গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাময়িক বরখাস্ত মেয়র মো. জাহাঙ্গীর আলমের সরকার বিরোধী ও উষ্কানীমূলক নতুন বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ গাজীপুর সিটির ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের রহম আলী দারুল উলুম মাদ্রাসা ও এতিমখানার উদ্যোগে আয়োজিত ওয়াজ মাহফিলে সরকার বিরোধী ও উষ্কানীমূলক বক্তব্য দিয়ে সেই ভিডিও জাহাঙ্গীর তার নিজের ফেসবুক পেইজে পোস্ট করেন। সেই ভিডিওর সরকার বিরোধী ও উষ্কানীমূলক বক্তব্যের অংশ আজ বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ ২০২৩ অনেকেই তাদের ফেসবুক প্রোফাইলে পোস্ট করেন। ওই ভিডিও লাইক, ডিসলাইক, প্রতিক্রিয়া, শেয়ার ও বিশেয়ারের মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়।
ওই ভিডিওতে জাহাঙ্গীরকে বলতে শোনা য়ায়, “ ৪০ ফিট, ৩০ ফিট, ২০ ফিট, ৬০ ফিট, ৮০ ফিট রাস্তা দিছিল্যাম কেন? মানুষের কষ্টডা দেকছি জরমের পরে, জুতা-কাপুর অ্যাক অইয়া যায়, মানুষের যেন সেই কষ্টডা আবার না হয়। এই মাত্র দ্যাড় বচ্ছর করোনা ছিল দ্যাড় বচ্ছর কাজ করছি দ্যাড় বচ্ছরে আষ্টশ কিলোমিটার রাস্তার কাজ করছি। কথাডা আপনারা মুসলমান হিসেবে এইডা অ্যাকবারে নিজের কাছে রাইখেন, রাষ্ট্রের মালিক আমি আপনে সবাই। যদি দ্যাড় বচ্ছরে আষ্টশ কিলোমিটার রাস্তা করতে পারি তাইলে সরকার ছিল না এই দ্যাশে? সরকার আছে না? তাইল জনপ্রতিনিধিরা আছে না? রাষ্ট্রের সাংবিধানিক চেয়ারগুল্যা আছে না? তারা তাইলে এই ৫০ বচ্ছরে এইহানে কি করছে? অ্যা?”
এই বক্তব্য দিয়ে জাহাঙ্গীর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৪৭ এর ক ধারায়ও অপরাধ করেছেন।
সাংবাদিক নেতা রাহিম সরকার বলেন, “আওয়ামী লীগের লেবাসে জাহাঙ্গীর মূলত জামায়াত-বিএনপির এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন। জাহাঙ্গীর লোকেদের উষ্কে দিয়ে দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়। বিভিন্ন মসজিদ এবং ওয়াজ মাহফিলে গিয়ে এমপি, মন্ত্রীসহ সরকারের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানোর কৃতকর্মের জন্য জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। যে শর্তে জাহাঙ্গীরকে আওয়ামী লীগ ক্ষমা ঘোষণা করে সেই শর্ত তিনি বার বার ভঙ্গ করে চলছেন। অবিলম্বে ক্ষমা ঘোষণা বাতিল করে জাহাঙ্গীরকে গ্রেফতার করার দাবি জানাই।“
আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এর গাজীপুর মহানগরের সভাপতি ও গাজীপুর মহানগর আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য সাইফুল্লাহ শাওন বলেন, “সরকার বিরোধী বক্তব্য দেওয়ার জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে মামলা হওয়া উচিত। প্রয়োজনে আমি বাদী হয়ে মামলা করবো।”
এম রানা ফেসবুকে লিখেন, “এ দেখি চোরের মায়ের বড় গলা। এ বিষয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা উচিত। কারণ তিনি কত বড় উন্নয়নের রূপকার হয়ে গেছে যে, শেষমেশ সরকারকে নিয়ে আঙুল তুলছে। এগুলো কি আ ক ম মোজাম্মেল হক সাহেব শুনেন না। এসব কি জাহিদ আহসান রাসেল এমপি দেখেন না?“
এর আগে, মেয়রের দায়িত্বে থাকাকালে অনেক ঘটনায় আলোচনার জন্ম দেন জাহাঙ্গীর। এর মধ্যে করোনাভাইরাস মহামারী শুরুর পর ২০২০ সালে তিনি চীন থেকে ৫০ হাজার র্যাপিড টেস্ট কিট নিয়ে আসেন, যদিও দেশে তখনো র্যাপিড টেস্টের অনুমোদন ছিল না। আর নিয়ম অনুযায়ী ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কোনো অনুমতিও তিনি নেননি। সে সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা হয়। এর জবাবে জাহাঙ্গীর বলেছিলেন, “মানুষ মরে গেলে আইন দিয়ে কী করব!… কিন্তু আমার এখানে ৪০ লাখ মানুষ আমাকে ভোট দিয়েছে। যেকোনোভাবে হোক আগে তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করা আমার দায়িত্ব। মানবিক কারণে আমি আনছি, বাঁইচা থাকলে তখন আইন আদালত।”
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে গত বছর এপ্রিলে দেশের সব মসজিদে বাইরে থেকে মুসল্লি ঢোকার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল সরকার। সরকারের ওই নিষেধাজ্ঞা ওঠার আগেই এপ্রিলের শেষে মসজিদ খুলে দেওয়ার ঘোষণা দেন মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। তার ওই ঘোষণায় সে সময় বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন স্থানীয় প্রশাসন ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। একজন জনপ্রতিনিধির এ ধরনের ‘কাণ্ডজ্ঞানহীন’ পদক্ষেপের সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন অনেকেই। শেষ পর্যন্ত ওই ঘোষণা থেকে সরে এসে মেয়র জাহাঙ্গীর বলেছিলেন, সরকারের পক্ষ থেকে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সবাই যেন তা মেনে চলে।
প্রসঙ্গত, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের মীমাংসিত ইস্যু এবং জেলার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা সম্পর্কে জাহাঙ্গীরের বিতর্কিত মন্তব্য ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পরে। জাহাঙ্গীরের এমন বক্তব্য দলীয় ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পরিপন্থি। এ কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জাহাঙ্গীর আলমের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর তাকে দল থেকে বহিষ্কার ও মেয়র পদ থেকে অপসারণের দাবি জানান গাজীপুর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। টানা টানা কয়েকদিন থেমে থেমে তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে আন্দোলনও করেন। ঘটনাটির খবর কেন্দ্র পর্যন্ত গড়ালে সেখানেও নড়েচড়ে বসেন কেন্দ্রীয় নেতারা। গত ৩ অক্টোবর তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয় কেন্দ্র থেকে। ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তাকে সে নোটিশের জবাব দিতে বলা হয়। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়— সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত আপনার বক্তব্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সুনাম ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে, যা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের স্বার্থ পরিপন্থি কর্মকাণ্ড ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলাভঙ্গের সামিল। এটি সংগঠনের গঠনতন্ত্রের ৪৭ ধারা মোতাবেক শাস্তিযোগ্য অপরাধ। জাহাঙ্গীর সে নোটিশের জবাব দিলে ২২ অক্টোবর আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠকে সেটি নিয়ে আলোচনা হয়। তবে জাহাঙ্গীরের জবাব যুক্তিসঙ্গত মনে হয়নি।
২০২১ সালের ১৯ নভেম্বর গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক থেকে জাহাঙ্গীরকে আজীবন বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে বৈঠকে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক সূত্র জানায়, বৈঠকের এজেন্ডা উপস্থাপনকালে গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে দলের পক্ষ থেকে দেয়া কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব পড়ে শোনান দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এ নিয়ে বক্তব্য প্রদানকালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য রাখায় জাহাঙ্গীর আলমের কঠোর শাস্তির দাবি জানিয়ে কড়া বক্তব্য রাখেন দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আফম বাহাউদ্দিন নাছিম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক এ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস। এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে থেকে বক্তব্য রাখেন সভাপতিমন্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডাঃ দীপু মনিসহ অনেকেই। অনেক নেতাই রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করারও দাবি জানান। বৈঠক সূত্র জানায়, এ সময় দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের মন্তব্য জানতে চান দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জবাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, এই হাউসে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সবাই একমত দিয়েছেন, আমি তাতে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করছি। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নেত্রী আপনাকে অনুরোধ করছি। এরপর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দলের সিদ্ধান্ত জানিয়ে বলেন, গাজীপুর সিটি মহানগর আওয়ামী লীগ থেকে তাকে (জাহাঙ্গীর আলম) বহিষ্কার করা হলো। একই সঙ্গে তার প্রাথমিক সদস্য পদও বাতিল করা হলো।
গত ১৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির বৈঠকে দলের শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ড ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে বহিষ্কার হওয়া নেতাদের আবেদনের ভিত্তিতে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত হয়। ওই সভার আগে যারা দোষ স্বীকার করে আবেদন করেছিলেন, তাদের ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছিল। এতে শর্ত সাপেক্ষে ক্ষমা পান জাহাঙ্গীর আলম। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, “শুভেচ্ছা গ্রহণ করবেন। আপনার অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের স্বার্থ, আদর্শ, শৃঙ্খলা তথা গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততার জন্য ইতোপূর্বে আপনাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার/অব্যাহতি প্রদান করা হয়। আপনার বিরুদ্ধে আনিত সংগঠনবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ স্বীকার করে আপনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন এবং ভবিষ্যতে সংগঠনের গঠনতন্ত্র, নীতি ও আদর্শ পরিপন্থি কোনো কার্যকলাপে সম্পৃক্ত হবেন না মর্মে লিখিত অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। এমতাবস্থায়, গত ১৭ ডিসেম্বর গণভবনে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংগঠনের গঠনতন্ত্রের ১৭(৬) এবং ৪৭(২) ধারা মোতাবেক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের নিকট সাধারণ ক্ষমা প্রার্থনা করে আপনার প্রেরিত লিখিত আবেদন পর্যালোচনা এবং ভবিষ্যতে সংগঠনের স্বার্থপরিপন্থি কর্মকাণ্ড ও শৃঙ্খলা ভঙ্গ না করার শর্তে আপনার প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করা হলো। উল্লেখ্য, ভবিষ্যতে কোনো প্রকার সংগঠনবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হলে, তা ক্ষমার অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।”
তখন এ বিষয়ে জাহাঙ্গীর বলেছিলেন, বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করায় আওয়ামী লীগ সভাপতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। সেই সঙ্গে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
অপরদিকে, দুর্নীতির অভিযোগে মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার পর সম্প্রতি মেয়র পদ ফিরে পেতে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়েরের পর থেকে সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং মসজিদে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে বিষেদ্গার, এবং সরকার বিরোধী ও উষ্কানীমূলক নতুন নতুন বক্তব্য দিয়ে বেড়াচ্ছেন।