ঢাকা-চট্টগ্রাম ডাবল রেললাইন অবশেষে বাস্তবে রূপ নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বৃহস্পতিবার গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি আখাউড়া-লাকসাম ডাবল লাইনের উদ্বোধন করেছেন। প্রকল্পটি উদ্বোধনের ফলে এখন থেকে মাত্র চার ঘণ্টায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়া সম্ভব হবে। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের যোগাযোগ সহজ হওয়ায় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনবে। রাজধানীর সঙ্গে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের রেলপথের ৩২১ কিলোমিটারের মধ্যে ২৪৯ কিলোমিটার আগে থেকেই ডাবল লাইন ছিল। কিন্তু লাকসাম থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ৭২ কিলোমিটার রেলপথ সিঙ্গেল লাইনের হওয়ায় যাতায়াতে সময় ক্ষেপণ হতো। যে কারণে এটি ডাবল লাইনে উন্নীতকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন নানা কারণে বারবার পিছিয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে প্রকল্পের কাজ শেষে বৃহস্পতিবার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রেন ডাবল লাইনে চলাচল শুরু হয়েছে। এর ফলে দেশের প্রধান দুই শহরের মধ্যে যোগাযোগ আগের চেয়ে সহজ হবে।
২০১৫ সালে লাকসাম-চিনকি আস্তানা পর্যন্ত ৬১ কিলোমিটার ডাবল লাইন এবং ২০১৬ সালে টঙ্গী-ভৈরব পর্যন্ত ৬৪ কিলোমিটার রেলপথ ডাবল লাইন চালু করা হয়। এর আগে থেকেই চট্টগ্রাম-চিনকি আস্তানা এবং টঙ্গী-ঢাকা পর্যন্ত ডাবল লাইন নির্মিত ছিল। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি আখাউড়া-লাকসাম ডাবল লাইন প্রকল্পটি উদ্বোধন করেন। লাকসাম স্টেশনে রেলমন্ত্রী উপস্থিত থেকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেন। শতভাগ ডাবল লাইন হয়ে যাওয়ায় ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের মাধ্যমে আগের চেয়ে দ্বিগুণ ট্রেন পরিচালনা করা সম্ভব হবে। স্বাভাবিকভাবেই সড়কপথের ওপর নির্ভর কমবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল রুট বাংলাদেশ রেলওয়ের সবচেয়ে লাভজনক রুট বলে বিবেচিত হবে। যাত্রীরা একই দিন এক নগরী থেকে আরেক নগরীতে এসে কাজ শেষে ফিরতে পারবেন। বাংলাদেশ রেলওয়েকে লোকসানি প্রতিষ্ঠান থেকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার ক্ষেত্রে ঢাকা-চট্টগ্রাম ডাবল লাইন তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখবে। আমরা আশা করব- রেলপথে ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াত স্বাচ্ছন্দ্য করতে কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ নেবে।
রেল সেক্টরে টেকসই উন্নয়নের জন্য সরকার দীর্ঘ ৩০ বছরের মাস্টারপ্ল্যান অনুমোদন করেছে। মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী যেসব কাজ চলমান রয়েছে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, পদ্মা সেতু রেল লিংক, রামু হয়ে কক্সবাজার, কক্সবাজারের দোহাজারী নির্মাণ, মিয়ানমার সীমান্ত রেললাইন, খুলনা-মোংলা বন্দরের রেললাইন, বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতু নির্মাণ এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইস্পিড রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প ও অন্যান্য। উল্লিখিত প্রকল্পগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে। অন্যদের মাঝে সরকার যে ৮৮টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে, তার সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপন করার পরিকল্পনাও রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে আঞ্চলিক রেল যোগাযোগ নেটওয়ার্কের আওতায় রয়েছে নেপাল, ভুটান ও ভারতের একটি অংশ। আর যেসব করিডর দিয়ে রেল যোগাযোগ বন্ধ ছিল তার উন্নয়ন ঘটিয়ে উন্মুক্ত করা হবে।
আয়তন ছোট হলেও ১৭ কোটি মানুষের এই দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। শুধু খাদ্যেই নয়, অনেক ক্ষেত্রে আমাদের উন্নয়ন বহির্বিশ্বে বিশেষভাবে প্রশংসিত-ঈর্ষণীয়ও বটে। তবে যোগাযোগব্যবস্থা এখনো তেমনভাবে উল্লম্ফন ঘটাতে পারেনি। চোখে পড়ার মতো রাস্তাঘাটের বেশ কিছু উন্নয়ন, সম্ভবত কিছুদিনের মধ্যেই দৃশ্যমান হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।
আওয়ামী লীগ সবকটি নির্বাচনী ইশতেহারে রেল যোগাযোগ বড় প্রত্যাশার কথা ঘোষণা করেছিল। ক্ষমতার দেড় দশকে তা অনেকটা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছে। বিদেশী ঋণ ছাড়াই পদ্মা সেতু ও পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ দেয়ার মত বড় বড় মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঢাকা-চট্টগ্রাম ডাবল লেইন, দোহাজারী-কক্সবাজার রেল লেইন, ঢাকা মেট্রোরেল, যমুনা নদীর উপর নির্মিতব্য নতুন রেল সেতু, কালুরঘাট রেলসেতু অন্যতম। জানা যায়, সরকার রেল যোগাযেগ উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে ২০ বছরের উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে।
রেলমন্ত্রী মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আড়াই লাখ কোটি টাকার ২০ বছর মেয়াদী প্রকল্পের মধ্যে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারকে। সৈকত সিটি কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণের কর্মযজ্ঞ প্রায় শেষের দিকে, আগামী সেপ্টেম্বর নাগাদ এ রেল লাইনটিতে রেল চলাচলের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া সারা দেশে ডুয়েল গেজ রেলপথ স্থাপনের মাধ্যমে পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে পশ্চিমাঞ্চলের সরাসরি ট্রেন যোগাযোগ, বঙ্গবন্ধু সেতুতে রেল লাইন স্থাপন, যমুনা নদীর উপর বাহাদুরাবাদ-ফুলছড়ি এলাকায় আরেকটি রেল সেতু নির্মাণ পরিকল্পনা রয়েছে এই ২০ বছর মেয়াদী এই মাস্টার প্ল্যানে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোরে হাইস্পীড ট্রেন চলাচলের সম্ভাব্যতা যাচায়ের কাজ চলছে। স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ব্রডগেজ রেল লাইন নির্মাণ কাজ বাস্তবায়িত হচ্ছে। শুধু রেল নয়, দেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও নতুন নতুন মাইলফলক হচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সামগ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের বিকল্প নেই। পরিবহন ব্যবস্থা যে দেশে যত সহজ সেই দেশের অর্থনৈতিক প্রবাহও বেশি। সম্প্রতি বাংলাদেশ এক্ষেত্রে যুগান্তকারী উন্নয়ন ঘটেছে। তবে ট্রেন দুর্ঘটনা রোধে কর্তৃপক্ষকে আরো সতর্ক হতে হবে। আধুনিক ও অটোমেশন পদ্ধতিতে সিগনেল ব্যবস্থা এবং প্রতিটি গেইটে নিরাপত্তা জোরদার করতে পারলে রেল যোগাযোগ সম্পূর্ণ নিরাপদ বাহন হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছে আরো বেশী আকর্ষনীয় হয়ে উঠবে। রেল যোগাযোগের উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের এ ধারা অব্যাহত থাক-এমনটি প্রত্যাশা।
লেখক: দয়াল কুমার বড়ুয়া, কলামিস্ট ও জাতীয় পার্টি নেতা, সভাপতি, চবি অ্যালামনাই বসুন্ধরা। সংসদ সদস্য প্রার্থী ঢাকা-১৮ আসন।