দয়াল কুমার বড়ুয়া
বর্ষা এলেই চট্টগ্রাম মহানগরের বাসিন্দারা চরম আতঙ্কে দিন কাটায়। একটু ভারি বৃষ্টি হলেই রাস্তায় কোমর সমান পানি জমে। বাড়িঘরেও পানি ঢুকে যায়। চলতি মাসের শুরুতেই প্রায় এক সপ্তাহ ভুগেছে চট্টগ্রামের মানুষ।
কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে ডুবে গিয়েছিল বন্দরনগরী। ব্যবসাকেন্দ্র ও বাড়িঘরে পানি ঢুকে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ৫১ কিলোমিটার সড়কের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ শতকোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সেই দুর্ভোগের রেশ কাটতে না কাটতেই আবারও মাত্র এক দিনের বৃষ্টিতে ডুবেছে বন্দরনগরী। গত রবিবার ছিল এইচএসসি পরীক্ষা। কোমর সমান পানি পেরিয়ে শিক্ষার্থীদের কেন্দ্রে যেতে হয়েছে। বোর্ড কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে ২৯টি কেন্দ্রের পরীক্ষা এক ঘণ্টা দেরিতে শুরু করে।
একই সঙ্গে ঘটেছে পাহাড়ধসের ঘটনা। রবিবার ভোরে নগরীর পাঁচলাইশ থানার ষোলশহর এলাকায় পাহাড়ধসে মাটিচাপা পড়ে ঘুমন্ত অবস্থায় এক বাবা ও তাঁর সাত মাস বয়সী মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছে আরো দুজন। পাশাপাশি নগরীর আগ্রাবাদের রঙ্গীপাড়া এলাকায় সড়কের পাশে থাকা নালায় পড়ে মারা গেছে দেড় বছর বয়সী এক শিশু।
প্রতিবছর বর্ষায় কয়েকবার করে ডুবছে চট্টগ্রাম মহানগরী।
প্রতিবারই জলাবদ্ধতায় রাস্তাঘাট ভেঙে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে। মানুষের দুর্ভোগ চরমে ওঠে। এর প্রধান কারণ নগরীর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা প্রায় অচল হয়ে পড়া। বছরের পর বছর জলাবদ্ধতা দূর করার একই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, কিন্তু জলাবদ্ধতা দূর হয় না। আর বড় জলাবদ্ধতা হলেই পরস্পরকে দায়ী করেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) কর্তাব্যক্তিরা। এই অবস্থায় ভারি বৃষ্টির কারণে রবিবার সকাল থেকে নগরীর প্রধান সড়কের মুরাদপুর শুলকবহর এলাকা থেকে বহদ্দারহাট, বহদ্দারহাট বাদুরতলা থেকে চকবাজার তেলিপট্টি মোড়, বন্দর সংযোগ সড়কের হালিশহর নয়াবাজার, কাপাসগোলা এলাকার সড়ক ও অলিগলি, রাহাত্তারপুল, চকবাজার কাঁচাবাজারের পাশের সড়ক, ষোলশহর, বিবিরহাট, অক্সিজেনসহ বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
চট্টগ্রাম মহানগরীতে গত ১৬ বছরে পাহাড়ধসে দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তার পরও এমন করুণ মৃত্যু রোধে কর্তৃপক্ষের যথাযথ উদ্যোগ দেখা যায় না। পাহাড়ধসে মৃত্যুর সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে ২০০৭ সালে। আর তাতে মারা যায় ১২৭ জন। তখন এবং পরবর্তীকালেও অনেক তদন্ত কমিটি হয়েছে। সেসব কমিটি অনেক সুপারিশ করেছে, কিন্তু সেসবের বাস্তবায়ন হয়েছে খুব কম। জানা যায়, এক শ্রেণির সরকারি কর্মচারীর সহায়তায় কিছু প্রভাবশালী লোক পাহাড়ের নিচে সরকারি জমিতে খুপরি ঘর তৈরি করে ভাড়া দেয়। ভাড়া কম হওয়ায় দরিদ্র লোকজন সেখানে গিয়ে ভিড় জমায়। তাদেরই ভাগ্যে নেমে আসে এমন করুণ মৃত্যু।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রাম। এর এমন পরিণতি কোনোভাবেই কাম্য নয়। জলাবদ্ধতা নিরসন ও পাহাড়ধস রোধে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
জলাবদ্ধতার কারণে চট্টগ্রামে পূর্বনির্ধারিত এইচএসসি পরীক্ষা এক ঘণ্টা পর শুরু হয়। চট্টগ্রামসহ তিন বোর্ডের প্রথম চারটি পরীক্ষা জলাবদ্ধতার কারণে স্থগিত করা হয়েছিল। রবিবার যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কোথাও কোমরপানি, কোথাও হাঁটুপানি মাড়িয়ে পরীক্ষার্থীদের কেন্দ্রে আসতে হয়েছে। প্রবল বর্ষণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনসহ অন্যান্য যান চলাচল বন্ধ থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২টি বিভাগের ২৪টি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। পাহাড়ধস নিয়ে সতর্ক থাকতে ক্যাম্পাসে অবস্থিত কলোনিগুলোতে মাইকিং করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ভারী বর্ষণে পুরোপুরি তলিয়ে যায় চট্টগ্রামের ফতেয়াবাদ স্টেশন। এ কারণে রবিবার শহর থেকে কোনো শাটল ট্রেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে যায়নি। অন্যদিকে বৃষ্টিপাতে হাটহাজারীর নন্দীরহাট প্লাবিত হওয়ায় চট্টগ্রাম-হাটহাজারী মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকে। এতে ক্যাম্পাসে পৌঁছাতে দুর্ভোগ পোহাতে হয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা অবসানে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করার পরও এর ফাঁদ থেকে বেরোতে পারছে না নগরবাসী। এ দুর্ভোগের অবসানে কোথায় কোথায় ত্রুটি তা নির্ধারণ করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: দয়াল কুমার বড়ুয়া, কলামিস্ট ও জাতীয় পার্টি নেতা, সভাপতি, চবি অ্যালামনাই বসুন্ধরা। সংসদ সদস্য প্রার্থী ঢাকা-১৮ আসন।