এক যুগ আগে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ শব্দটির ব্যবহার ব্যাপক হলেও এখন শুরু হচ্ছে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ শব্দটির প্রচলন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা হবে’ বক্তব্যের পর এ শব্দটির ব্যবহার বহুগুণে বেড়ে যায়। সরকারের মন্ত্রী-এমপি, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, অনুগত ও সুবিধাবাদী আমলারা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ শব্দটা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতে শুরু করেন। এমনকি কিছু বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিকরা স্মাট কবিতা-গল্প লেখা শুরু করেছেন। বক্তৃতা-বিবৃতিতে স্মার্ট শব্দটি বেশি ব্যবহার করছেন। কিন্তু প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারে এখনো পুরোপুরি ডিজিটাল হয়নি। অর্ধেক ডিজিটালের মধ্যেই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা এসেছে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে চাইলে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা, সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কোয়ালিটি সেবা প্রদান নিশ্চিত করাসহ ইন্টারনেটের গতি বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন তারা।
২০০৮ সালে নির্বাচনের আগে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দিয়েছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সে লক্ষ্যে গত ১৪ বছরে অনেকদূরই এগিয়েছে। তবে সর্বক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহারসহ ডিজিটালের যেসব লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিপূর্ণ অর্জন করতে পারেনি সরকার। এখনো সড়কে টোল আদায়, ট্রাফিক সিস্টেম, নাগরিক বিভিন্ন সেবায় লাগেনি প্রযুক্তির ছোঁয়া। দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে গ্রাহকরা টু-জি গতির ইন্টারনেটের অভিজ্ঞতা পাচ্ছেন, কলড্রপ কমাতে কিংবা দ্রæতগতির নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সেবা দিতে সক্ষম হয়নি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। ডিজিটাল ক্ষেত্রে বিভিন্ন সূচকে উন্নত দেশ তো দূরের কথা দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে অনেক পেছনে বাংলাদেশ। এমন অবস্থায় ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। তবে প্রযুক্তি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্ধেক ডিজিটালের ওপর ভিত্তি করে স্মার্ট বাংলাদেশের প্রস্তুতি চলছে।
২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাঁর সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে ডিজিটাল থেকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশে’ রূপান্তরে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা আগামী ৪১’ সালে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলব। আর সেই বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে আমরা চলে যাব। সরকার ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার চারটি ভিত্তি সফলভাবে বাস্তবায়নে কাজ করছে। এগুলো হচ্ছে-স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি। এর আগে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার রূপকল্প ঘোষণা করেছিল, তার আওতায় ২০১৮ সালে এসে সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য ঠিক করা হয়। লক্ষ্যের একটি ছিল ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে সড়কে টোল আদায়ের কাজটি স্বয়ংক্রিয় করা, যাতে যানবাহনকে থামতে না হয়। অথচ এখনো একটি সড়কেও এই ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) অথবা ইন্টারনেট অব এভরিথিংভিত্তিক (আইওই) স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু হয়নি। ঈদের ছুটির সময় মহাসড়ক ও সেতুতে টোল দিতে যানবাহনের জট লেগে যায়। রাজধানীসহ বড় শহরগুলোর ট্রাফিক সিস্টেম এখনো চলছে সেই হাত দিয়ে গাড়ি থামানো কিংবা হাত নাড়িয়ে সিগন্যাল ওপেন করার। জন্মনিবন্ধন, ড্রাইভিং লাইসেন্স, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ অনেক কাজই কেবল অনলাইনে ফরম পুরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। দেশের ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগই এখনো চলছে কাগজে-কলমে, যেটুকু প্রযুক্তির ছোয়া দেয়ার চেষ্টা হয়েছে সেটুকুতেই সার্ভার ডাউনের নামে ঘটছে গ্রাহক ভোগান্তির ঘটনা। ২০২১ সালে পরীক্ষামূলকভাবে ফাইভ-জি উদ্বোধন করা হলেও নেই কোনো অগ্রগতি। শহরাঞ্চলের বাইরে সর্বত্রই ফোর-জি কাভারেজ থাকলেও টু-জি অভিজ্ঞতা পাচ্ছেন মোবাইল ফোন গ্রাহকরা। ব্রডব্যান্ড সেবাও-এর ব্যতিক্রম নয়, বৈধ ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি) লাইসেন্স ২ হাজার ৮৪৯টি থাকলেও অবৈধভাবে সেবা দিচ্ছে ৩০ হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান। যার সবগুলোই ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায়। এসব আইএসপি একটি সংযোগের ডাটা দিয়ে সেবা দিচ্ছে ৩ থেকে ৫ জনকে। ফলে ইন্টারনেটের যে অভিজ্ঞতা পাওয়ার কথা তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে গ্রাহকরা। যাদের এসব বিষয় দেখভালের দায়িত্ব সেই নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বিটিআরসি গ্রাহক সেবা নিশ্চিতের পরিবর্তে রাজস্ব কালেক্টরের ভ‚মিকাতেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে মনে করেন ভ‚ক্তভোগিরা।
ডিজিটাল বাংলাদেশ ও স্মার্ট বাংলাদেশ রূপকল্প নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের প্রফেসর বি এম মইনুল হোসেন বলেন, মোটাদাগে বলা যায় বাংলাদেশ আধা ডিজিটাল হয়েছে। একটি ফর্ম অনলাইনে পূরণ করার সুযোগ তৈরি হলেই তাকে পুরো ডিজিটাল ব্যবস্থা বলা যায় না। স্মার্ট বাংলাদেশ করতে গেলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), রোবোটিকস, আইওটি ও সাইবার নিরাপত্তা হবে মূল বিষয়। এর জন্য শুধু অবকাঠামো দিয়েই হবে না, দক্ষ মানবসম্পদ সমানতালে গড়ে তুলতে হবে।