শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৯ পূর্বাহ্ন
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ::
সিটিজেন নিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে। যারা আগ্রহী আমাদের ই-মেইলে সিভি পাঠান

সর্বত্রই অর্থনৈতিক সঙ্কট

  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ৯ জুন, ২০২২
  • ১৪৬ বার পঠিত

এক সময় ‘সোনালি আঁশ’ খ্যাত পাট রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হতো। পরে ‘সাদা সোনা’ খ্যাত চিংড়ি রফতানিতে আসত প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। এখন প্রবাসী শ্রমিকদের রেমিট্যান্সের পাশাপাশি গার্মেন্ট পণ্য রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি গার্মেন্ট শিল্পে দেশের প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে গার্মেন্ট শিল্পকে ধ্বংস করতে দেশি-বিদেশি নানা অপশক্তি শ্রমিক অসন্তোষের সৃষ্টি করেছে। সফল হয়নি। তবে করোনা-পরবর্তী সময়ে যখন গার্মেন্ট শিল্প ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে তখন শুরু হয়েছে ফের শ্রমিক অসন্তোষের শঙ্কা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার পর বিশ্ব অর্থনীতি যখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে তখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। যুদ্ধ কত দিনে থামবে কেউ জানে না। বাংলাদেশের গার্মেন্ট পণ্য যারা ক্রয় করেন সেই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে চরম অর্থনৈতিক মন্দা। অর্থনৈতিক চাপে যুক্তরাজ্য দিনের খাবার কমিয়েছে; ফলে কাপড় বিক্রি কমে গেছে। সারাবিশ্ব যখন অর্থনৈতিক টানাপড়েনে তখন শ্রমিকদের বেতনভাতা বৃদ্ধির দাবিতে গার্মেন্টকে অচল করে দেয়া হবে আত্মঘাতীর নামান্তর।

জানতে চাইলে পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, বিশ্বব্যাপী সঙ্কট চলছে। বায়াররা অর্ডার কমিয়ে দিচ্ছেন। গত মাসে এক বিলিয়ন ডলার পোশাক রফতানি কম হয়েছে। সুতার দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এই সঙ্কটের কারণে এমনিতেই অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে যদি আবার বেতন বাড়ানো হয় তাহলে চরম সঙ্কটে পড়বে পোশাক শিল্প। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। তাই এখনই মজুরি বাড়ানো সম্ভব নয়। শ্রমিক আন্দোলনের বিষয়ে তিনি বলেন, যারা আন্দোলন করছে তারা শ্রমিক নামধারী বিদেশি এনজিও প্রতিষ্ঠানের লোক। তারা বিদেশি এনজিও থেকে বেতন নেন আর দেশে অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি করেন। বিদেশি ইন্ধনে শ্রমিক নামধারী কিছু লোক আন্দোলন করছে। সার্বিক বিষয় আমরা কঠোর মনিটরিং করছি। করোনা এবং যুদ্ধের কারণে গোটা বিশ্ব অর্থনৈতিক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করেছে। প্রতিটি দেশে জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেলসহ প্রতিটি খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। ফলে মানুষ খাবার কমিয়ে দিয়েছে। টিকে থাকার জন্য পোশাক- পরিচ্ছদ ক্রয়ের চেয়ে নিত্যদিনের খাবার ক্রয়ে মনোনিবেশ করছে। যুক্তরাজ্যের মতো দেশে মানুষ যখন দিনের তিন বেলা খাবারের এক বেলা কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে; তখন অন্যান্য দেশের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। শুধু খাবারই নয়; দৈনন্দিন অন্যান্য অনুষঙ্গ ব্যয়ও কমিয়েছেন। বাংলাদেশে আগাম বন্যায় হাওরে অর্ধেক ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে মানুষ চরম বিপন্নাবস্থায় জীবনযাপন করছে। অনেকেই সংসারের বাজেট কমিয়ে দিয়েছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। সারাবিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দার এই সময়ে গার্মেন্ট শিল্পে স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। শ্রমিক আন্দোলন এবং বিদেশিদের ক্রয়াদেশ কমে গেলে লোকসানের মুখে পড়তে পারে অনেক কারখানা। ফলে গার্মেন্ট মালিক ও শ্রমিকদের সমন্বিত উদ্যোগই পারে এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ মুহূর্তে গার্মেন্টস মালিক ও শ্রমিক দুই পক্ষকে ধৈর্যধারণ করে পারস্পরিক ব্লেইম গেম এবং সমন্বয়হীনতা পরিহার অপরিহার্য। শিল্পের সামগ্রিক অবস্থা, সম্ভাবনা ও সঙ্কট মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে বিজিএমইএ, শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দকে এক টেবিলে বসতে হবে। বেতন বৃদ্ধির দাবি পূরণ করা সম্ভব না হলে শ্রমিকদের খাদ্য সহায়তাসহ বিকল্প সহায়তার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকেও শ্রমিকদের অর্থ সহায়তা, টিসিবি থেকে ন্যায্যমূল্যে পণ্য সরবরাহের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। মালিক-শ্রমিকের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং পারস্পরিক কল্যাণবোধ ছাড়া টেকসই অর্থনীতি এবং স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব নয়। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বার্তাই দিয়েছেন।

মহামারি করোনা আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিপর্যস্ত বিশ্ব অর্থনীতি। করোনার বিপর্যয় কিছুটা কাটিয়ে উঠলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় চলতি বছরে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে আসবে বলে হতাশার কথা জানিয়েছে বিশ্ব আর্থিক খাতের মোড়ল সংস্থা বিশ্বব্যাংক। এর আগে মহামারি করোনার প্রকোপ কমতে থাকায় জানুয়ারিতে এক পূর্বাভাসে সংস্থাটি বলেছিল ২০২২ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ৪ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে। কিন্তু এখন বলছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে সঙ্কট দেখা দিয়েছে তাতে এই প্রবৃদ্ধি আগের পূর্বাভাসের চেয়ে ১ দশমিক ২ শতাংশ কমে ২ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে আসবে।

প্রতিবেদনে বিশ্ব অর্থনীতির হালচাল নিয়ে বলা হয়, ইউক্রেনে রাশিয়া যুদ্ধের করোনা মহামারি থেকে ক্ষতি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে, অনেক দেশ মন্দার মুখোমুখি হতে পারে। এই যুদ্ধের ফলে বিশ্ব অর্থনীতির বড় ধরনের সঙ্কট ডেকে এনেছে, যা বিশ্বের অর্থনীতিকে ছোট করে ফেলছে। দীর্ঘ সময়ের জন্য একটি ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতির’ দিকে ঠেলে দিচ্ছে বিশ্বকে। প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস বলেছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, চীনে নতুন কোভিড-১৯ লকডাউন, সরবরাহ-শৃঙ্খলে বিঘ্ন এবং স্থবিরতার ঝুঁকি, দুর্বল প্রবৃদ্ধির সময়কাল এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতিÑ সব মিলিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে অবস্থা এখন দেখা দিয়েছে, তা ১৯৭০ সালের বিশ্ব মন্দার পর আর দেখা যায়নি।

করোনার প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোগ্যপণ্য, কাঁচামাল, জ্বালানি তেলসহ প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েছে। চলমান রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্যের দাম আরো বেড়েছে। পাশাপাশি বেড়েছে জাহাজের ভাড়াও। এক আলোচনা সভায় গ্রার্মেন্ট শ্রমিকদের সতর্ক করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশে পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলনে ‘উসকানি’ দেয়া হচ্ছে। পরিবেশ অস্থিতিশীল করলে ‘একূল ওকূল’ দুটোই যাবে। আজকে বেতন বাড়া, এটা সেটাসহ নানা ধরনের আন্দোলন করতে যায়। এই রফতানি যদি বন্ধ হয়, তাহলে পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। তখন আমও যাবে, ছালাও যাবে। বেতন আর বাড়বে না, তখন চাকরিই চলে যাবে। ঘরে ফিরে যেতে হবে। তখন কী করবে? তিনি বলেন, কয়েক দিন ধরে দেখতে পাচ্ছি, গার্মেন্ট শ্রমিকরা আন্দোলন করে। আন্দোলন করে, ঠিক আছে। কিন্তু যেসব দেশ আমাদের তৈরী পোশাক কিনবে, আমরা তো নিজেরা প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছি, টাকা দিয়েছি। সরকারপ্রধান বলেন, আমি খুব খোলাখুলি বাস্তব কথাটাই বললাম। কারণ, যারা কিনবে (বিদেশি ক্রেতা), ক্রয়-ক্ষমতাও নেই। ক্রয়-ক্ষমতাও সীমিত হয়ে যাচ্ছে। দিনে দিনে আরো খারাপ হচ্ছে। আমরা আমেরিকা, ইউরোপসহ বিভিন্ন জায়গায় পোশাক পাঠাই। প্রত্যেক জায়গায় জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। সেখানে মানুষ দুরবস্থায় আছে, কত মানুষ না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। সে তুলনায় বাংলাদেশে সকলের খাদ্য, টিকা, ওষুধসহ সবকিছু দিয়ে যেতে পারছি। ইউরোপ ও আমেরিকায় মূল্যাস্ফীতি বেড়েছে, সেসব দেশে দ্রব্যমূল্যও বেড়েছে।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, পাটকে সোনালি আঁশ বলা হতো। পাট রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আসত। বিগত ১৯৮৫ সালে স্বৈরশাসক এরশাদের শাসনামলে সারাবিশ্বে বাংলাদেশের পাটের চাহিদা বেড়ে গেল। প্রতি মণ পাটের দাম দেড় শ’ দুই শ’ টাকা থেকে বেড়ে ৭ শ’ থেকে ৮ শ’ টাকা হলো। লাখ লাখ বেল পাঠ বিদেশে রফতানি হতো। দেশের একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অতিলোভে পড়ে কলাগাছ শুকিয়ে পাটের বেলের ভেতরে দিয়ে রফতানি করতে শুরু করল। বিদেশে ক্রেতাদের কাছে তা ধরা পড়ায় বাংলাদেশের পাটের চাহিদা কমে গেল। পরবর্তীতে পাটশিল্প কার্যত ধ্বংসের পর্যায়ে চলে গেছে। বিগত শতকের নব্বইয়ের দশকে ‘সাদা সোনা’ খ্যাত চিংড়ির চাহিদা বিদেশে বেড়ে যাওয়ায় চিংড়ির পেটে লোহার পেরেক ঢুকিয়ে একশ্রেণির ব্যবসায়ী বিদেশে রফতানি করতে শুরু করল। ফলে অনেক দেশ বাংলাদেশের চিংড়ি ক্রয় বন্ধ করে দিলো। ফলে বাংলাদেশ আবার হোঁচট খেল। গার্মেন্ট পণ্যের চাহিদা এখনো যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে ব্যাপক। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দাবস্থায় নিজেদের ভুলে যদি গার্মেন্টকে পাট ও চিংড়ির মতো পরিণতি ভোগ করতে হয় তাহলে দেশের অর্থনীতিতে মহাবিপর্যয় নেমে আসবে। এ বাস্তবতা বুঝে গার্মেন্ট মালিকদের যেমন দায়িত্ব রয়েছে তেমনি রয়েছে শ্রমিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। মালিকদের যেমন ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে শ্রমিকদের স্বার্থের দিকে নজর দিতে হবে; তেমনি শ্রমিকদের বুঝতে হবে নিজের কর্মক্ষেত্রে অস্থিরতা করে উৎপাদন সম্ভব নয়। বিশ্বের এই চরম অর্থনৈতিক দুরবস্থায় মালিক শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধই কেবল পারে শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ২০০৮ সালে বিশ্বজুড়ে খাদ্যমূল্য বাড়ার প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় টানাপড়েনে পড়েছিল। প্রায় দেড় দশক ধরে স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পর অর্থনীতি এখন আবার একটা অস্থিরতার দিকে পড়তে যাচ্ছে। এটাও মূলত বিশ্ব অর্থনীতির কারণেই। তবে অর্থনীতিতে এ ধরনের ঝাঁকুনি খেলেই হয়তো টেকসই প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে যে কাঠামোগত মৌলিক প্রতিবন্ধকতাগুলো আছে, সেদিকে নজর পড়ে। যেমন- আগামী দিনে আমাদের উন্নয়ন ব্যয়ে অনেক সাশ্রয়ী হতে হবে এবং রাজস্ব সংগ্রহ অবশ্যই জোরদার করতে হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved  2019 CitizenNews24
Theme Developed BY ThemesBazar.Com