আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ গেল অক্টোবরেই শততম জন্মদিন পালন করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৯তম প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। বয়সের সেঞ্চুরি হাকানোর পর অবশ্য বেশিদিন থাকা হলো না এই পৃথিবীতে। স্ত্রী রোজালিনকে হারানোর এক বছরের মাথায় জীবনের হিসাব চুকিয়ে তিনিও পাড়ি জমালেন অনন্তে। রোববার (২৯ ডিসেম্বর) স্থানীয় সময় বিকেলে জর্জিয়ার প্লেইনস শহরে নিজ বাড়িতে মৃত্যু হয় কার্টারের।
জিমি কার্টার যুক্তরাষ্ট্রের ৩৯তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনিই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সাবেক প্রেসিডেন্ট কার্টারকে “নীতিবান, বিশ্বাসী ও বিনয়ী” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আর সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও তার স্ত্রী হিলারি ক্লিনটন জিমি কার্টারের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, “কার্টার জীবনভর মানুষের সেবা করে গেছেন।”
এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশও কার্টারের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন। ডেমোক্র্যাটিক পার্টি থেকে নির্বাচিত জিমি কার্টার ক্ষমতায় এসেছিলেন আমেরিকান জনগণের কাছে কখনও মিথ্যা না বলার অঙ্গীকার করে।
আলোচিত ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির পর জর্জিয়ার সাবেক এই বাদাম চাষিই যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কোনও নেতা যিনি জলবায়ু পরিবর্তনকে গুরুত্ব সহকারে নিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিসর ও ইসরায়েলের মধ্যে ঐতিহাসিক চুক্তির মধ্যস্থতা করেছেন তিনি।
তবে ইরান জিম্মি সংকট নিয়ে চুক্তি করতে এবং আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন ঠেকাতে সংগ্রাম করতে হয়েছে তাকে। এক মেয়াদের দায়িত্ব পালনের পরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রোনাল্ড রিগ্যানের কাছে হেরে গিয়েছিলেন তিনি। তবে হোয়াইট হাউস থেকে বিদায়ের পর তিনি তার সুনাম পুনরুদ্ধারে মনোযোগী হন।
এরপর থেকে তিনি শান্তি, পরিবেশ ও মানবাধিকার বিষয়ে বিরামহীনভাবে কাজ করে গেছেন। এ কারণেই তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।
জন্ম, শৈশব আর রাজনীতিতে প্রবেশ
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের মধ্যে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সময় বেঁচে থাকা জিমি কার্টার গত অক্টোবরেই তার একশোতম জন্মদিন পালন করেন। তিনি ক্যান্সারের জন্য চিকিৎসা নিচ্ছিলেন এবং গত ১৯ মাস হাসপাতালেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।
জেমস আর্ল কার্টার জুনিয়র ১৯২৪ সালের পহেলা অক্টোবর জর্জিয়ার ছোট শহর প্লেইনসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাবা মায়ের চার সন্তানের মধ্যে তিনিই বড়। তার বাবা পারিবারিক ব্যবসা হিসেবে বাদাম চাষ করতেন, আর তার মা লিলিয়ান ছিলেন একজন নার্স। স্কুলজীবনে তিনি ছিলেন একজন তারকা বাস্কেটবল খেলোয়াড়।
পরে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীতে সাত বছর কাজ করে সাবমেরিন কর্মকর্তা হয়েছিলেন। সেসময়েই তার বন্ধুর বোন রোজালিনকে বিয়ে করেন। তবে, ১৯৫৩ সালে বাবার মৃত্যুর পর তিনি পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরতে ফিরে আসেন।
তার রাজনীতিতে প্রবেশ হয়েছিল একেবারে তৃণমূল থেকে। জর্জিয়ার সিনেটর নির্বাচনের আগে তিনি ধারাবাহিকভাবে স্থানীয় স্কুল ও লাইব্রেরী বোর্ডের নির্বাচনগুলোতে জয়ী হয়েছিলেন। দুই দফায় সিনেটর হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। এরপর ১৯৭০ সালে জর্জিয়ার গভর্নর হন। এ সময় তিনি প্রকাশ্যেই নাগরিক অধিকারের পক্ষে আরও বেশী কথা বলতে শুরু করেন।
তার শপথ অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, “আমি পরিষ্কারভাবেই বলতে চাই বর্ণ বৈষম্যের সময় পার হয়ে গেছে”। তিনি ক্যাপিটল ভবনে মার্টিন লুথার কিংয়ের ছবি স্থাপন করেন এবং আফ্রিকান আমেরিকানরা যেন সরকারি অফিসে নিয়োগ পান তা নিশ্চিত করেন।
১৯৭৪ সালে তিনি যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারাভিযান শুরু করেন তখন আমেরিকা উত্তাল ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি নিয়ে। এ সময় তিনি নিজেকে পেশাদার রাজনীতিকের চেয়ে একজন বাদাম চাষি হিসেবেই তুলে ধরেন।
শুরুতে জনমত জরিপগুলো ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে তার মাত্র চার শতাংশ সমর্থনের কথা বললেও শেষ পর্যন্ত নয় মাস পর তিনি রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডকে হারিয়ে দেন। দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনেই তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসা হাজার হাজার ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দেন।
রিপাবলিকান সমালোচক সিনেটর ব্যারি গোল্ডওয়াটার এটিকে ‘একজন প্রেসিডেন্টের জন্য সবচেয়ে লজ্জাজনক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। কার্টারও স্বীকার করেছিলেন, এটা ছিল তার জন্য খুবই কঠিন একটি সিদ্ধান্ত। তিনি তার প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীদের নিয়ে এসেছিলেন।
তিনিই প্রথম কোনও বিশ্বনেতা যিনি জলবায়ু পরিবর্তনকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি হোয়াইট হাউসের ছাদে সোলার প্যানেল বসিয়েছিলেন যা পরে রোনাল্ড রিগ্যান সরিয়ে ফেলেন। তার সময়ে আমেরিকার অর্থনীতি মন্দাবস্থায় পড়ে এবং এ কারণে তার জনপ্রিয়তাতেও ধস নামে।
তিনি সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার পরিকল্পনা করলেও কংগ্রেসের বাধার কারণে পারেননি।
শান্তির সন্ধানে
তার মধ্যপ্রাচ্য নীতি সফল হতে শুরু করেছিল। তার সময়েই ১৯৭৮ সালে মিসর ও ইসরায়েলের মধ্যে ঐতিহাসিক ক্যাম্প ভেডিভ চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু তার সফলতা ছিল স্বল্প সময়ের জন্য।
ইরান বিপ্লবের জের ধরে আমেরিকানদের জিম্মি অর্থাৎ ইরানে মার্কিন দূতাবাসে কূটনীতিক ও নাগরিকদের যে জিম্মি করা হয়েছিল এবং আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিষয়গুলোর সমাধান করা তার জন্য তিক্ত স্বাদ নিয়ে আসে।
তিনি তেহরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং জিম্মি আমেরিকানদের মুক্ত করতে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করেন। একপর্যায়ে জিম্মিদের উদ্ধার করতে গিয়ে সাত আমেরিকান নিহত হন। এ ঘটনাই তার পুননির্বাচিত হওয়ার আশা শেষ করে দিয়েছিল।
১৯৮০ সালে দলীয় প্রার্থিতার দৌড়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েও সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির বিরুদ্ধে ৪১ শতাংশ পপুলার ভোট পান। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রোনাল্ড রিগ্যানের বিরুদ্ধে জিততে এটি যথেষ্ট ছিল না। কার্টার তার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের শেষ দিনে ‘জিম্মি মুক্তির বিষয়ে সফলভাবে চুক্তি হয়েছে বলে ঘোষণা দেন’।
হোয়াইট হাউস থেকে বিদায় নেওয়ার পর জিমি কার্টার তার সুনাম পুনরুদ্ধারে মনোযোগী হন। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষে উত্তর কোরিয়ায় শান্তি মিশনে গিয়েছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক সমস্যা ও সংকট নিয়ে কাজ করে তার কার্টার প্রেসিডেন্সিয়াল সেন্টার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
তিনি তৃতীয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০০২ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। এরপর ২০১৫ সালে তার ক্যান্সার শনাক্ত হয়। তার বাবা-মা ও তিন বোনও একই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন।
সাবেক এই প্রেসিডেন্ট ও তার স্ত্রী ১৯৮৪ সালে চ্যারিটি শুরু করেন। তারা চার হাজারের বেশি বাড়ি সংস্কারে সহায়তা করেন। একই সাথে প্লেইনসের মারানাথা ব্যাপ্টিস্ট চার্চে শিক্ষকতা অব্যাহত রাখেন তিনি। তার স্ত্রী রোজালিন কার্টার ২০২৩ সালের নভেম্বরে মারা যান।
চলতি বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কমালা হ্যারিসকে ভোট দেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন কার্টার। তার রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যে উদারপন্থার ছাপ যেমন ছিল তেমনি তিনি আবার ধর্ম বিশ্বাস থেকে সরে যাননি।
তিনি বলেছেন, “আপনি ধর্ম বিশ্বাস ও পাবলিক সার্ভিসকে আলাদা করতে পারেন না। আমি কখনোই ঈশ্বরের ইচ্ছা আর আমার রাজনৈতিক দায়িত্বের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখিনি। আপনি একটা লঙ্ঘন করলে, আরেকটাও লঙ্ঘিত হবে”। বিবিসি বাংলা