ডেস্ক: প্রায় ছয় বছর আগে মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটির একটি বাড়ির নিচতলার গ্যারেজের পাশেই ছোট্ট এক কক্ষে সস্ত্রীক ভাড়া থাকতেন তারেকুজ্জামান রাজীব। ভাড়া দিতেন ছয় হাজার টাকা। তখনো তিনি কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন না। এখনো করেন না। কিন্তু পরিবার নিয়ে থাকেন একই হাউজিং এলাকায় নিজের ডুপ্লেক্স বাড়িতে। আগে একটি মোটরসাইকেল নিয়ে রাজীব চলাফেরা করতেন। এখন কোটি টাকা দামের বিলাসবহুল গাড়িতে চড়েন। নতুন নতুন ব্র্যান্ডের গাড়ি কেনার নেশা রয়েছে তাঁর। যেখানেই যান, তাঁর গাড়িবহরের সামনে-পেছনে থাকে শতাধিক সহযোগীর একটি দল। এসব কারণে মোহাম্মদপুর এলাকায় এখন রাজীব যুবরাজ হিসেবেই পরিচিত।
এই তারেকুজ্জামান রাজীব হলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। ২০১৪ সালে কাউন্সিলর হওয়ার পরই যুবলীগের এই নেতার অবস্থা বদলে যেতে থাকে। এই কয়েক বছরে তিনি শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন বলে জানা গেছে। জমি দখল, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ পাওয়া গেছে তাঁর বিরুদ্ধে। রাজীবের সব অপকর্মের সঙ্গী যুবলীগ নেতা শাহ আলম জীবন, সিএনজি কামাল, আশিকুজ্জামান রনি, ফারুক ও রাজীবের স্ত্রীর বড় ভাই ইমতিহান হোসেন ইমতিসহ অর্ধশত ক্যাডার।
জানা গেছে, কাউন্সিলর হওয়ার পর রাজীবের লোকজন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা পাইন আহমেদকে মারধর করে। ঘটনাটি প্রধানমন্ত্রী জানার পর মোহাম্মদপুর থানা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়কের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয় রাজীবকে।
কিন্তু পরে তাঁর বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। এমনকি তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, সদ্য বহিষ্কৃত কেন্দ্রীয় যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমানের মাধ্যমে এক কোটি টাকা দিয়ে পদটি নিয়েছেন তিনি।
সম্প্রতি ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকেই খুব বেশি দেখা যায় না রাজীবকে। গ্রেপ্তারের ভয়ে তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা জানান।
গতকাল শনিবার দুপুরে সরেজমিনে মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটিতে গিয়ে কথা হয় খান শাহাদাত হোসেনের সঙ্গে। তাঁর বাড়িতেই ভাড়া থাকতেন রাজীব। তিনি বলছিলেন, ‘রাজীব আমার বাড়িতে বছর দুয়েক ছিলেন। এখন আমার গলির তিনটি গলির পরই রাজীব নিজেই বিলাসবহুল বাড়ি করেছেন। এমন বাড়ি আমাদের হাউজিংয়ে আর নেই।’
মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটির ১ নম্বর সড়কের ৩৩ নম্বর প্লটে রাজীবের ডুপ্লেক্স বাড়ি। জানা গেছে, পাঁচ কাঠা জমির ওপর বাড়িটি করতে খরচ হয়েছে ছয় কোটি টাকা। গতকাল দুপুর পৌনে ১টার দিকে রাজীবের বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে রিকশা নিয়ে অপেক্ষা করছেন চালক আয়নাল হোসেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জনতার কমিশনার রাজীব স্যারের কাছে আইছি, কিছু সাহায্যের জন্য। তিনি খুব দানশীল মানুষ।’ পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা ষাটোর্ধ্ব সেকেন্দার আলী শেখ নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘রাজীবের কপালই কপাল। কয় বছর আগে কী ছিল, আর এখন কী হইছে। মনে হয় আলাদিনের চেরাগ পাইছে।’
রাজীবের বাড়ির জমি নিয়ে রয়েছে অভিযোগ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার কয়েকজন বাড়ির মালিক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাজীব যেখানে বাড়িটি করেছেন, সেই জমির মালিক ছিলেন বারী চৌধুরী। এই জমির কিছু অংশে পানির পাম্প বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু জমিটি কৌশলে নিজেই নিয়ে নেন কাউন্সিলর।’ তাঁরা বলছিলেন, গত চার বছরে রাজীব ৮-১০টি নামিদামি ব্র্যান্ডের গাড়ি কিনেছেন। মার্সিডিস, বিএমডাব্লিউ, ক্রাউন প্রাডো, ল্যান্ডক্রুজার ভি-৮, বিএমডাব্লিউ স্পোর্টস কারসহ নামিদামি সব ব্র্যান্ডের গাড়িই এসেছে রাজীবের হাতে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জানান, কাউন্সিলর রাজীবের বাবা তোতা মিয়া হাওলাদার মোহাম্মদপুরে মোহাম্মদী হাউজিং সোসাইটি ও চান মিয়া হাউজিং এলাকায় তিন সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন। এর মধ্যে রাজীব মেজো। পেশায় রাজমিস্ত্রি বাবার সঙ্গে কাজ করার পাশাপাশি রাজীব মোহাম্মদীয়া সুপার মার্কেটে টং দোকানও করেছেন।
এই মার্কেটের কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, অবৈধভাবে প্লট ও জমি দখল করে বিক্রি করে টাকা কামিয়েছেন রাজীব। এ ছাড়া দখলবাজি, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্ম করে বিত্তের মালিক হয়েছেন তিনি।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদপুর, বেড়িবাঁধ, বসিলা এলাকার পরিবহনে চাঁদাবাজি রাজীবের নিয়ন্ত্রণে। অটোরিকশা, লেগুনা, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও বাস থেকে প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকা চাঁদা তোলে তাঁর লোকজন। পাঁচ বছর ধরে এলাকার কোরবানির পশুর হাটের ইজারাও নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন রাজীব।
ওয়ার্ড যুবলীগ নেতা থেকে কাউন্সিলর হওয়া রাজীবের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মোহাম্মদপুরের কাটাসুরের নামার বাজারের দখল এখন তাঁর হাতে। কাউন্সিলর হওয়ার পর সাবেক কাউন্সিলর ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি বজলুর রহমানকে হটিয়ে বাজারের দায়িত্ব নেন তিনি। উন্নয়নের কথা বলে বাজার কমিটির সেক্রেটারি মিন্টু আলম খানের সহযোগিতায় ১৫৭টি দোকানের মালিকের কাছ থেকে প্রায় আড়াই কোটি টাকা নিয়েছেন রাজীব কিন্তু কোনো কাজই করেননি।
জানা গেছে, রহিম ব্যাপারী ঘাট মসজিদের সামনে আব্দুল হক নামের এক ব্যক্তির ৩৫ কাঠার একটি প্লট যুবলীগের কার্যালয়ের নামে দখলে করেছেন রাজীব। এর আগে ওই জমির পাশেই জাকির হোসেনের সাত-আট কাঠার একটি প্লট দখল করে রেখেছিলেন তিনি। পরে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে জমি উদ্ধার করেন জাকির।
মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের পাশের ময়ূর ভিলার মালিক রফিক মিয়ার কয়েক কোটি টাকা দামের জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে রাজীব ও তাঁর লোকজনের বিরুদ্ধে। পাবলিক টয়লেট নির্মাণের মাধ্যমে জমিটি দখল করা হয়। সেখানে পাঁচটি দোকান তুলে ভাড়া দিয়ে টাকা নিচ্ছে তারা।
ঢাকা রিয়েল এস্টেটের ৩ নম্বর সড়কের ৫৬ নম্বর প্লটের মালিক ছিলেন আব্দুল করিমের স্ত্রী। সেই প্লটটি কাউন্সিলর রাজীবের ক্যাডার ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম জীবনসহ কয়েকজন মিলে দখল করে এক কোটি ১৪ লাখ টাকা বিক্রি করেছে।
মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের সামনে আল্লাহ করিম মসজিদ ও মার্কেটের নিয়ন্ত্রণও রাজীবের হাতে। কাউন্সিলর হওয়ার পর মসজিদ ও মার্কেট পরিচালনা কমিটির সভাপতি করেন তাঁর স্ত্রীর বড় ভাই ইকরাম হোসেনকে। অভিযোগ রয়েছে, সভাপতি হয়েই ইকরাম মসজিদ মার্কেটের আয় নানাভাবে হাতিয়ে নেন। মার্কেটের ৩৯টি দোকান বিক্রি করে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও করছেন তিনি।
অভিযোগ রয়েছে, রাজীবের চাচা ইয়াসিন হাওলাদার চাঁদ উদ্যানের ৩ নম্বর রোডের রহিমা আক্তার রাহি, বাবুল ও মো. জসিমের তিনটি প্লট দখল করেছেন। এ নিয়ে মামলাও হয়েছে।
৩৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আইনজীবী হানিফ মিয়া অভিযোগ করেন, চাঁদ উদ্যানের আড়াই কাঠার একটি প্লট তিনি বায়না করেছিলেন। কিন্তু ইয়াসিন হাওলাদার ও তাঁর ছেলে বিপ্লব হাওলাদার বাবু জমির মালিকের কাছ থেকে জোর করে রেজিস্ট্রি করে নিয়েছেন। প্রতিবাদ করায় তাঁর ওপর হামলাও করেছিলেন তাঁরা।