সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০১:২৬ অপরাহ্ন
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ::
সিটিজেন নিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে। যারা আগ্রহী আমাদের ই-মেইলে সিভি পাঠান

প্রকৃতি নয়, মানুষ যে অজেয় সে সত্যটি প্রমাণ করেছে পদ্মা সেতু

  • আপডেট টাইম : শুক্রবার, ১ জুলাই, ২০২২
  • ১৬৫ বার পঠিত

দয়াল কুমার বড়ুয়া

পদ্মা সেতু বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের স্বপ্নের সেতু। পদ্মা সেতু শুধু একটি সেতুই নয়, এটি আমাদের উন্নয়ন, অহংকারের প্রতীক। আত্মমর্যাদা, আত্মপরিচয়, যোগ্যতা সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রত্যয়ের ফসল। একটি রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলের উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো সেই অঞ্চলগুলোর জন্য একটি উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

পদ্মা সেতু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নের একটি প্রকল্প। পদ্ম সেতুটি দেশের সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চল ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করা হবে এবং যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের সুবিধা হবে। নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্ক স্থাপনের ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে এবং দেশের শিল্পায়ন ত্বরান্বিত হবে। পর্যটন শিল্পের ব্যাপক উন্নতি হবে এবং মাওয়া ও জাজিরায় গড়ে উঠবে নতুন রিসোর্ট ও হোটেল, শপিংমল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি। মংলা ও পায়রা বন্দর চালু থাকবে, যা ব্যবহার করতে পারবে কটি প্রতিবেশী দেশ।

পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে সরাসরি তিন ধরনের পরিবর্তন আসবে। প্রথমত, এর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে। ফলে ওই অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তার লাভ করবে, বিনিয়োগ বাড়বে। দ্বিতীয়ত, কৃষক সরাসরি উপকৃত হবেন। তারা তাদের উৎপাদিত পচনশীল পণ্য রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরাসরি পাঠাতে পারবেন। ফলে পণ্যের ভালো দাম পাওয়ার মধ্য দিয়ে উৎপাদনে মনোযোগী হবেন তারা, যা আমাদের কৃষি খাতে ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে।

তৃতীয়ত, পদ্মা সেতুর মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তৃতি ঘটবে। এমন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সার্বিক নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণে যাতে কোনোরকম ঘাটতি বা ত্রুটি না হয়, এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে।

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সাহসী সিদ্ধান্ত উন্নয়ন সহযোগী ও দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গিতেও ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। বিশ্বব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগীরা বুঝতে পেরেছে পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে এসে ভুল করেছে।

নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর একটি সাহসী সিদ্ধান্ত তাকে একজন আত্মবিশ্বাসী, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, ধারাবাহিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং বিভিন্ন সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের উন্নতি আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।

পদ্মা সেতুর জন্য অপেক্ষা প্রায় দুই যুগের। ১৯৯৮ সালে প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই দিয়ে এই অপেক্ষার শুরু। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার বহুপ্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমা ধরা হয়েছিল ২০১৪ সাল। কিন্তু ‘দুর্নীতির চেষ্টার অভিযোগ’ এনে অর্থায়ন বন্ধ করে দেয় এর প্রধান অর্থায়নকারী সংস্থা বিশ্বব্যাংক। অন্যান্য দাতা সংস্থাও তাদের অনুসরণ করে; যদিও পরে প্রমাণিত হয় দুর্নীতির চেষ্টার অভিযোগটি সঠিক ছিল না। এর মাঝখানে অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের সঙ্গে জটিলতা স্বপ্নের সেতুর ভবিষ্যতই শঙ্কায় পড়ে যায়। পদ্মা সেতু প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করার ঘোষণা দেন। সে সময় দেশি-বিদেশি অনেক বিশেষজ্ঞ এ প্রকল্পের পরিণতি নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। পদ্মা সেতুর ২০১১ সালের ‘পদ্মা বহুমুখী প্রকল্প’ হিসেবে এর কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা থাকলেও পদ্মা সেতুতে পিলারের ওপর প্রথম স্প্যান বসানো হয় ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। এরপর থেকে স্বপ্নের যাত্রা শুরু। আর সব শত্রুতা, সব বিরোধিতা এবং সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে অবশেষে ২০২২ সালের জুন ২৫ তারিখ প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেন স্বপ্নের পদ্মা সেতু।

পদ্মা সেতুর মাধ্যমে রাজধানী থেকে দেশের ২১টি জেলায় যাওয়া-আসার দুয়ার উন্মুক্ত হয়েছে। ২৫ জুন আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর ২৬ জুন থেকে উন্মুক্ত হয়েছে পদ্মা সেতুর ওপর যানবাহন চলাচল। পদ্মার ওপর দিয়ে সেতু পার হওয়াকে অনেকে স্বপ্নপূরণ হিসেবেই মনে করছেন। সেতুর ওপর দিয়ে প্রথম দিনে চলাচলের সাক্ষী হওয়ার জন্য অনেকে আগে থেকে বাসের টিকিট কিনেছিলেন ঢাকা থেকে স্বজনদের কাছে যাওয়ার জন্য। আবার কেউ কেউ ২১ জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দিনটিতে ঢাকা এসেছেন কোনো কাজে কিংবা বেড়ানোর উদ্দেশে। রবিবার প্রথম দিনে বিপুলসংখ্যক মোটরসাইকেল আরোহী পার হয়েছেন পদ্মা সেতু। এদের একাংশের উদ্দেশ্যই ছিল নিছক সেতু দেখা। সেতুর ওপর দিয়ে পদ্মা পারের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা।

রাজধানী ঢাকা থেকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলাকে পৃথক করে রেখেছিল প্রমত্তা পদ্মা। ঢাকায় পৌঁছতে হলে দেশের অন্যতম দুটি নৌপথ মাদারীপুর-মুন্সীগঞ্জ, বাংলাবাজার-শিমুলিয়া এবং রাজবাড়ী-মানিকগঞ্জের দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া পার হয়েই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ ও যানবাহন ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করত। পদ্মার এপার-ওপার হতেই কেটে যেত দিন। সঙ্গে যানজটের ভোগান্তি তো ছিলই। সবকিছু অতীত করে ঢাকাসহ সারা দেশের সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার। এ সেতুবন্ধের মধ্য দিয়ে যোগাযোগব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হলো। একই সঙ্গে উন্নয়ন-অগ্রগতির পালেও লাগল হাওয়া। যোগাযোগব্যবস্থার এ অভূতপূর্ব পরিবর্তনের ফলে অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনও ঘটবে। পদ্মা সেতুর আগে চিকিৎসার উদ্দেশে ঢাকায় আসার সময় ফেরিঘাটে কিংবা ফেরিতে প্রাণ হারানোর ঘটনা অহরহ ঘটেছে। উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেশের ২১টি জেলা পিছিয়ে ছিল শুধু পদ্মা সেতুর কারণে। প্রমত্তা পদ্মাকে শাসন করা এক সময় অবিশ্বাস্য বলেই ভাবা হতো। কিন্তু প্রকৃতি নয়, মানুষ যে অজেয় সে সত্যটি প্রমাণ করেছে পদ্মা সেতু।

পদ্মা সেতুটি সমাপ্ত হওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশ দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের সাথে যুক্ত হবে। এই সেতু যোগাযোগ, বাণিজ্য, শিল্প, পর্যটন এবং অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে অবদান রাখবে। বিশেষত এটি ভুটান, ভারত এবং নেপালের সাথে বাণিজ্য ও পর্যটনের জন্য আরও দ্রুত সংযোগ স্থাপনে সহায়তা করবে।

পদ্মা সেতু পুরোপুরি চালু হয়ে গেলে বার্ষিক জিডিপিতে এটি প্রায় ১.২ শতাংশ অবদান রাখবে, দারিদ্র্য হ্রাস করবে এবং দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বাড়াবে। এটি দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিনিয়োগের দরজা খুলে দিবে এবং চট্রগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে সরাসরি বাংলাদেশের প্রধানতম স্থলবন্দর বেনাপোলের সাথে সংযুক্ত করবে।

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলটি দেশের প্রায় ২৭ শতাংশ জুড়ে এবং এ অঞ্চলে বাংলাদেশের ১৬৫ মিলিয়ন জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশ রয়েছে। ২০১১ সালের এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সমীক্ষায় দেখা গেছে, মূলত দেশের অন্যান্য অংশের সাথে যোগাযোগের অভাবে এই অঞ্চলটি স্বল্পোন্নত রয়ে গেছে। এ অঞ্চলে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় দারিদ্র্যসীমার নিচে জনসংখ্যার অনুপাত প্রায় পাঁচ শতাংশ বেশি রয়েছে।

জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) সমীক্ষায় দেখা গেছে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিলাগুলোর সাথে ঢাকার যাতায়াত সময় ১০ শতাংশ হ্রাস পেলে অর্থনৈতিক আয় ৫.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প মূল্যায়ণ দলিল অনুসারে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জিডিপির বার্ষিক বৃদ্ধি ১.৭ শতাংশ হবে এবং এতে করে জাতীয় জিডিপির বার্ষিক বৃদ্ধি হবে .০৬ শতাংশ।

পদ্মা সেতু ছাড়াও, দেশে বর্তমানে ঢাকা মেট্রো রেল, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল (এইচএসআইএ) এবং যমুনা নদীর উপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে ব্রিজ সহ বেশ কয়েকটি মেগা অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।

পরিশেষে বলছি, একজন শেখ হাসিনা আছেন বলেই পদ্মা সেতু হয়েছে। সঠিক রাজনৈতিক ও সাহসী নেতৃত্ব যে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে সেটি জাতির পিতার সুযোগ্যকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেখিয়ে দিয়েছেন। পদ্মা সেতু শুধু একটি সেতু নয়, বিশ্ববেনিয়াদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের এবং সবার ওপরে শেখ হাসিনার সক্ষমতার প্রতীক হচ্ছে পদ্মা সেতু।

লেখক: কলামিস্ট ও রাজনীতিবিদ, কো-চেয়ারম্যান জাতীয় পার্টি।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved  2019 CitizenNews24
Theme Developed BY ThemesBazar.Com