শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধন হবে শনিবার (৭ অক্টোবর)। সকাল ১০টায় জমকালো আয়োজনে টার্মিনালের স্বল্প পরিসরে উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ উপলক্ষে তৃতীয় টার্মিনালে মঞ্চ তৈরিসহ যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।
এদিকে থার্ড টার্মিনালের উদ্বোধনীতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট আকাশে উড়ে যাবে, আর সেই ফ্লাইটের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংও করবেন বিমানের কর্মীরা। যদিও বেবিচক জাপানি প্রতিষ্ঠানকে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং করার জন্য নিয়োগ দেয়ার কথা জানিয়েছে। তবে টার্মিনাল উদ্বোধনের দিন নিজেদের সক্ষমতার প্রমাণ করতে চায় বিমান কর্তৃপক্ষ।
বেবিচক সূত্র জানায়, উদ্বোধনী যাত্রায় বিমানের নেপালগামী একটি ফ্লাইট তৃতীয় টার্মিনাল ব্যবহার করে উড়াল দেবে। এর জন্য শেষ সময়ে সবকিছু যাচাই করার কাজ চলছে। বিভিন্ন যন্ত্রপাতির হয়েছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। উদ্বোধনী ফ্লাউট পরিচালনায় যুক্তদের জন্য নতুন ইউনিফর্মেরও ব্যবস্থা করেছে বিমান।
থার্ড টার্মিনালের মাধ্যমে সহজ ও স্বল্প সময়েই ইমিগ্রেশন করতে পারবেন যাত্রীরা। দেশে প্রথম অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। নতুন টার্মিনালটি এভিয়েশন শিল্পে গেম চেঞ্জার হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
নয়া প্রযুক্তি সংবলিত তৃতীয় টার্মিনাল এখন শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। মনোমুগ্ধকর নির্মাণশৈলিতে আকাশপথের যাত্রী ও বিভিন্ন দেশের এয়ারলাইন্সকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। যেখানে পৌঁছাতে থাকবে না কোনো ভোগান্তি।
থাকছে যেসব সুবিধা
বেবিচক সূত্র জানিয়েছে, নতুন টার্মিনালে নানা সুবিধা দেয়ার জন্য ২৬টি বোর্ডিং ব্রিজ, ১১৫টি বহির্গমন চেক-ইন কাউন্টার, ১০টি স্বয়ংক্রিয় পাসপোর্ট নিয়ন্ত্রণ কাউন্টার থাকবে।
এছাড়া ৬৬টি বহির্গমন ইমিগ্রেশন কাউন্টার, ৫টি স্বয়ংক্রিয় আগমনী চেক-ইন কাউন্টারসহ মোট ৫৯টি কাউন্টার, ১৬টি ব্যাগেজ বেল্ট, ২৭টি হোল্ড ব্যাগেজ স্ক্যানিং মেশিন, ৪০টি কেবিন ব্যাগেজ স্ক্যানিং মেশিন থাকবে।
৫২টি মেটাল ডিটেক্টর, ১১টি বডি স্ক্যানার মেশিন ছাড়াও টার্মিনালে থাকছে হাজারের বেশি গাড়ি পার্কিং করার মাল্টিলেভেল কার পার্কিং। এখানে ১ হাজার ৪৪টি গাড়ি পার্ক করে রাখা যাবে।
পাঁচ লাখ ৪২ হাজার বর্গমিটার আয়তনের নতুন টার্মিনাল চালু হলে একসঙ্গে ৩৭টি উড়োজাহাজ পার্ক করে রাখা যাবে এখানে।
তৃতীয় টার্মিনালের নিচতলায় থাকবে ব্যাগেজ হ্যান্ডলিং সিস্টেম। দ্বিতীয় তলায় থাকবে বহির্গমন লাউঞ্জ, ক্যানটিন ও বোর্ডিং ব্রিজ। এ ছাড়াও থাকবে সুপরিসর ডিউটি ফ্রি দোকান ও বহির্গমন লাউঞ্জ।
বহির্গমনের জন্য স্বয়ংক্রিয় চেক-ইন কাউন্টার থাকায় যাত্রীরা নিজেরাই ইমিগ্রেশন করাতে পারবেন। এজন্য তাদের পুলিশের মুখোমুখি হতে হবে না।
বেবিচক সূত্র জানায়, এই টার্মিনালে লাগানো স্ক্যানিং মেশিনগুলো অত্যাধুনিক। যারা লাগেজ দেবেন সেগুলো অটো স্ক্যান হবে। এগুলো আগের মেশিনগুলো থেকে আরও বেশি আধুনিক। যাত্রীদের চলাচলের সুবিধার্থে টার্মিনালে মুভওয়াকার (হাঁটার জন্য চলন্ত রাস্তা) রয়েছে। আর এগুলো থাকছে পুরো টার্মিনালজুড়ে। ফলে যাত্রীকে হাঁটতে তেমন বেগ পেতে হবে না। যা থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুর বিমানবন্দরগুলোতে দেখা যায়।
টার্মিনালটির ভবনের যাবতীয় কার্যক্রম চালাতে দিনে কোনো বিদ্যুৎ লাগবে না। বাড়তি বাতির প্রয়োজন হবে না। এজন্য ভবনটির চারপাশে গ্লাস বসানো হয়েছে এবং ওপরের দিকে স্কাই লাইট রাখা হয়েছে, যাতে সহজে দিনের আলো আসে সেই ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।
সিভিল এভিয়েশন চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান বলেন, এ ধরনের প্রযুক্তি আগে আমাদের দেশে ছিল না, এটাই প্রথম। ফলে সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে যেমন যাত্রীরা উপকৃত হবে, তেমনি বিমান পরিচালনা সংস্থাগুলোর কাছেও ঢাকা এক নির্ভরযোগ্য প্ল্যাটর্ফম হবে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ নাফিজ ইমতিয়াজ উদ্দিন বলছেন, প্রবাসী বাংলাদেশি ও বিদেশিদের কাছে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন তুলে ধরার প্রথম দৃশ্যপট হবে শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল।
তিনি বলেন, প্রবাসীরা যখন বিদেশে যান, এমন উন্নতমানের প্রযুক্তি দেখে, সেবা পায়। তখন আমাদের দেশের অবস্থা দেখে আফসোস করতেন আর আমাকে বলতেন স্যার, আমাদের দেশে এমন কবে হবে। যখন আমাদের দেশে এমন কিছু হয়, তখন ওরা ওই দেশের সহকর্মীদের গর্ব করে বলে আমাদের দেশেও এমন একটা হয়েছে।
তৃতীয় টার্মিনালের মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশিদের দীর্ঘ দিনের প্রত্যাশা পূরণ হবে। বিশ্ব দরবারে সৃষ্টি হবে নতুন গল্পের। এটা প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ মুখ উজ্জ্বল করবে বলেই মত এই এভিয়েশন বিশেষজ্ঞের।
এদিকে শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে যাত্রীরা উন্নতমানের সেবা পাবেন বলে জানিয়েছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহমুদ আলী। তিনি বলেন, তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধনের পর পাল্টে যাবে বিমানবন্দরের চিত্র।
প্রকল্পের খরচ
শাহজালালের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায় ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর। সে সময় ব্যয় ধরা হয় ১৩ হাজার ৬১০ কোটি টাকা। পরে আরও ৭ হাজার ৭৮৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বাড়িয়ে প্রকল্পের আকার দাঁড়ায় প্রায় ২১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। নতুন করে তিন হাজার কোটি টাকা বাড়লে প্রকল্পের ব্যয় হবে ২৪ হাজার কোটি টাকার বেশি।
খরচের বেশিরভাগ আসছে জাপানি সহযোগিতা সংস্থা জাইকার কাছ থেকে। সংস্থাটি ঋণ হিসেবে দিচ্ছে ১৬ হাজার ১৪১ কোটি ২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। বাকি ৫ হাজার ২৫৮ কোটি ৩ লাখ ৮৮ হাজার টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার।
প্রকল্পের আয়তন
বর্তমানে শাহজালালে যে দুটি টার্মিনাল রয়েছে তা এক লাখ বর্গমিটার জায়গার ওপর। তৃতীয় টার্মিনালটি বর্তমান দুটি টার্মিনালের দ্বিগুণের বেশি। ভবনটির আয়তন ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার।
এটির নকশা করেছেন এনওসিডি-জেভি জয়েন্ট ভেঞ্চার পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের আওতাধীন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সিপিজি করপোরেশন প্রাইভেট লিমিটেডের (সিঙ্গাপুর) স্থপতি রোহানি বাহারিন, যিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনালের নকশা করে বিশ্বে খ্যাতি কুড়িয়েছেন।
থার্ড টার্মিনালটির ভবন হবে তিনতলা। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয় এর নির্মাণকাজ। এভিয়েশন ঢাকা কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে জাপানের মিত্সুবিশি ও ফুজিটা এবং কোরিয়ার স্যামসাং এই তিনটি প্রতিষ্ঠান থার্ড টার্মিনাল ভবন নির্মাণকাজ করছে।