গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রতি ঘনমিটারে ৪৬ পয়সা নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান, উন্নয়ন, উত্তোলন ও সংস্কার কার্যক্রমের জন্য তহবিলের অর্থ সংস্থানে কেটে রাখা হচ্ছে। বিগত ২০০৯ সালে গঠন করা হয় গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (জিডিএফ)। কিন্তু অর্থ বিভাগ সম্প্রতি এলএনজি আমদানির জন্য পেট্রোবাংলাকে ওই তহবিলের ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বিষয়টিতে আপত্তি তুলে বলছেন, দেশের জ্বালানি খাত অনেক বেশি আমদানিনির্ভর। জিডিএফের মূল উদ্দেশ্যই ছিল আমদানি নির্ভরতা কমানো। সেজন্যই অনুসন্ধান ও উন্নয়নের মাধ্যমে স্থানীয় উত্তোলন বাড়াতে গ্রাহকের কাছ থেকে নিয়মিত অর্থও নেয়া হচ্ছে। এখন ওই অর্থ জ্বালানি আমদানিতেই ব্যয় হলে তহবিলের উদ্দেশ্যই পুরোপুরি ব্যর্থ এবং গ্রাহকদের সঙ্গেও ন্যায় হচ্ছে না। তহবিল গঠনের সময়ে এ নিয়ে জারি করা গেজেটেও অর্থ দিয়ে এলএনজি বা অন্য কোনো জ্বালানি পণ্য আমদানির কথা বলা হয়নি। পেট্রোবাংলা এবং জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে দেশে গ্যাসের সরবরাহ ঠিক রাখতে পেট্রোবাংলা স্পট মার্কেট থেকে উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানি করছে। এজন্য সংস্থাটিকে প্রতিনিয়ত অর্থ বিভাগের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। তবে ভর্তুকির বাইরে এলএনজি কেনার জন্য অতিরিক্ত কোনো অর্থ বরাদ্দ নেই। সর্বশেষ জিডিএফ থেকে ঋণ হিসেবে ৩ হাজার কোটি টাকা পেট্রোবাংলার জন্য বরাদ্দ দিয়েছে অর্থ বিভাগ। তবে তার সঙ্গে তিন ধরনের শর্তও জুড়ে দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি অনুমোদন পত্রে অর্থ বিভাগ বলেছে, জিডিএফ থেকে এলএনজি আমদানির জন্য সাময়িকভাবে ৩ হাজার কোটি টাকা পেট্রোবাংলাকে ঋণ দেয়া হলো। তবে এ ক্ষেত্রে তিনটি শর্ত রয়েছে। প্রথমত, এ ঋণ ভর্তুকি বাবদ পাওয়া অর্থ থেকে সমন্বয় করা হবে। দ্বিতীয়ত, এ ঋণের অর্থ জিডিএফে ফেরত দেয়ার ৩০ দিনের মধ্যে অর্থ বিভাগকে জানাতে হবে। তাছাড়া শুধু বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া জিডিএফের অর্থ থেকে ব্যয় পরিহার করতে হবে। একই সঙ্গে এ ধরনের ব্যয়ের প্রয়োজন দেখা দিলে অর্থ বিভাগের পূর্বানুমোদন নিতে হবে।
সূত্র জানায়, এলএনজির আন্তর্জাতিক বাজারদর দীর্ঘদিন ধরে অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু চাহিদার বিপরীতে বাজেট থেকে ভর্তুকি হিসেবে পেট্রোবাংলা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম অর্থ বরাদ্দ পাচ্ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত এলএনজি আমদানিতে ভর্তুকি বাবদ ৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়া করা হয়েছে। সর্বশেষ গত ১৩ জানুয়ারি ভর্তুকি বাবদ মোট ৩২ হাজার ২১৯ কোটি টাকার চাহিদা পাঠিয়েছে পেট্রোবাংলা। তার মধ্যে এলএনজিতে ভর্তুকি হিসেবে চাওয়া হয় ২৫ হাজার ২১৯ কোটি। বাকি ৭ হাজার কোটি টাকা এনবিআরের পাওনা পরিশোধের জন্য চাওয়া হয়। তারপর মার্চে জরুরি ভিত্তিতে ১ হাজার ১৯০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে পাঠায় পেট্রোবাংলা। ওই প্রেক্ষিতে গত ২৩ মার্চ পেট্রোবাংলার অনুকূলে ১ হাজার কোটি টাকা ছাড়া করা হয়। মার্চের পর থেকে এলএনজি ক্রয়ের জন্য ভর্তুকি বাবদ আর কোনো অর্থ পায়নি পেট্রোবাংলা। সংস্থাটির মতে, স্পট মার্কেটে এলএনজি কিনতে প্রচুর অর্থ ব্যয় হচ্ছে। এলএনজি আমদানি করতে অর্থ বিভাগের কাছে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। অর্থ বিভাগ যে টাকা ছাড় করছে তা দিয়ে স্পট থেকে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। তবে এ অর্থ দিয়ে এলএনজি ব্যয় নির্বাহ করা মুশকিল। এমন পরিস্থিডুতে জিডিএফ থেকে ঋণ গ্রহণের অনুমোদন চেয়ে সম্প্রতি অর্থ বিভাগে প্রস্তাব পাঠানো হয়। পেট্রোবাংলার ওই প্রস্তাবের ভিত্তিতেই সংস্থাটিকে তহবিলের ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ হিসেবে ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে অর্থ বিভাগ।
সূত্র আরো জানায়, চলতি বছরের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত স্পট মার্কেট থেকে ১৩ কার্গো এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা করা হয়েছে। তবে অর্থ সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে পেট্রোবাংলা প্রতি মাসে অন্তত একটি কার্গো আমদানির লক্ষ্য নিয়েছে। সম্প্রতি সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি এক কার্গো এলএনজি আমদানির অনুমোদন দিয়েছে। ওই অনুমোদনের ভিত্তিতে ৩৩ লাখ ৬০ হাজার এমএমবিটিইউ এলএনজি কিনতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৯১ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। বর্তমানে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার ও ওমান থেকে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। তার পরেও চাহিদার তুলনায় ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। আর ওই ঘাটতি পূরণের জন্যই পেট্রোবাংলাকে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কিনে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে হচ্ছে। কভিড মহামারী ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় ইউরোপে এখন জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে। এলএনজির বাজারমূল্যে ওই সংকটের প্রভাব পড়েছে। শিগগিরই পণ্যটির মূল্য কমার কোনো লক্ষণও নেই।
এদিকে এলএনজি ক্রয়ে জিডিএফের অর্থ ব্যবহারের বিষয়টিতে আপত্তি জানিয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল জানান, এলএনজি কিনতে গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের টাকা ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। এটি বেআইনি। এ অর্থ জনগণের। দেশের খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও উন্নয়নকাজে এ অর্থ ব্যবহার করা হয়। এ টাকা দিয়ে এলএনজি আমদানি করা হবে, এ ধরনের কোনো প্রভিশন নেই। এ ধরনের পদক্ষেপের কারণে দেশের জ্বালানি খাতে আজ নাজুক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
অন্যদিকে সার্বিক বিষয়ে অর্থ বিভাগের যুগ্ম-সচিব হাসান খালেদ ফয়সাল জানান, জরুরি প্রয়োজন উল্লেখ করে পেট্রোবাংলা এলএনজি আমদানির জন্য এ তহবিল থেকে ঋণ চেয়েছিল। জিডিএফ পেট্রোবাংলারই তহবিল। গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার বিষয়টি মাথায় রেখে জিডিএফ থেকে অর্থ বিভাগ শর্তসাপেক্ষে সাময়িকভাবে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়ার বিষয়টিতে সম্মতি দেয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মূল বাজেটে এলএনজি ক্রয় খাতে ভর্তুকি রাখা হয়েছিল ৪ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। গত ২০২০-২১ অর্থবছর বরাদ্দের পরিমাণ ছিল সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরেও সমপরিমাণ অর্থ দেয়া হয়েছিল। তাছাড়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ খাতে দেয়া হয়েছিল আড়াই হাজার কোটি টাকা।