শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৩৫ পূর্বাহ্ন
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ::
সিটিজেন নিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে। যারা আগ্রহী আমাদের ই-মেইলে সিভি পাঠান
সংবাদ শিরোনাম ::

হামাসকে বুকে টানছে রাশিয়া, ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্রকে কঠোর বার্তা

  • আপডেট টাইম : বুধবার, ১৫ জুন, ২০২২
  • ১৩৪ বার পঠিত

সম্প্রতি রাশিয়া-ইসরাইল সম্পর্কে ব্যাপক অবনতি হয়েছে। এর প্রধান কারণ ইউক্রেন অভিযান। কিয়েভের পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোয় যোগদান ঠেকাতে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি দেশটিতে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরু করে মস্কো।

অভিযানের কারণ হিসেবে রুশ কর্মকর্তারা বলছেন, ইউক্রেনকে ‘বেসামরিকীকরণ ও ‘নাৎসিমুক্তকরণ’র লক্ষ্যে এ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। মূলত এরপরই ইসরাইল ও রাশিয়ার মধ্যে শুরু হয় কথার যুদ্ধ। অভিযোগ আর পাল্টা অভিযোগের খেলা। এর মধ্যেই ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রকে কঠোর বার্তা দিতে এবার ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলন ও সশস্ত্র সংগঠন হামাসকে কাছে টানছে রাশিয়া।

এপ্রিলেই আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে রাশিয়ার অভিযানের নিন্দা জানায় ইসরাইল। চলমান ওই অভিযানকে ‘আন্তর্জাতিক আইন ও বিশ্ব ব্যবস্থার চরম অবমাননা’ বলে অভিহিত করে দেশটি। এখানেই শেষ নয়, রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেয় তেল আবিব। রাশিয়াকে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল থেকে বহিষ্কারের পক্ষে ভোট দেয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে সংস্থাটি থেকে নিজেদের প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় রাশিয়া।

ইসরাইলের এসব কর্মকাণ্ড রুশ কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিতভাবেই চরম ক্ষুব্ধ করেছে। রুশ অভিযানের নিন্দা জানিয়ে দেয়া তেল আবিবের বিবৃতি ও রাশিয়াকে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল থেকে বহিষ্কার করার চেষ্টাকে রাশিয়াবিরোধী আক্রমণ হিসেবে অভিহিত করেন রুশ কর্মকর্তারা।

তবে এক্ষেত্রে মস্কো ইসরাইলের বিরুদ্ধে নতুন করে আরও একটি অভিযোগ করে। রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে নিজেদের চলমান নিপীড়ন থেকে বিশ্ববাসীর নজর ঘোরাতে ইউক্রেন অভিযানের বিষয়টিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। একই সঙ্গে ইসরাইলের ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর দখল ও গাজা উপত্যকা অবরোধের তীব্র নিন্দা জানান তারা।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, পশ্চিমা দেশগুলোর প্রচ্ছন্ন ইন্ধন আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্য সমর্থনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বেশি সময় ধরে জবরদখল চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। মস্কো ও তেল আবিবের এ বাগযুদ্ধের ফলে তাদের সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। এবং রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এক সাক্ষাৎকারের পর সেটা একেবারে তলানিতে এসে ঠেকে।

ইউক্রেন অভিযানের মধ্যে গত মাসে (১ মে) ইতালির একটি টিভি চ্যানেলকে গুরুত্বপূর্ণ একটি সাক্ষাৎকার দেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। ওই সাক্ষাৎকারে রাশিয়ার শীর্ষ এ কূটনীতিককে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। উপস্থাপক প্রশ্ন করেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি যখন নিজেই একজন ইহুদি, তখন ইউক্রেনকে কেন ‘নাৎসিমুক্ত’ করার কথা বলা হচ্ছে?

উপস্থাপকের প্রশ্নের জবাবে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ল্যাভরভ বলেন, জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর ও নাৎসি নেতা অ্যাডলফ হিটলারের শরীরে ইহুদি রক্ত ছিল। ইউক্রেনের অভিযানের আগে থেকেই মস্কো অভিযোগ করে আসছে, ইউক্রেনে একটি নব্য-নাৎসি গোষ্ঠীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে ভলোদিমির সরকার। রুশ নেতার এ মন্তব্যে তাৎক্ষণিক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে ইসরাইল। ল্যাভরভ যা বলেছেন তা ‘অমার্জনীয়’বলে অভিহিত করে মস্কোকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানান ইসরাইলি কর্মকর্তারা।

ইসরাইলের বিরুদ্ধে মস্কোর অভিযোগ এখানেই শেষ নেই। মস্কো বলছে, ভলোদিমিরের সেনার পক্ষে লড়াই করতে ইউক্রেনে বহু সেনা পাঠিয়েছে ইসরাইল। গত মাসের শুরুর দিকে বিষয়টা নিয়ে প্রথম মুখ খোলেন রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ইউক্রেনে কুখ্যাত আজভ ব্যাটালিয়নের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে ইসরাইলি যোদ্ধারা। ইউক্রেনের আজভ ব্যাটালিয়নের বিরুদ্ধে নব্য-নাৎসি আদর্শ ধারনের অভিযোগ বেশ পুরনো।

হামাসের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক

ইসরাইলের বিরুদ্ধে রাশিয়ার এ কথার যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি ইসরাইল ও তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্রকে আরও কঠোর বার্তা দিতে চাইছে রাশিয়া। ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগঠন হামাসকে কাছে টানছে মস্কো। মে মাসে হামাসের একটি প্রতিনিধি দল রাশিয়া সফর করেছে। যার নেতৃত্বে ছিলেন সংগঠনটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রধান মুসা আবু মারজুক।

এ ছাড়া ফাতিহ হাম্মাদ ও হুসসাম বাদরানসহ হামাসের রাজনৈতিক শাখার সদস্যরাও ওই প্রতিনিধি দলে ছিলেন। হামাসের সূত্রগুলো বলছে, চলতি মাসেই আরও একটি প্রতিনিধি দল মস্কো সফর করবে। ইসরাইলের শত্রু হামাসের সঙ্গে হঠাৎ করে রাশিয়ার এ সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টাকে ইউক্রেন ইস্যুতে তেল আবিবের যে অবস্থান তার প্রতিশোধ হিসেবে ধরা যেতে পারে।

১৯৮০-এর দশকে ইয়াসির আরাফাতের প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) বিরোধিতা করতে গিয়ে হামাসের জন্ম হয়। পিএলও-র মতো হামাসও ইসরাইল রাষ্ট্রের অস্তিত্বের অধিকারে বিশ্বাস করে না। তাদের প্রতীকে রয়েছে জেরুসালেমের ‘ডোম অব দ্য রক’। বর্তমানে কথিত ইসরাইলের পুরো ভূখণ্ড, গাজা ও পশ্চিম তীর নিয়ে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করে গোষ্ঠীটি।

১৯৯৩ সালে ইয়াসির আরাফাত অসলো চুক্তির অধীনে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করেন। যার মধ্য দিয়ে ১৯৮৭ সালে শুরু হওয়া প্রথম ইন্তিফাদার অবসান হয়। তবে হামাস ওই শান্তি প্রক্রিয়া প্রত্যাখ্যান করে ইসরাইলে সশস্ত্র হামলা অব্যাহত রাখে। আর এ কারণেই হামাস ইসরাইলের বড় শত্রু। এবং সেই শত্রুর অস্তিত্ব মুছে ফেলতে মরিয়া তেল আবিব।

হামাসের সঙ্গে ইসরাইলের এ পর্যন্ত চার দফা বড় আকারের যুদ্ধ হয়েছে। সবশেষ গত বছরে মে মাসে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে উভয় পক্ষ। ১১ দিনের ওই যুদ্ধে গাজা উপত্যকার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও সশস্ত্র ও রাজনৈকিক সংগঠন হিসেবে আন্তর্জাতিক স্তরে হামাসের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়েছে।

মুসলিম দেশের সরকারগুলোর মধ্যে যারা আগে একতরফাভাবে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) সঙ্গে যোগাযোগ করত ও গাজার হামাস সরকারকে এড়িয়ে চলত, তাদের অনেকেই হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়ার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেন।

২০০৬ সালে গাজার সাধারণ নির্বাচনে হামাস ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এরপর থেকে মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বে ফাতাহ-এর অধীনে রয়েছে পশ্চিম তীর আর গাজার নিয়ন্ত্রণ হামাসের হাতে।

অভ্যন্তরীণ রাজনীতির স্বার্থে ফিলিস্তিনের অন্যান্য গোষ্ঠীগুলোর মতো হামাসও বহুদিন ধরেই বড় শক্তি হিসেবে রাশিয়ার সঙ্গে আরও বৃহৎ পরিসরে সম্পর্ক জোরদারের স্বপ্ন লালন করে আসছে। তাদের বিশ্বাস ও প্রত্যাশা, ফিলিস্তিন প্রশ্নে একমাত্র রাশিয়াই যুক্তরাষ্ট্রের দাদাগিরি চ্যালেঞ্জ করতে পারে। মস্কোও বহুদিন ধরেই ফিলিস্তিনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে হামাসের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে আসছে।

২০০৬ সালে ফিলিস্তিনি নির্বাচনে হামাসের বিজয় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর স্বীকৃতি না পেলেও সর্বপ্রথম রাশিয়াই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। এরপর থেকে উভয় পক্ষের নেতারা বিভিন্ন সময় নিয়মিতভাবেই বৈঠক করছেন। এসব বৈঠকের বেশিরভাগই মন্ত্রী ও উপমন্ত্রী পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

তবে সবশেষ গত মে মাসে হামাসের মস্কো সফর বেশ তাৎপর্যপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। এ সফরে হামাসের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন স্বয়ং রুশ উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিকাইল বোগদানোভ। এ ছাড়া এ সফরে চেচেন নেতা ও ইউক্রেনের সম্মুখ সমরের কমান্ডার রমজান কাদিরভের সঙ্গেও বৈঠক করেন হামাস সদস্যরা।

ইউক্রেন অভিযানের পর থেকেই রাশিয়া কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছে, যারাই মস্কোর এ সামরিক অভিযানে নাক গলাবে তাদেরকে ‘কঠিন পরিণতি’ ভোগ করতে হবে। ইউক্রেনে ইস্যুতে ইসরাইলের বিতর্কিত অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে হামাসের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াচ্ছে মস্কো। এমনটাই মনে করেন এনসাইক্লোপিডিয়া জিওপলিটিকার গবেষক ও মার্কিন সেনাবাহিনীর সাবেক ক্যাপ্টেন জন রুগাবের।

সম্প্রতি আরব নিউজকে এক সাক্ষাৎকারে এ বিশ্লেষক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের উৎসাহেই ইসরাইল ইউক্রেনকে সমর্থন ও সহযোগিতা দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ ভেস্টের পর এবার আরও উন্নত অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করার চিন্তা-ভাবনা করছে তেল আবিব। তারই প্রতিক্রিয়ায় হামাসকে কাছে টানছে মস্কো।

রুগাবের জানান, হামাসের মস্কো সফরের সপ্তাহ খানেক আগেই ইসরাইল তার রাজনৈতিক-সামরিক শাখার প্রধানকে ইউক্রেনে পাঠায়। ইউক্রেনে আরও অস্ত্র পাঠানোর বিষয়ে আলোচনা করাই ছিল তার ওই সফরের উদ্দেশ্য। এ নিয়ে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যেও আলাপ হয়েছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved  2019 CitizenNews24
Theme Developed BY ThemesBazar.Com