অনলাইন ডেস্ক: দেশের ৫০ লাখ হতদরিদ্র পরিবারের মাঝে এককালীন আড়াই হাজার টাকা বিতরণ কর্মসূচিতে সুবিধাভোগী নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ৫০ লাখ সুবিধাভোগীর এই তালিকার সাড়ে ৪২ লাখ নাম নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমেদ কায়কাউস সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ৫০ লাখ সুবিধাভোগীর এই তালিকা থেকে তারা সাড়ে সাত লাখ নাম প্রশ্নের ঊর্ধ্বে পেয়েছেন। তার মানে বাকী সাড়ে ৪২ লাখ পুরোটাই প্রশ্নবিদ্ধ। যার মধ্যে নানা অনিয়ম অসঙ্গতি ধরা পড়ায় শুরুতেই তালিকা থেকে ১০ লাখ নাম বাতিল হয়ে গেছে। নাম , মোবাইল নম্বর,পেশা, জাতীয় পরিচয়পত্রে অসঙ্গতি থাকায় আরও বাতিল হবে বলে মুখ্য সচিব জানিয়েছেন।
মোবাইল ব্যাংকিং পরিষেবা ব্যবহার করে সুবিধাভোগীদের হিসাবে সরাসরি এই নগদ অর্থ বিতরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কিন্ত এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ জনপ্রতিনিধিসহ তালিকা তৈরির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা নানা অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে গোটা বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে। দুর্নীতিবাজ অনেক জনপ্রতিনিধি উপকারভোগীদের নামের সামনে নিজের বা আত্মীয়-স্বজনের মুঠোফোন নম্বর দিয়েছেন। কোথাও কোথাও দেখা গেছে একশ’ জন কিংবা দেড়শ’ জন উপকার ভোগীর নামের সামনে একই মোবাইল নম্বর দেয়া হয়েছে। হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার এক ইউনিয়নে ৩০৬ জন উপকারভোগীর নামের সামনে মাত্র ৩ টি নম্বর দেয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও বিত্তশালী এমনকি ভুয়া, মৃত ব্যক্তির নামও তালিকায় রয়েছে। হবিগঞ্জ,বাগেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় একই কাণ্ড ঘটেছে। করোনা মহামারির মধ্যে অসহায় হয়ে পড়া মানুষদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নগদ প্রণোদনা নিয়ে এমন কেলেঙ্কারি সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। এমন অবস্থায় ৫০ লাখের ওই তালিকা সংশোধন করে আবারও নতুন করে পাঠাতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ৫০ লাখ পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে নগদ টাকা দেয়ার জন্য যে তালিকা করা হয়েছিল তাতে প্রথম দফায় মাত্র সাড়ে সাত লাখ হতদরিদ্রের নাম টিকেছে। এ ছাড়া অর্ধকোটি নামের তালিকা থেকে শুরুতেই ১০ লাখ নাম বাদ পড়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন,ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ লাখ পরিবারকে নগদ সহায়তা দিতে যে তালিকা এসেছিল, তার অন্তত ১৬ শতাংশে একই মোবাইল নম্বর একাধিকবার ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি জানান, আইসিটি বিভাগ যাচাই করে দেখেছে তালিকার ১৫-১৬ শতাংশ সুবিধাভোগীর নামের সঙ্গে একই মোবাইল নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে। এই অসঙ্গতি থাকার ফলে প্রধানমন্ত্রী যে কয়েকজনের মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়েছিলেন তার বাইরে এখনও অন্য সুবিধাভোগীদের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো হয়নি। এমন পরিস্থিতে দ্রুত ওই তালিকা সংশোধন করে পাঠাতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশে দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। একইসঙ্গে যাদের মোবাইল নেই তাদের সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়ে সেখানে টাকা পাঠানো হবে।
মন্ত্রণালয় থেকে সংশোধিত তালিকা চেয়ে যে চিঠি দেওয়া হয়েছে সেখানে লেখা হয়েছে, “মুজিব বর্ষে ‘করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ লক্ষ পরিবারের মধ্যে’ নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান কর্মসূচি সংক্রান্ত নির্দেশিকায় ভাসমান মানুষ, নির্মাণ শ্রমিক, গণপরিবহন শ্রমিক, রেস্টুরেন্ট শ্রমিক, ফেরিওয়ালা, রেলওয়ে কুলি, মজুর, ঘাটশ্রমিক, নরসুন্দর, দিনমজুর, রিকশা/ভ্যানগাড়িচালক এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের লোকসহ মানবিক সহায়তা পাওয়ার যোগ্য পরিবারবর্গ এবং যারা দৈনিক আয়ের ভিত্তিতে জীবিকা নির্বাহ করে এ রকম জনগোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করা হয়। এই পেশাভিত্তিক লোকজন যারা বাদ পড়েছেন তাদের অন্তর্ভুক্ত করে তালিকা চূড়ান্ত করতে হবে।”
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, অনিয়ম-অসঙ্গতি থাকায় তালিকাটি সংশোধন করা হচ্ছে। মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, খুব দ্রুত তালিকাটি সংশোধন করে ঈদের আগেই উপকারভোগী সবার হাতে এই টাকা তুলে দেওয়া হবে। যাদের মোবাইল নম্বর নেই, তাঁরা ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খুলে সেই হিসাব নম্বরে টাকা পাবেন।
সরকারের সূত্র জানিয়েছে, অনিয়ম ঠেকাতে ডিজিটাল কার্ডের মাধ্যমে এই সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান বলেছেন, অনেকের টাকা ছাড় করা যাচ্ছে না। যে ব্যবস্থায় টাকা দেওয়া হচ্ছে তাতে একজনের জন্য কেবল একটি মোবাইল নম্বরই ব্যবহার করার সুযোগ আছে। এখন সিদ্ধান্ত হয়েছে যাদের মোবাইল নম্বর নেই তাদের ব্যাংক হিসাব খুলে তাতে এই টাকা দেওয়া হবে। মাঠ প্রশাসনকে তালিকা সংশোধন করে দ্রুত পাঠাতে বলা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর এই নগদ প্রণোদনায় কেলেঙ্কারির আগেও করোনাভাইরাস সংকটের মধ্যেই ত্রাণের চাল আত্মসাতের অভিযোগে গ্রেপ্তার ও সাময়িকভাবে বরখাস্ত হয়েছেন বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধি। অনেক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে অসহায়, দরিদ্রদের রেখে নিজের সমর্থক স্বচ্ছল ব্যক্তিদের ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার।
করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট দুর্যোগে বিপদে পড়া ৫০ লাখ পরিবারকে ত্রাণের পাশাপাশি প্রত্যেককে সরকারের পক্ষ থেকে আড়াই হাজার করে নগদ টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই খাতে বরাদ্দ আছে এক হাজার ২৫০ কোটি টাকা। তবে ত্রাণে লুটপাট হলেও এবার নগদ প্রণোদনা দিতে কড়া পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমরা এই কর্মসূচির নাম দিয়েছি ‘জি টু বি’ অর্থাৎ গভর্নমেন্ট টু বেনিফিশিয়ারি বা সরকার থেকে সুবিধাভোগী। এর মাঝখানে কেউ ঢুকতে পারবে না। সরকারের কাছ থেকে সুবিধাভোগীর মোবাইল ফোনে টাকাটা চলে যাবে। এই টাকা তুলতে যে খরচ তা মোবাইল কোম্পানিগুলোকে সরকার পরিশোধ করবে।’
তিনি বলেন, ‘কিছু গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের খবর থেকে মনে হবে যে, তালিকা পাঠালেই তা অনুমোদন হয়ে যাচ্ছে। আসলে বিষয়টি মোটেও তা নয়।’ সচিব জানান, বিশেষভাবে তৈরি একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই তালিকা যাচাই-বাছাই হচ্ছে। এখানে অনিয়মের সুযোগ নেই। তাঁর মতে, ত্রুটিপূর্ণ নাম সফটওয়্যারে চিহ্নিত হবে এবং এগুলো ধরা পড়ায় ঢালাওভাবে টাকা দেওয়া হচ্ছে না।
একজন সুবিধাভোগীকে তিনটি উপায়ে প্রমাণ করতে হবে যে, তিনি সঠিক ব্যক্তি। প্রথম হচ্ছে, তার জাতীয় পরিচয়পত্র, দ্বিতীয় হচ্ছে, তাঁর মোবাইল নম্বর এবং তৃতীয় হচ্ছে তার নাম। একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে পুরো কাজটি সম্পন্ন করা হচ্ছে। এই তিনটি তথ্যে গরমিল পাওয়া গেলে তার নাম বাদ পড়বে। এখানে কারও চেষ্টা বা তদবিরের সুযোগ থাকছে না।
সংবাদমাধ্যমকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব বলেন, ধরা যাক একজন জনপ্রতিনিধি একাধিক নামের বিপরীতে একটি মোবাইল নম্বর দিয়েছে। কিন্তু সফটওয়্যার একটির বেশি মোবাইল নম্বর নেবে না। আবার যাদের নাম সুবিধা প্রত্যাশী হিসেবে এসেছে, তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রে নাম ও পেশা উল্লেখ আছে এবং এই পরিচয়পত্র ন্যাশনাল ডেটাবেইস সংযুক্ত রয়েছে। সফটওয়্যার সেসব তথ্য কিন্তু সহজেই পেয়ে যাচ্ছে। তাই তালিকা পাঠালেই নগদ টাকা চলে যাবে, এমনটি ভাবার কারণ নেই। তারপরও যদি কেউ অনিয়মের চেষ্টা করে তাহলে রেহাই পাবে না। কারণ এই রেকর্ডগুলো কিন্তু সরকারের কাছে রয়ে গেল। এটা খতিয়ে দেখারও সুযোগ থাকছে।