রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:২৯ পূর্বাহ্ন
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ::
সিটিজেন নিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে। যারা আগ্রহী আমাদের ই-মেইলে সিভি পাঠান

জিয়া এরশাদের সেই বিচ্ছু শামসু এখন

  • আপডেট টাইম : বুধবার, ২১ এপ্রিল, ২০২১
  • ২২২ বার পঠিত

জিয়াউর রহমানের ক্ষমতাকালে উত্থান শামসুল হক চৌধুরী ওরফে বিচ্ছু শামসু এরশাদের শাসনামলে দাপুটে হয়ে ওঠেন আর বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার আমলে হয়েছেন আঙুল ফুলে কলাগাছ। তবে সব সরকার আমলেই আওয়ামী নিধনের দক্ষতায় ‘পারদর্শী’ ছিলেন তিনি, একই চরিত্রে বহাল আছেন এখনো। জিয়ার হাত ধরে জাতীয়তাবাদী যুবদলে নাম লিখিয়েই ছাত্রলীগ আর যুবলীগ নেতা-কর্মীদের ওপর হামলে পড়েছিলেন। এরশাদ সরকার আমলে জাপা ক্যাডার হিসেবে শামসুল হক চৌধুরীর দৌড়ঝাঁপ পটিয়া থেকে চট্টগ্রাম মহানগর পর্যায়েও বিস্তৃতি পায়।

সে সময় আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের টার্গেট করে বেশুমার নিধনযজ্ঞ চলে বলে অভিযোগ আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাদের। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রথম দফায় আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরপরই চামড়া বাঁচাতে ভোল পাল্টে আবাহনী ক্রীড়া চক্রে নাম লেখানোর মধ্য দিয়ে দলে ঢুকে পড়েন তিনি। অল্প সময়েই কূটকৌশল খাটিয়ে, হিংস্রতা পুঁজি করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব পর্যায়ে পৌঁছে যান। এজন্য দলটির যে পর্যায়ের নেতা-কর্মীকেই তিনি বাধা মনে করেছেন তাকেই কৌশলী মামলা-হামলায় সরাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি।

পটিয়ায় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হিসেবে যাত্রা করা শামসুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে বরাবরই দুর্নীতি, অনিয়ম, লুটপাটের অসংখ্য অভিযোগ উঠেছে, তদন্তও হয়েছে দফায় দফায়। যথারীতি দুর্নীতি দমন কমিশনের নোটিসও হয়েছে তার নামে। কিন্তু কিছুতেই কিচ্ছু হয়নি তার।

সব অভিযোগ ছাইচাপা দিয়ে তিনি তরতর করে উঠে গেছেন ওপরের দিকে। তার নির্বাচনী এলাকা পটিয়ায় হেন কাজ নেই যা তিনি ও তার পরিবারের সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত হয়নি। বেপরোয়া দখলবাজি, চাঁদাবাজি, হয়রানি, অত্যাচার, নিয়োগ বাণিজ্য থেকে কমিশন বাণিজ্য পর্যন্ত সবকিছুর সঙ্গেই তার পরিবারের সদস্যরাই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেন। এসব নিয়ে বারবারই তিনি বিতর্কিত হয়েছেন, ক্ষোভ, অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে খোদ দলীয় ফোরামেও। কিন্তু কোনো কিছুই তোয়াক্কা করেননি তিনি।

সেনাশাসক জিয়ার মুখেই খেতাব পাওয়া ‘বিচ্ছু শামসু’ কীভাবে যুবদলের থানা নেতা থেকে পরে সেনাশাসক এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর দমন-পীড়নে ভূমিকা রাখেন সেসব কথা ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে। সে সময় আওয়ামী লীগের জনসভায় বোমা হামলা চালানোর অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। প্রভাবশালী নেতা বনে যাওয়ায় ত্যাগী নেতা-কর্মীর অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রকৃতপক্ষে বিচ্ছু শামসুর অন্তরে বিএনপি-জাতীয় পার্টি; মুখে মুখে তিনি আওয়ামী লীগার।

১৯৮০ সালে যখন হকার নেতা ছিলেন, টাইপ মেশিন চুরির অপরাধে গ্রেফতার হয়ে ১৭ দিন কারাভোগ করেন। চট্টগ্রামের ডেইলি লাইফ পত্রিকায় এ খবর প্রকাশ হয়েছিল তখন।

পরে বিএনপির যুবদল হয়ে জাতীয় পার্টির যুবসংহতিতে যোগ দেন। ওই সময় নিউমার্কেট মোড়ে আওয়ামী লীগের মিটিং পন্ড করার জন্য বোমা হামলা চালান দলবল নিয়ে। রাজনীতিতে বারবার জার্সি পাল্টানো শামসুল হক চৌধুরী সর্বশেষ আবাহনী ক্রীড়া চক্রের মাধ্যম হয়ে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। দলে নিজের কিছুটা শক্তপোক্ত অবস্থান সৃষ্টি করেই তিনি মেতে ওঠেন পুরনো খেলায়। আওয়ামী লীগের মূলধারার নেতা-কর্মীদের দূরে ঠেলে জামায়াত, বিএনপি ও হাইব্রিডদের কাঁধে ভর করে তিনি আবারও নেমে পড়েন আওয়ামী লীগ নিধনের মিশন নিয়ে। তার দখলদারি, আগ্রাসন ও দাম্ভিকতার শিকার হয়েছেন আওয়ামী লীগের হাজারো নেতা-কর্মী-সমর্থক। পটিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের মূলধারার নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন সময় মিথ্যা মামলা দিয়ে কোণঠাসা করে রেখেছেন। এসব নিয়ে ছাইচাপা আগুন রয়েছে নেতা-কর্মীদের মনে। ক্ষোভ, অসন্তোষ, বিরক্তিতে অনেকে রাজনীতির অঙ্গন থেকেই নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন।

ঘনিষ্ঠজনদের একচ্ছত্র আধিপত্য : ওয়ান-ইলেভেনের পর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সুফল তুলে ২০০৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে পটিয়া থেকে সংসদ সদস্য হন শামসুল হক চৌধুরী। সেই শুরু, আর পেছনে তাকাতে হয়নি। ২০১৪ ও ২০১৮-এর জাতীয় নির্বাচনেও জয়ী হয়ে এখন জাতীয় সংসদের হুইপ। আওয়ামী লীগ যখন টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় তখন ‘হ্যাটট্রিক এমপি’ শামসু। আওয়ামী লীগে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত হয়েছে। পটিয়ায় এখন হুইপ শামসু ও তার নিকটাত্মীয়দের একচ্ছত্র আধিপত্য। ভূমিদখল, থানা-কোর্ট, ভূমি অফিস, টেন্ডারবাজি, শিল্প জোনের নিয়ন্ত্রণসহ সবখানেই হুইপ ও তার ছেলে শারুনের ঘনিষ্ঠজনদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কায়েম রয়েছে। শামসুল হক চৌধুরীর এপিএস পরিচয়দানকারী এজাজ চৌধুরীর বাবার গোডাউনে ইয়াবার বড় চালানটি ধরা পড়লেও অদৃশ্য হাতের ইশারায় সবকিছু চাপা পড়ে গেছে। সেই এজাজ এখন গড়ে তুলেছেন কিশোর গ্যাং। ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণ নিয়েও এলাকায় দাপট দেখান তিনি। এমপির ভাই নবাবের কথার বাইরে শিল্প জোনে কারও টুঁশব্দটি করারও সাহস নেই। সেখানকার স্ক্র্যাপ ব্যবসা থেকে শুরু করে সাপ্লাই বাণিজ্যের সবই তার নিয়ন্ত্রণে। নবাবের বিচার বৈঠকই এলাকার জায়গাজমিসংক্রান্ত বিরোধ মেটানোর অঘোষিত আদালত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভুক্তভোগী অনেকে জায়গাজমির বিরোধ নিয়ে থানায় অভিযোগ করলেও নবাব সেসব নিজের দায়িত্বে সমাধানের নামে নিজের স্বার্থ হাসিল করে থাকেন। স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছেন, পটিয়ার কেলিশহর, কচুয়াই, খরনা, জঙ্গলখাইন, কাশিয়াইশ, হাইদগাঁও, আশিয়াসহ বিভিন্ন এলাকার ফসলি জমির টপ সয়েল বিক্রি করে কোটি টাকা অবৈধ আয় করেছেন হুইপের ভাই মুজিবুল হক চৌধুরী ওরফে নবাব। ফসলি জমির মাটি কেটে নেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পটিয়া থানা থেকে সম্প্রতি বদলি হওয়া ওসির সঙ্গেও প্রকাশ্য বিরোধে জড়িয়ে পড়েন নবাব। ২০১৫ সালে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগে নবাবের বিরুদ্ধে কর্ণফুলী থানায় মামলা করেন এ এইচ এন্টারপ্রাইজের মালিক আনোয়ার হোসেন। মামলায় এমপির ছোট ভাইসহ তিনজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১০ থেকে ১৫ জনকে আসামি করা হয়। তবে পরবর্তী সময়ে মামলাটি আর আলোর মুখ দেখেনি। বিষয়টিতে পুলিশ প্রশাসনসহ সর্বত্র তোলপাড় সৃষ্টি হয়। আরেক ভাই ফজলুল হক চৌধুরী মজনুর একচ্ছত্র আধিপত্য রয়েছে শোভনদন্ডী, খরনা, ভাটিখাইন ও কচুয়াই এলাকায়। সব বিতর্কিত কাজেই তার সরব অবস্থান থাকে।

হুইপের বিরুদ্ধে অন্তহীন অভিযোগ : চট্টগ্রাম-১২ পটিয়া আসনের আওয়ামী লীগদলীয় সংসদ সদস্য ও হুইপ শামসুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। এ আসন থেকে টানা তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া শামসুলের বিরুদ্ধে মানব পাচার, মাদক কারবার, ক্লাবকে জুয়ার আখড়া বানানো, বিদেশে অর্থ পাচার, নালার ওপর মার্কেট নির্মাণসহ অনেক অপকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচনী এলাকায় সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা নয়ছয় করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সর্বশেষ ক্লাবগুলোয় ক্যাসিনোসহ জুয়ার আসর বসানোর সপক্ষে বক্তব্য দিয়ে আবারও আলোচনায় আসেন তিনি। আলাদিনের চেরাগের মতো রাতারাতি আঙুল ফুলে বটগাছ বনে যাওয়া শামসুলকে বারবারই চট্টগ্রামের রাজনীতিতে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। বিশেষ করে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান নিয়ে শামসুল হক চৌধুরীর মন্তব্যে খোদ সরকারি দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন। ওই সময় ক্যাসিনোকান্ডে জড়িতদের গ্রেফতার ও সরকারের শুদ্ধি অভিযানে এ হুইপের নাম উঠে এলে তার সম্পদের অনুসন্ধানে নামে দুদক। ২০১৯ সালের ক্যাসিনো অভিযানের পর ওই বছরের ২৩ অক্টোবর মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ এনে এমপি শামসুল হক চৌধুরীসহ ২২ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিতে এসবির বিশেষ পুলিশ সুপার (ইমিগ্রেশন) বরাবর চিঠি পাঠায় দুদক। দুদকের নির্ভরযোগ্য এক সূত্র জানান, হুইপ শামসুল হক চৌধুরীর অন্যান্য ব্যাপারে তদন্ত এখনো চলছে।

ক্লাব জুয়া থেকে হুইপের আয় শত কোটি টাকা! : দুদকসূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামের আবাহনী ক্লাব থেকে গত পাঁচ বছরে শামসুল হক আয় করেছেন কয়েক শ কোটি টাকা। ঠিক এমনই একটি বিষয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেন একজন পুলিশ পরিদর্শক মাহমুদ সাইফুল আমিন। পরে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন হুইপ শামসুল হক চৌধুরী। চট্টগ্রামের বিভিন্ন ক্লাব থেকে ক্যাসিনোর মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহিভর্‚ত সম্পদ অর্জনে শামসুল হক চৌধুরীর প্রধান সহযোগী ও তার কথিত ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পি এ) নুর উর রশীদ চৌধুরী ওরফে এজাজ চৌধুরীকে গত বছরের ২১ জানুয়ারি দুদক প্রধান কার্যালয়ে টানা ছয় ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved  2019 CitizenNews24
Theme Developed BY ThemesBazar.Com