দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন ভাষাসৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম বজলুর রহমান সহ ৯ ব্যক্তি ও ১ প্রতিষ্ঠান। বৃহস্পতিবার সকালে গণভবনে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার ২০২১’ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই পুরস্কার তুলে দেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ার ইসলাম নাম ঘোষণার পর পুরস্কারপ্রাপ্তদের ও তাদের প্রতিনিধিদের হাতে পদক তুলে দেন সরকারপ্রধান।
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য ভাষাসৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহচর, প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম বজলুর রহমান ‘স্বাধীনতা পুরস্কার-২০২১’-এ ভূষিত হয়েছেন। বজলুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতা পুরস্কার গ্রহণ করেন তাঁর সহধর্মিণী শাহানারা বেগম।
একই ক্যাটাগরিতে প্রয়াত আহসানউল্লাহ মাস্টার ও প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ও প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খুরশিদ উদ্দিন আহমেদ স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। সাহিত্যে কবি মহাদেব সাহার পাশাপাশি সংস্কৃতিতে এবার পুরস্কার পেলেন চলচ্চিত্রকার-গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার ও নাট্যজন আতাউর রহমান। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ড. মৃন্ময় গুহ নিয়োগী, সমাজসেবা বা জনসেবায় পুরস্কার পান অধ্যাপক ডা. এম আমজাদ হোসেন। গবেষণা ও প্রশিক্ষণে প্রতিষ্ঠান হিসেবে সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান পেয়েছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল।
জাতীয় পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৭৭ সাল থেকে প্রতিবছর স্বাধীনতা পুরস্কার দিচ্ছে সরকার। স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ১৮ ক্যারেট মানের পঞ্চাশ গ্রাম স্বর্ণের পদক, পদকের একটি রেপ্লিকা, ৩ লাখ টাকা ও একটি সম্মাননাপত্র দেওয়া হয়।
স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত এ কে এম বজলুর রহমানের গৌরবোজ্জ্বাল জীবনী: বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের পট পরিবর্তনকারী অভ্যুদয়ের এই সময়টুকুতে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালনকারী বাংলা মায়ের বীর সন্তানদের একজন এ কে এম বজলুর রহমান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে তাঁর ভূমিকার কথা ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব। প্রথম সারির নেতা হিসেবে গণমানুষের জন্য কাজ করে গেছেন আমৃত্যু। আর তাঁর সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য সম্ভবত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহচর্য। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে শিখতে পেরেছেন মানুষের জন্য দেশের জন্য কিভাবে নির্ভীক হৃদয়ে দ্ব্যর্থহীনভাবে কাজ করতে হয়। বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে জাতির পিতার দেয়া নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। তিনি কেবল নেতাই ছিলেন তা নয়। নেতৃত্বের পাশাপাশি তিনি একজন নিষ্ঠাবান কর্মি ও সংগঠক হিসেবে রেখেছেন দূরদর্শীতার স্বাক্ষর। আওয়ামী লীগের দুর্দিনের যোদ্ধা হয়ে ছিলেন সবসময়। বারবার জেল খেটেছেন, মাথায় হুলিয়া নিয়ে ফেরারী থেকেছেন; অসংখ্যবার শিকার হয়েছেন পুলিশী নির্যাতনের।
সম্ভানন্ত্র মুসলিম পরিবারের সন্তান এ কে এম বজলুর রহমানের রাজনীতিতে হাতেখড়ি ছাত্রজীবনেই। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন এ কে এম বজলুর রহমান। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠার দিনে ঐতিহাসিক রোজ গার্ডেনে উপস্থিত ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়াস্থ মিউচ্যুয়েল ক্লাবে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক সভারও সক্রিয় কর্মী ছিলেন তিনি।
স্বাধীনতাপূর্ব বাংলা ঢাকার পরেই শ্রমিক অধ্যূষিত নারায়ণগঞ্জ ছিল আওয়ামী লীগের শক্তিশালী ঘাঁটি। একজন রাজনৈতিক যোদ্ধা হিসেবে এ কে বজলুর রহমান অবহেলিত শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫০ সালে বিশিষ্ট শ্রমিক নেতা আইএলএর গভর্ণর বোর্ডের সদস্য ফয়েজ আহমেদের সঙ্গে তিনি শ্রমিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। সুতাকল, পাটকল ও জাহাজী শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন এ কে এম বজলুর রহমান। বায়ান্নর ফেব্রয়ারিতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্টিমারযোগে ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। পুলিশ পাহারায় শেখ মুজিব নারায়ণগঞ্জ স্টিমারঘাটে আসার পর শামসুজ্জোহা এবং বজলুর রহমানের নেতৃত্বে মিছিল ও শ্লোগান দিতে থাকেন ছাত্রলীগ কর্মিরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এর ১৯৯তম পৃষ্ঠায় সেই ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। এরপর ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে নারায়ণগঞ্জে জনসভায় বক্তৃতা করেন আবুল হাশিম, এ কে এম বজলুর রহমান, মোস্তফা সারোয়ারসহ আরও অনেকে।
১৯৫৪ সালে নরসিংদীর রায়পুরায় যুক্তফ্রন্ট প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় এ কে বজলুর রহমানকে। সেই সময় তাঁকে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়। যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর তিনি মুক্তি পান। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়ার পর নারায়ণগঞ্জ থেকে আবারো তাঁকে গ্রেফতার করে ময়মনসিংহ কারাগারে নেয়া হয়।
১৯৫৫ সানে এ কে এম বজলুর রহমান নারায়ণগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগের সম্পাদক নির্বাচিত হন। স্বৈরাচার আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সংগঠনকে সুসংগঠিত করেন তিনি। ১৯৬৫ সালে তিনি ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে ছয় দফার পক্ষে আন্দোলন জোরদার করেন। শেখ মুজিবের ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবনে আওয়ামী লীগের এক বর্ধিত সভায় এ কে এম বজলুর রহমান ছয় দফার পক্ষে জোরালো ভূমিকা রেখে বক্তৃতা করেন। ১৯৬৬ সালের ৮মে নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া টাউন হল ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। সভায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রায় সব নেতাই উপস্থিত ছিলেন। শামসুজ্জোহার সভাপতিত্বে নারায়ণগঞ্জ থেকে এ কে এম বজলুর রহমান, মোস্তফা সারোয়ার বক্তৃতা করেন। ছয় দফার পক্ষে নারায়ণগঞ্জে অনুষ্ঠিত জনসভায় সর্বস্তরের বাঙালিদের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। বিশেষ করে আদমজী জুট মিলের হাজার হাজার শ্রমিকের উত্তাল মিছিল দেখে পাকিস্তান সরকার ভীত হয়ে শেখ মুজিবকে সেই রাতেই গ্রেফতার করে। একমাস পর এ কে এম বজলুর রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ান জারি এবং পরবর্তীতে হুলিয়া জারি করা হয়। দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৬৬ সালের ৯ আগস্ট তিনি ঢাকা ডিসি অফিসে আত্মসমর্পণ করার পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দেড় বছর রাজবন্দী ছিলেন। সেই সময়কার কথা উল্লেখ রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ের ২০২ এবং ২৪৯ নম্বর পৃষ্ঠায়।
এ কে এম বজলুর রহমান ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০ এর পাকিস্তান জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করতে নিরলস পরিশ্রম করেন এ কে এম বজলুর রহমান। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এ কে এম বজলুর রহমান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতার নির্মম হত্যাযজ্ঞের পর এ কে এম বজলুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। এর কিছুদিন পরেই পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন আওয়ামী লীগের বিশ্বস্ত কর্মী এ কে এম বজলুর রহমান। এক দশকের বেশি শয্যাশায়ী থাকার পর ১৯৮৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান বঙ্গবন্ধুর নিষ্ঠাবান সৈনিক এ কে এম বজলুর রহমান। পরবর্তীতে নারায়ণগঞ্জের মাসদাইর কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।