতেই হবে।’
জার্মানির চ্যান্সেলর শুলৎস এ তিন প্রধানমন্ত্রীর ইউক্রেন সফরকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দিক থেকে চেষ্টা ও সাহায্য করাটা ভালো।’ তিনি জানিয়েছেন, ‘আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশ ইউক্রেনকে সাহায্য করার স্পষ্ট রাজনৈতিক নীতি নিয়েছে।’ তার মতে, ‘এখন জেলেনস্কির সঙ্গে কথা বলা যেমন দরকার, তেমনই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গেও কথা বলে তাকে যুদ্ধবিরতির জন্য উৎসাহ দেয়া দরকার।’ ইইউ-র ২৭টি সদস্য দেশ ইউক্রেনের সেনার জন্য একশ কোটি ইউরোর সামরিক সাহায্য দেয়ার ঘোষণা করেছে।
আরো নমনীয় হয়েছেন জেলেনস্কি : গত বেশ কিছুদিন ধরেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে সরাসরি আলোচনার ইচ্চা প্রকাশ করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। মঙ্গলবার তিনি তার শেষ ফেসবুক ভিডিও ভাষণে বলেছেন, ‘রাশিয়ার বিরুদ্ধে জয় পেতে গেলে ইউক্রেনের সব নাগরিককে কাজ করতে হবে। যে আলোচনাকারী দল রাশিয়ার সঙ্গে এখন কথা বলছেন, তাদেরও কাজ করে যেতে হবে।’ এই আলোচনা বুধবারও চলে। আলোচনাকে এখন অনেক বেশি বাস্তবসম্মত বললেও জেলেনস্কি তার কোনো বিশদ ব্যাখ্যা দেননি।
রাশিয়া দাবি করেছে, ইউক্রেনকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করতে হবে, তারা ন্যাটোতে যোগ দেবে না। এছাড়া দনেৎস্ক, লুহানস্ক ও ক্রাইমিয়াকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে ন্যাটোকে। জেলেনস্কি এর আগে একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, তিনি আর ন্যাটোতে যোগ দিতে ইচ্ছুক নন।
জেলেনস্কি বুধবার মার্কিন কংগ্রেসেও ভিডিও-ভাষণ দেন। এই নিয়ে একমাসের মধ্যে মার্কিন কংগ্রেসে এটা তার দ্বিতীয় ভাষণ। এর পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউক্রেনকে ৮০ কোটি ডলারের অতিরিক্ত সাহায্যের কথা ঘোষণা করতে পারেন। হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই ঘোষণা হলে, এক সপ্তাহের মধ্যে ইউক্রেনকে একশ কোটি ডলারের সাহায্য দেয়ার কথা জানাবে আমেরিকা। এদিকে মার্কিন সেনেট রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে সর্বসম্মতভাবে যুদ্ধাপরাধী বলে ঘোষণা করেছে। বলা হয়েছে, পুতিন যে ইউক্রেন আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তা নিয়ে হেগে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিন্যাল কোর্টের তদন্ত করা উচিত।
তুরস্কের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে : ইউক্রেন সঙ্কট সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখছে তুরস্ক। এর মাধ্যমে ভ‚-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যেই চলমান সঙ্কটের সমাধান খুঁজে বের করার জন্য ক‚টনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করার সাথে সাথে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু রাশিয়া এবং ইউক্রেন সফর করবেন। প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন। আঙ্কারায় প্রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্সে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকের পর এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাভুসোগলুর বুধবার রাশিয়ার রাজধানী মস্কো সফর করার কথা, তারপর যুদ্ধের একটি ক‚টনৈতিক সমাধান খোঁজার জন্য আমাদের প্রচেষ্টার সুযোগের মধ্যে ইউক্রেনে যাবেন।’
গত সপ্তাহে দক্ষিণ তুরস্কে অনুষ্ঠিত আন্টালিয়া ক‚টনীতি ফোরামের সাইডলাইনে কাভুসোগলু রাশিয়া ও ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে একটি যুগান্তকারী ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের আয়োজন করার কয়েকদিন পর এটি আসে। আন্টালিয়া ক‚টনীতি ফোরাম এবং তুরস্কে বিশ্ব নেতাদের সাম্প্রতিক সফরের বিষয়ে, এরদোগান বলেছিলেন যে, তার দেশ ক‚টনীতির একটি কেন্দ্র হিসাবে তার অবস্থানকে আরো উন্নত করছে। ‘আমি বিশ্বাস করি আন্টালিয়া ক‚টনীতি ফোরাম অংশগ্রহণকারীদের প্রোফাইল, সেখানে প্রদত্ত বার্তা এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক উন্নয়নের প্রতি আমাদের দেশের মনোভাব উভয়ের ক্ষেত্রেই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম,’ তিনি বলেছিলেন এবং ফোরামে অবদানকারী সকলকে ধন্যবাদ জানান।
‘রিকোডিং ক‚টনীতি’ থিমের অধীনে ১১-১৩ মার্চ অনুষ্ঠিত ফোরামে ৩ হাজার জনেরও বেশি লোক অংশগ্রহণ করেছিল। আনাদোলু এজেন্সি (এএ) ছিল ইভেন্টের বৈশ্বিক যোগাযোগ অংশীদার, যা ১৭টি রাষ্ট্রপ্রধান, ৮০ জন মন্ত্রী এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার ৩৯ জন প্রতিনিধি সহ ৭৫টি দেশের অংশগ্রহণকারীদের একত্রিত করেছিল। তুরস্ক এটিকে ইউক্রেনের বেসামরিক নাগরিকদের দুর্ভোগের অবসানের দায়িত্ব হিসাবে দেখে এবং এই বিষয়ে ক‚টনৈতিক যোগাযোগ স্থাপনের জন্য সচেষ্ট হয়েছে।
নরওয়েতে সামরিক মহড়া শুরু ন্যাটোর : ইউক্রেনে হামলার ঝাঁঝ বাড়াচ্ছে রাশিয়া। ক্রমে আরো ভয়ানক হচ্ছে পরিস্থিতি। এমন পরিস্থিতিতে সোমবার থেকে নরওয়েতে শুরু হয়েছে ন্যাটো গোষ্ঠীর সামরিক মহড়া। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার ২৮টি দেশ ‘কোল্ড রেসপন্স ২০২২’ নামের এই মহড়ায় অংশ নিয়েছে। ১৪ মার্চ ন্যাটো সামরিক জোটের ৩০ হাজার সেনা, ২০০টি বিমান ও ৫০টি যুদ্ধজাহাজ শুরু করেছে মহড়া। বিবিসি সূত্রে এমনটাই জানা গিয়েছে। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চলতে থাকা যুদ্ধের আবহেই এই মহড়া ঘিরে প্রশ্ন উঠছে, তবে কি এই মহড়ার মাধ্যমেই প্রচ্ছন্ন চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে ন্যাটো? তেমন সম্ভাবনা অবশ্য উড়িয়ে দিচ্ছেন সামরিক জোটের শীর্ষকর্তারা। সূত্র : এপি, রয়টার্স, বিবিসি, ডেইলি সাবাহ।