নিজস্ব প্রতিবেদক,সিটিজেন নিউজ: কথায় কথায় সাংবাদিকদের চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হচ্ছে। বিভিন্ন টেলিভিশন ও পত্রিকায় সাংবাদিকদের নিয়মিত বেতন ও ইনক্রিমেন্ট (বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি) দেয়া হচ্ছে না। গণমাধ্যম আইন না থাকায় মালিক পক্ষের অনৈতিক কর্মকাণ্ড চলছেই। অথচ গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রের কাছ থেকে বিভিন্ন সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে মালিকপক্ষ।
এ কারণে গণমাধ্যম কর্মীদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় অনৈতিকভাবে চাকরি থেকে ছাঁটাই বন্ধে অবিলম্বে গণমাধ্যম আইন করার দাবি জানিয়েছেন সাংবাদিক নেতারা। সেই সঙ্গে আগামী রোজার ঈদের আগেই নবম ওয়েজ বোর্ড রোঁয়েদাদ ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন তারা।
রোববার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) আয়োজিত এক বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে এসব দাবি জানানো হয়। গণমাধ্যমে অনৈতিক ছাঁটাই বন্ধ, নিয়মিত বেতন প্রদান, অবিলম্বে গণমাধ্যম কর্মী আইন পাস ও নবম ওয়েজবোর্ড রোঁয়েদাদ ঘোষণার দাবিতে এ সমাবেশের আয়োজন করে সংগঠনটি।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি মোল্লা জালাল বলেন, কেউ ভালো নেই এবং ভালো থাকার সম্ভাবনাও নেই। এই যে সামনে টেলিভিশনের ক্যামেরাপারসন বন্ধুরা আজকে ক্যামেরা নিয়ে এসেছেন, কালকে অথবা এই অ্যাসাইমেন্ট শেষে অফিসে যেতেই শুনবেন কি না- তোমার অফিসে আসার প্রয়োজন নেই।
তিনি বলেন, সাংবাদিকদের চাকরি কারা খায়? সাংবাদিকরা খায়। আগামীকাল এখানে (প্রেস ক্লাবের সামনে) প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ সমাবেশ হবে। আপনারা যদি মনে করেন সম্মানজনকভাবে এই পেশায় টিকে থাকবেন, যদি মনে করেন জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা প্রয়োজন, তাহলে নিজ দায়িত্বে সমাবেশে যোগ দেবেন।
মোল্লা জালাল আরও বলেন, আমরা কর্মসূচি দেব। কী কর্মসূচি? কারও দয়া-দাক্ষিণ্যে নয়, রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন অনুযায়ী গণমাধ্যম চলতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। আইন অমান্য করে যে প্রতিষ্ঠান চলবে সাংবাদিকরা সেই প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেবেন।
ডিইউজে সভাপতি আবু জাফর সূর্য বলেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাজপথ থেকে যাব না। আমরা পেশায় সর্বোচ্চ সততা ও পরিশ্রম করেই টিকে থাকতে চাই। কিন্তু আমাদের চোখে ধুলা দিবেন, আমাদের ধোকা দেবেন তা সহ্য করা হবে না, মেনে নেয়া হবে না।
তিনি আরও বলেন, মন্ত্রিপরিষদে নবম ওয়েজ বোর্ডের বিষয়ে যে কমিটি করা হয়েছে, সেখানে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাহেবকে। আমি ওনার প্রতি শ্রদ্ধা রাখছি, ওনার অসুস্থতার প্রতি আমরা সহনুভূতি প্রকাশ করছি। কিন্তু কথাটা হলো এই, আমাদের মহাসচিব বলেছেন তার কাছে তথ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দেশে ফিরলে ওয়েজ বোর্ডের একটি সুরাহা হবে।
সূর্য বলেন, পদ্মা সেতুর কাজ কি বন্ধ আছে? সড়কের কোনো উন্নয়ন কাজ কি বন্ধ আছে? মন্ত্রণালয়ের কোন কাজ বন্ধ আছে? মন্ত্রণালয়ে কি তালা দেয়া আছে? তাহলে আমাদের কাজটা বন্ধ হবে কেন। এখানে আমাদের রুটি-রুজির প্রশ্ন। আমরা চলতে পারছি না, আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাচ্ছে।
বেশ কয়েকটি টেলিভিশন ও পত্রিকার নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, গণমাধ্যমের কোনো আইনি কাঠামো নেই, যে কারণে তাদের রোখা যাচ্ছে না। পত্রিকার মালিকদের আমি বলি নবাব। এই নবাবের কথায় যদি তথ্য মন্ত্রণালয় বলে নবম ওয়েজ বোর্ড পরে ঘোষণা করবে কিংবা অ্যাটকোর কারণে যদি বলে গণমাধ্যম আইন পরে পাস করবে, তাহলে এসব ভাওতাবাজি চলবে না। আমরা বিশ্বাস করতে চাই এ সরকার সাংবাদিকবান্ধব সরকার, এই সরকার গণমাধ্যমবান্ধব সরকার।
বিএফইউজের মহাসচিব শাবান মাহমুদ বলেন, সাংবাদিকদের মধ্যে শত্রু সমাজ ঢুকেছে। সাংবাদিক ইউনিয়নের চলমান নেতৃত্বের জন্য অদৃশ্যভাবে যারা হুমকি, অদৃশ্যভাবে যারা শয়তানি করাচ্ছে সেই ডেভিল চক্রকে তিনটি পর্বে ভাগ করেছি। একটি হচ্ছে, খন্দকার মোশতাক যেভাবে বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন হয়ে, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে দুর্বল করতে চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছিল। ঠিক একইভাবে বিএফইউজে ও ডিইউজের মধ্যে একটি চক্র মোশতাক বাহিনীর প্রেতাত্মা হয়ে আমাদের দুর্বল করার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, আমি আর একটি চক্র দেখেছি, তারা হলো এলিট ফোর্স। তারা বিভিন্ন জায়গায় বিএফইউজে ও ডিইউজেকে গুরুত্বহীন প্রমাণ করার জন্য রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সর্বোচ্চ কর্মকর্তাদের সঙ্গে, মন্ত্রীদের সঙ্গে এমনকি সুযোগ পেলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের সংগঠনকে বিতর্কিত করার জন্য নানা ধরনের মিথ্যা অপবাদ দেয়।
শাবান মাহমুদ বলেন, আমি আর একটি পর্ব দেখেছি, যেটা অত্যন্ত ভয়াবহ, সেটা হলো মালিক পক্ষের দালাল। এই দালালরা আমাদের অনেক সমীহ করে কথা বলেন। কিন্তু মালিক পক্ষকে বোঝাতে চান বিএফইউজে ও ডিইউজে বিভক্ত সংগঠন। তাদের কিছু করার ক্ষমতা নেই।
তিনি আরও বলেন, অন্যায়ভাবে গণমাধ্যম কর্মীদের ছাঁটাই করা চলবে না। কোনো মালিক পক্ষের ইচ্ছায় সাংবাদিক বন্ধুদের চাকরিচ্যুত মেনে নেয়া হবে না। কোনো দালাল চক্রের অশুভ চক্রান্ত সফল হতে দেয়া হবে না। কোনো মোশতাক বাহিনীকে এই সংগঠনের সদস্য পদ বহাল রাখা যাবে না। কোনো ব্রাহ্মণ সমাজকে তাদের ইচ্ছা পূরণ করতে দেয়া হবে না। কোনো অজুহাত নয়, আগামী ঈদের আগেই নবম ওয়েজ বোর্ডের প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে।
ডিইউজির সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরী বলেন, টেলিভিশনগুলোতে অনৈতিক কর্মকাণ্ড চলছে। মালিক পক্ষ তাদের যে অনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন, সেখানে কোনো না কোনোভাবে রাষ্ট্রপক্ষের সহযোগিতা তারা পাচ্ছেন। আমরা সরকার পক্ষকে বারবার বলেছি, আমাদের অধিকার খর্ব হচ্ছে। আমাদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় কী কী করার দরকার, তা বারবার বলেছি। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ বা সরকার পক্ষ আমাদের কথাগুলোর মূল্যায়ন করেছি। বরং মালিক পক্ষের ইশারায় নবম ওয়েজ বোর্ড হবে কি হবে না, সেদিকে তারা এগিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আমাদের রাজপথে নেমে আসা ছাড়া উপায় নেই।
তিনি বলেন, আজকে টেলিভিশনগুলোতে, পত্রিকাগুলোতে অব্যাহতভাবে কর্মী ছাঁটাই চলছে। সংবাদ বিভাগ বন্ধ করার হুমকি দিয়ে বা মিথ্যা কথা বলে আমাদের সাংবাদিকদের, ক্যামেরাপারসনদের চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে। থোক টাকা দিয়ে অথবা না দিয়ে তাদের বিদায় করা হচ্ছে। শ্রম আইন মানা হচ্ছে না, ওয়েজ বোর্ড মানা হচ্ছে না। অথচ রেগুলেটরি বডি হিসেবে তথ্য মন্ত্রণালয়ের এগুলো দেখার কথা ছিল। তথ্য মন্ত্রণালয় তাদের এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারছে না অথবা পালন করার চেষ্টা করছে না।
তিনি আরও বলেন, মালিকরা সরকারের কাছ থেকে সব সুযোগ-সুবিধা নেবে। তারা শুধু বিজ্ঞাপন সুবিধা না, জায়গার সুবিধা নেয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কথা বলে প্রায় বিনামূল্যে জায়গা নেবেন, আর আমার কর্মীরা তাদের বেতন পাবেন না, তাদের ইনক্রিমেন্ট হবে না সেটি আমরা আর দেখতে চাই না। আমাদের নেতাদের কঠোর কর্মসূচি দিতে হবে। প্রয়োজনে এখানে স্থায়ী মঞ্চ করতে হবে।
ডিইউজের যুগ্ম-সম্পাদক আক্তার হোসেনের সঞ্চালনায় বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে আরও বক্তব্য রাখেন বিএফইউজের সহ-সভাপতি ইশতিয়াক রেজা, ডিইউজের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাজু আহমেদ, ঢাকা সাব-এডিটরস কাউন্সিলের সাবেক সভাপতি আশরাফুল ইসলাম প্রমুখ।