বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। আমদানি-রফতানি প্রতিটি দেশের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে কিছু কিছু সময় আমদানি-রফতানির ওপর লাগাম টানতে হয়। দেশ ডলার সঙ্কটের কবলে পড়ে সরকার বিলাসবহুল ও বিদেশি ১৩৫ পণ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কারোপ করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। চাল, তেল, ওষুধের মতো পণ্য আমদানি অপরিহার্য। কিন্তু প্রসাধন পণ্য, বিদেশি ফার্নিচার, ফলফলাদি ইত্যাদি ভোগের জন্যই আমদানি হয়ে থাকে। বিশেষ করে কিছু ফল ও বিদেশি ফার্নিচার আমদানি বিলাসী মানসিকতা হিসেবে ধরে নেয়া হয়। ডলার খরচ করে এমন পণ্য আমদানিতে নিরুৎসাহী করতেই শুল্ক বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমদানির চাপ কমাতে বিলাসপণ্য আমদানির ঋণপত্র খোলা বন্ধ করা একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এমনকি যেসব ঋণপত্র খোলা হয়েছে, তাও বাতিল করতে হবে। যেসব খাদ্য, ফল ও অন্যান্য পণ্য দেশে উৎপাদিত হচ্ছে, আপাতত সেসব পণ্য আমদানি বন্ধ করা অপরিহার্য।
অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে আমদানি ব্যয়। বাণিজ্য ঘাটতি ইতোমধ্যে ২৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক বাড়ায় চাপের মুখে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। পাশাপাশি দেখা দিয়েছে ডলার সঙ্কট। ডলারের বিপরীতে টাকার মান প্রতিদিনই কমেছে। সর্বশেষ গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তঃব্যাংক বিনিময় হার প্রতি মার্কিন ডলার ৪০ পয়সা বাড়িয়ে ৮৭ দশমিক ৯০ টাকা নির্ধারণ করে। এ নিয়ে চলতি বছরে এ পর্যন্ত ৬ বার টাকার অবমূল্যায়ন করল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ইতিহাসের রেকর্ড ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায় প্রতি ডলারের দাম। এমনকি ১০২ টাকাতেও ডলার কেনার ঘটনা প্রকাশ পায়। আর তাই দীর্ঘদিন ধরেই দেশের আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা আমদানি ব্যয় কমানোর পরামর্শ দিয়ে আসছেন।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত মাসে এক সভায় সরকারি বা বেসরকারি খাতে বিলাসবহুল পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলেছেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, আমদানি নিয়ন্ত্রণে সবসময় পদক্ষেপ নেয়া হয়। আমদানি তো নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে, এটা ওপেন নয়। তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা বিদ্যমান থাকায় বিলাসবহুল সামগ্রী নিয়ন্ত্রণ করা হবে। যখন অতিরিক্ত দুর্বলতা থাকবে না, আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো বিপজ্জনক কারণ থাকবে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এসব পণ্য আমদানির অনুমতি দেয়া হবে। এরপর গত ১১ এপ্রিল ব্যাংকগুলোকে অত্যাবশ্যকীয় নয় এমন ভোগ্যপণ্যের জন্য ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ অগ্রিম অর্থ পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু, বাংলাদেশ ব্যাংকের এই উদ্যোগ আমদানি বৃদ্ধি রোধ করতে ব্যর্থ হয়। পরে গত ১০ মে বিলাসবহুল গাড়ি ও হোম অ্যাপ্লায়েন্স হিসেবে ব্যবহৃত ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিকস পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ঋণপত্র খোলার সময় ব্যাংকগুলোকে আমদানিকারকদের কাছ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত (উচ্চ মার্জিন আরোপ) অগ্রিম অর্থ নেয়ার কঠোর নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে অতি জরুরি পণ্য ছাড়া অন্য সকল পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করার নির্দেশ দেয়। এই ধারাবাহিকতায় গত রোববার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের আবারও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সঙ্গে বৈঠকে বসে কঠোর নির্দেশনা দেন। এরপর সোমবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা রহমাতুল মুনিম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের চাপ ও আমদানি প্রবণতা কমাতে ও দেশীয় পণ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিলাসবহুল ও বিদেশি ১৩৫ পণ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) আরোপ করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত আরোপ করা হয়েছে। গতকাল এনবিআরের জনসংযোগ দফতর প্রজ্ঞাপনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
ডলার নিয়ে একই সমস্যায় পড়েছিল শ্রীলঙ্কা। কিন্তু সমাধানে হাত দেয়নি সময়মতো। তাই আগেভাগে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বাজারে ডলারের সঙ্কট দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা। আমদানির লাগাম টেনে ধরা ছাড়া ডলারের বাজার স্বাভাবিক হবে না বলে ইতোমধ্যে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন তারা। এছাড়াও পণ্য আমদানির ঋণপত্রে (এলসি) ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে বিদেশে অর্থপাচার করছে একটি চক্র। দামি পণ্য আমদানির কথা বলে নিয়ে আসছেন অনেক কম দামি পণ্য। এভাবে চক্রটি বিদেশে টাকা পাচার করছে। ভুয়া এলসির নামে অর্থপাচার রোধে পদক্ষেপ নেয়ার কথাও বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই সরকারের আমদানিতে লাগাম টানার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।