‘চন্দন পালংকে শুয়ে একা একা কি হবে, জীবনে তোমায় যদি না পেলাম’ ভারতের কালজয়ী কণ্ঠশিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি গানটিতে না পাওয়ার বেদনা থাকলেও কুমিল্লার বনেধি পরিবারের সন্তান আজম খান কিন্তু কাঠের পালংক ক্রয় করে শত বছর পরেও পাওয়ার আনন্দের সুখ স্মৃতির মধ্যে বেঁচে আছেন আজো।
তার ক্রয়কৃত খয়েরী রঙের কাঠের পালংকটি আজো শত বছর আগের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে আছে আপন মহিমায়।
জানা যায়, কুমিল্লা নগরীর ছাতীপট্রি এলাকার একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান ছিলেন আজম খান। তিনি নগরীর একজন স্বনামধন্য জুয়েলারি ব্যবসায়ী ছিলেন। বংশ পরস্পরায় আভিজাত্যের প্রতীক নগরীর এই খান পরিবার। হাজী আজম খান গড়ে তুলেন আজম খান জুয়েলার্স। যা জেলার প্রাচীন জুয়েলারি দোকানের অন্যতম একটি।
তিনি এক রাজবাড়ি থেকে একটি পালংক ক্রয় করেন। পালংকের গায়ে খোদাই করা ৮ কার্তিক ১৩১৭ বাংলা, তৈরি করা হয়েছে।
সরেজমিন শত বছরের প্রাচীন এই পালংকটি দেখতে গেলে হাজি আজম খান ও তাহেরা বেগমের কনিষ্ট পুত্র কুমিল্লা দোকান মালিক সমিতি ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও কুমিল্লা জুয়েলারি মালিক সমিতির সভাপতি শাহ মোহাম্মদ আলমগীর খান জানান, আমার বাবা আজম খান কবে কখন এই পালংকটি কিনেছেন তা আমরা জানি না। আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন বাবা (১৯৬৭) মাত্র ৪৪ বছর বয়সে মারা যান। মা মারা যান ১৯৮৮ সালে ৫২ বছর বয়সে। মায়ের কাছে শুনেছি, বাবা খুব সৌখিন মানুষ ছিলেন। যখন যেটা যেখানে পছন্দ হতো মূল্য যাই হোক সেটা কিনে নিয়ে আসতেন। সম্ভবত উনিশ শতকের চতুর্থ দশকে বাবা তার ত্রিপুরার এক রাজ পরিবারের বন্ধুর বাসায় বেড়াতে যান। সেখানে গিয়ে পালংকটি দেখে বাবার খুব পছন্দ হয়। পালংকটি ৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৬ ফুট প্রস্ত। সমতল ভূমি থেকে এর উচ্চতা ২ ফুট। টিনের চৌচালা ঘরের অবয়বের মত তৈরি পালংকটিতে রয়েছে মশারী টানার স্থায়ী স্ট্যান্ডও। বার্মিজ লোহা কাঠের তৈরি পালংকটিতে লেখা রয়েছে ৮ কার্তিক, ১৩১৭ বাংলা। মিস্ত্রি শ্রী কৈলাশ চন্দ্র সূত্র ধর। সম্ভবত খয়েরী রঙের এই পালংকটি তৈরি করার বছর বিশ পরে বাবা এটি কিনে এনেছেন।
এই পালংকটিতে বাবা, মা, আমি ও আমার ছোট বোন রোকেয়া ঘুমিয়েছি। আমার শিশুকাল কেটেছে এই পালংকটিতে শুয়ে, বসে। মা ১৯৮৮ সালে মারা যাওয়ার পর থেকে আমরা আর কেউ এই পালংকটিতে ঘুমাইনা। বাবা-মায়ের অমর স্মৃতি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে এটি সংরক্ষণ করে রেখেছি। যখনি বাবা-মা’র কথা মনে হয় তখন এই পালংকটির সামনে এসে দাঁড়াই।
সু শাসনের জন্য নাগরিক-সুজন কুমিল্লার সভাপতি আলমগীর খান আরো বলেন, আমি বুঝ হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত এই পালংকের কোন মেরামত করতে দেখিনি, এমনকি আমি নিজেও করিনি। শুধু মাত্র ভালো শুকনো কাপড় দিয়ে একটু মুছে দিলেই ঝকঝক করে উঠে এই পালংকটি।
তিনি আরো বলেন, ঢাকার অনেক বড় বড় ইতিহাসবিদ এটা দেখে আমাকে অনুরোধ করেছেন, আমি যেন এটা জাদুঘরে দেই সংরক্ষণ করার জন্য। আমি বলেছি, আল্লাহর রহমতে বাবা-মায়ের স্মৃতি হিসেবে এটা আমার কাছেই সংরক্ষণ থাকবে।
মানবাধিকার সংগঠক ও বাপা কুমিল্লার সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর মাসুম বলেছেন, পালংকটি দেখে বুঝার উপায় নেই যে এটি ১১২ বছরের পুরানো। পালংকটি যেই দেখবে মনে হবে এইতো মাত্র বছর দশ আগের হবে। তিনি তৎকালীন সময়ের মানুষের মান ও তাদের রুচির প্রশংসা করেন।
বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও গবেষক আহসানুল কবীর বলেন, আমাদের এ অঞ্চলটি প্রাচীনকাল থেকেই উদ্ভিজ ও বনজ সম্পদে পরিপূর্ণ ছিল। কাঠের সহজলভ্যতার জন্য রাজপরিবার এবং জমিদাররা নানাবিধ মনোলোভা এবং নয়নাভিরাম আসবাবপত্র প্রস্তুত করতেন। তারই একটি ক্রয়সূত্রে শাহ মো. আলমগীর খানের পূর্ব পুরুষের হাতে পড়েছে। ঐতিহ্য প্রেমী ব্যক্তি হিসেবে তিনি এটিকে যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করেছেন। আমার বিশ্বাস পরবর্তী প্রজন্ম ও তাই করবেন। শাহ মো. আলমগীর খানের সংগ্রহে অনেক দূর্লভ মুদ্রা ও তৈজসপত্র ও রয়েছে এটি তার গভীর ঐতিহ্য প্রেমেরই পরিচায়ক।
ব্যবসায়ী নেতা শাহ মোহাম্মদ আলমগীর খান আশা প্রকাশ করে বলেন, আমার বিশ্বাস আমার পরবর্তী প্রজন্মও আমার বাবার এই দূর্লভ স্মৃতিটি সংরক্ষণ করবেন।