‘নিজের জমানো ৮০ হাজার টাকা এমটিএফইতে বিনিয়োগ করেছিলাম। স্বপ্ন ছিল কিছু লাভ হবে, তারপর সে টাকা নিজের প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে স্বাবলম্বী হবো। কিন্তু তা আর হলো না। টাকাগুলো নিয়ে লাপাত্তা হয়ে গেল ওরা’— কথাগুলো বলছিলেন নারী উদ্যোক্তা রেহানা বেগম।
তিনি বলেন, দেশে যেন হুটহাট কোনো অনলাইন ভিত্তিক অ্যাপস খুলে কেউ এসব এমএলএম ব্যবসা করতে না পারে, সে বিষয়ে সরকার যেন উদ্যোগ নেয়। তাহলে আমাদের মতো মানুষকে আর ঠকতে হবে না।
রেহানার মতো এমন হতাশা আর আর্তনাদ এখন অনলাইনভিত্তিক এমএলএম প্রতিষ্ঠান এফটিএফই- এর লাখো গ্রাহকদের কণ্ঠে। সম্প্রতি দেশের লাখো গ্রাহকদের হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে অনলাইন জগৎ থেকে লাপাত্তা হয়ে যায় এ প্রতিষ্ঠানটি। সংশ্লিষ্ট অনেকের ধারণা প্রতিষ্ঠানটি হাতিয়ে নিয়েছে ১০-১১ হাজার কোটি টাকা।
প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে বহু স্তরভিত্তিক মাল্টি লেভেল মার্কেটিং ব্যবসায় জড়িয়ে গ্রাহকদের সর্বশান্ত হওয়ার এমন ঘটনা দেশে একেবারে নতুন নয়৷ শুরুটা সেই ডেসটিনি ও যুবকের হাত ধরে। ডেসটিনি-যুবকে লোভনীয় আয় আর গ্রাহক বৃদ্ধি করে মোটা কমিশনের আশায় জমানো অর্থ বিনিয়োগ করে পথে বসতে হয়েছিল লাখ লাখ গ্রাহককে। বেহাত হয়েছিল প্রায় ৪৫ লাখ গ্রাহকের হাজার হাজার কোটি টাকা।
আরেক এমএলএম প্রতিষ্ঠান যুবকের তিন লাখ চার হাজার গ্রাহকের বিনিয়োগ ছিল দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও প্রতারিত গ্রাহকের হিসাব অনুযায়ী, বিভিন্ন এমএলএম প্রতিষ্ঠান ও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কাছে মানুষের প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা আটকা। এসব প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় এক কোটি।
ডেসটিনি-যুবকের প্রতারক কর্ণধাররা বহু আগেই গ্রেফতার হয়ে কারাগারে। কিন্তু অনলাইনের এই যুগে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসায়ীরা পেতে বসলো নতুন আঙ্গিকে পুরনো ফাঁদ। করোনাকালে লাখো মানুষ যখন চাকরি হারিয়ে বেকার, তখন ঘরে বসে ভালো আয়ের লোভনীয় প্রচারণায় প্রলুব্ধ হয়ে ডেসটিনির সাবেক কর্মকর্তাদের গড়া এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস নামক এমএলএম প্রতিষ্ঠানে জড়াতে শুরু করে লাখো যুবক।
একপর্যায়ে যুবকদের পাশাপাশি বয়সীরাও শুরু করে বিনিয়োগ। ঘরে বসে বিজ্ঞাপন দেখে প্রতিদিন মোটা অঙ্কের আয় হবে এমন প্রচারণা চালিয়ে দ্রুতই সারাদেশে বিস্তৃতি পায় প্রতিষ্ঠানটি। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি এসপিসিকে। হু হু করে সারাদেশে লাখ লাখ মানুষ বিনিয়োগ করে প্রতিষ্ঠানটিতে। বিশেষত রাজধানী ও দক্ষিণবঙ্গে সবচেয়ে বেশি বিস্তার লাভ করে প্রতারক এই প্রতিষ্ঠানটি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে ছিল না কোনো কাগজপত্রের ব্যবহার। মূলত এসপিসির নিজস্ব অ্যাপসে টাকা ক্যাশ ইন করা হতো প্রতিষ্ঠানটির এজেন্টদের মাধ্যমে। কিন্তু তাতেও দেওয়া হতো না কোনো রশীদ বা কাগজপত্র। মূলত অ্যাকাউন্ট খুলে প্রতিষ্ঠানটির নামে দেখানো কিছু পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখার মাধ্যমে টাকা হবে বলে দাবি করতো এটির কর্মকর্তারা। ঠিক তেমনিভাবে সম্প্রতি উধাও হওয়া এমটিএফইতেও বিনিয়োগ করতে হতো বিকাশ-নগদের মতো ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে। বিনিয়োগে ছিল না কোনো কাগজপত্রের ব্যবহার।
এমএলএম প্রতিষ্ঠান এসপিসির কয়েকজন এজেন্ট ও গ্রাহকের সাথে কথা বলে জানা যায়, সারাদেশে নতুন যে গ্রাহকরা বিনিয়োগ করতো, সেই টাকা থেকেই লাভ দেওয়া হতো এসপিসির পুরোনো গ্রাহকদের। একপর্যায়ে অর্থপাচারের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির এমডি আলামিন প্রধান গ্রেফতার হলে নতুন গ্রাহক ঢোকা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে আর পুরনো গ্রাহকদের লভ্যাংশ দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। এ ঘটনায় মাথায় বাড়ি হয় অন্তত দশ লাখ গ্রাহকের। ক্ষতিগ্রস্তরা মামলা করলেও ফেরত পাননি তাদের অর্থ।
তবু এখানেই শেষ নয়! এসপিসি বন্ধ হওয়ার প্রাক্কালে বাজারে আসে রিং আইডি, গোল্ড রাশ, অর্ক, ইনসাফ সেভেন নামক নানা রকম অনলাইনভিত্তিক এমএলএম প্রতিষ্ঠান। প্রতারণার সাহায্যে হাতিয়ে নেয় গ্রাহকের হাজার হাজার কোটি টাকা। ডেসটিনি, যুবক, এসপিসি দেশের ভেতর অফিস খুলে কার্যক্রম চালালেও রিং আইডি, গোল্ড রাশ, টু-লাইক, গোল্ডেন লাইন, অর্ক, ইনসাফ সেভেন এগুলোর কোনো অফিস ছিল না এদেশে। বিদেশি কিছু হ্যাকার, প্রতারকগোষ্ঠী কিছু অ্যাপসের মাধ্যমে গ্রাহক জুটিয়ে হাতিয়ে নেয় এসব অর্থ।
বিভিন্ন এমএলএম প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এসব প্রতিষ্ঠানে নতুন লোক ঢোকানোর মাধ্যমেই টাকা আয় হয় পুরনোদের। নতুন গ্রাহক ঢোকা বন্ধ হওয়া মানেই আয়ের চাকা স্থবির হওয়া। সেক্ষেত্রে একদম প্রথমদিকে ঢোকা কিছু গ্রাহক লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হন নীচের দিকের সবাই।
এরই সূত্র ধরে সম্প্রতি বাংলাদেশে আসে এমটিএফই নামক আরেক চটকদার অনলাইন ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। চমকপ্রদ সব প্রলোভনে ভিড়তে থাকে গ্রাহকরা। অবশেষে শেষ রক্ষা হয়নি অতি লোভে তাঁতি নষ্ট হওয়া গ্রাহকদের। আম-ছালা দুটো নিয়েই রাতারাতি অনলাইন জগৎ থেকে উধাও হয়ে গেছে প্রতিষ্ঠানটি। ইত্যবসরে পথে বসেছেন দেশের লাখ লাখ মানুষ।
ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া গ্রাহক রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরিজীবী নাইম ইসলাম বলেন, সপ্তাহে একদিন লস হবে, আর ৬ দিনই লাভ হবে এমন চটকদার কথায় আকৃষ্ট হয়ে এখানে বিনিয়োগ করি। এখন সর্বস্ব খোয়ালাম। আসলে অনলাইনে এভাবে বিনিয়োগ করা ঠিক নয়।
অনলাইন থেকে টাকা আয় করতে বিনিয়োগ করা লাগে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে সফল ফ্রিল্যান্সার ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থী বোরহান উদ্দিন বলেন, অনলাইনে ফ্রিল্যান্সিং করে আয় করতে কোনো বিনিয়োগ বা ইনভেস্ট লাগে না। দক্ষতাকে পুঁজি করেই অনলাইন থেকে আয় করা যায়। মূলত একশ্রেণির প্রতারকরা ফ্রিল্যান্সিংয়ের কথা বলে যুবকদের বিনিয়োগ করতে বলে টাকা হাতিয়ে নেয়।
এ বিষয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার (সাইবার ইনভেস্টিগেশন এন্ড অপারেশন) মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, মানুষ লোভে পড়ে সহজেই টাকা আয় করার জন্যই কিন্তু এসব এমএলএম সাইটে টাকা ইনভেস্ট করে। লোভনীয় অফার দিয়েই এসব প্রতিষ্ঠানে টাকা ইনভেস্ট করতে বলা হয়। যারা এ ধরণের এমএলএম প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে, তারা মূলত প্রতারণার উদ্দেশ্যেই করে।
প্রতারকদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে তিনি বলেন, কাউকে এমন তৎপরতা চালাতে দেখলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানাতে হবে। যদি এ দেশের কেউ দেশের বাইরে থেকেও এমন প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে, তাহলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে দেশে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নিবো। প্রয়োজনে যে দেশে তারা থাকবে, পুলিশ হেডকোয়ার্টারের মাধ্যমে সে দেশের সাথে যোগাযোগ করে তাদের অবস্থান শনাক্ত করবো।