বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক: প্রতিষ্ঠার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের দ্বারপ্রান্তে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি)। দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ আবাসিক এই বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রথম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন প্রখ্যাত রসায়নবিদ অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমেদ। তারপর আরও ১৮ জন এই পদে আসীন হয়েছেন। তাদের মধ্যে পাঁচজনকে আন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে।
১৯৯০ সালের পর থেকে বেশির ভাগ সময়ই উপাচার্য অপসারণ বা এই পদে নতুন কাউকে নিয়োগের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়টি অস্থির ছিল। এখানে ১৯৯৩ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যেই দায়িত্ব পালন করেছেন ১২ জন উপাচার্য। এদের মধ্যে শুধু দুজন ছাড়া আর কেউই তাদের পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব শেষ করতে পারেননি।
এদের মধ্যে অধ্যাপক কাজী সালেহ আহমদ (১৯৮৮-৯৩), অধ্যাপক আলাউদ্দিন আহমেদ (১৯৯৮-৯৯), অধ্যাপক জসিম উদ্দিন আহমদ (২০০১-০৪), অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির (২০০৯-১২) এবং সর্বশেষ অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেনকে (২০১২-১৪) আন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়।
উপাচার্য পতনের এসব আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে সহিংসতার সৃষ্টি হয়েছে। উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন যেন জাবিতে পেয়েছে ‘ঐতিহাসিক’ উপাখ্যান।
সর্বশেষ ২০১৪ সালে দেশের প্রথম নারী হিসেবে অধ্যাপক ফারজানা ইসলামকে উপাচার্যের দায়িত্ব দেয়া হয়। ২০১৮ সালে প্রথম মেয়াদের দায়িত্বকাল শেষে তাকে পুনরায় উপাচার্যের দায়িত্ব দেন রাষ্ট্রপতি।
বর্তমান উপাচার্যকে নিয়েও তীব্র হয়েছে আন্দোলন। উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগে প্রায় তিন মাস যাবৎ তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি অংশ।
এ বছরের জুলাইয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প ঘিরে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা এখন উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের অপসারণের একদফা দাবিতে গড়িয়েছে।
এই প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে তার পদত্যাগের দাবিতে নানা সময়ে আল্টিমেটাম দিয়েছেন ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’র ব্যানারে আন্দোলনরতরা। সেপ্টেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষা চলাকালীন তাকে ১ অক্টোবরের মধ্যে স্বেচ্ছায় পদত্যাগে আহ্বান জানায় তারা। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে পদত্যাগ না করায় তার অপসারণের আন্দোলনে নামেন আন্দোলনকারীরা।
তিন মাসের ধারাবাহিক এ আন্দোলনের অংশ হিসেবে গত ৪ নভেম্বর উপাচার্যের বাসভবন অবরোধ করেন আন্দোলনকারীরা। পরদিন ৫ নভেম্বর সেখানে মিছিল নিয়ে এসে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এ ঘটনায় আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ অন্তত ৩৫ জন আহত হন।
এর প্রেক্ষিতে ওইদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের এক জরুরি সভায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা ও শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশনা দেয়া হয়। পরদিন ৫ নভেম্বর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধরণের মিছিল-সমাবেশে নিষেধাজ্ঞাসহ ক্যাম্পাসে প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। এরপর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা বিরাজ করছে।
তবে প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’র ব্যানারে আন্দোলনকারীরা। তারা বলছেন, উপাচার্যের অপসারণ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন থেকে সড়বেন না।
এর আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব উপাচার্যকে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে তারা হলেন-
কাজী সালেহ আহমেদ : ছাত্রদলের এক নেতাকে বহিষ্কারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৯৯৩ সালের ২৯ জুলাই সিন্ডিকেট নির্বাচন চলাকালে শিক্ষক ক্লাবে হামলা চালায় ছাত্র সংগঠনটি। এর জেরে পদত্যাগ করেন কাজী সালেহ আহমেদ।
জানা যায়, শিক্ষকদের ওপর এই হামলায় উসকানি দিয়েছিলেন তার প্রতিপক্ষ শিক্ষকেরা। এই প্রেক্ষাপটেই বন্ধ করে দেয়া হয় শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ের সংগঠন জাকসুর কার্যক্রম। গত ২৭ বছরে নানাভাবে আন্দোলন করলেও এখন পর্যন্ত চালু করা যায়নি সেই জাকসু।
আলাউদ্দিন আহমেদ : ১৯৯৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জসিমুদ্দিন মানিকের ধর্ষণের ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে ক্যাম্পাস প্রকম্পিত হয়। এর সঙ্গে ছিল ফি বৃদ্ধিবিরোধী আন্দোলন। এসব আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন সরকার আলাউদ্দিন আহমেদকে উপাচার্যের পদ থেকে সরিয়ে দেয়।
জসিম উদ্দিন আহমদ : ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ’৭৩-এর অধ্যাদেশ লঙ্ঘন করে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল বায়েসকে সরিয়ে অধ্যাপক জসিম উদ্দিন আহমদকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। তাদের সঙ্গে যোগ দেন বিএনপিপন্থী শিক্ষকরাও। পরে শিক্ষকদের সম্মিলিত আন্দোলনের মুখে অনুষ্ঠিত হয় উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন। নির্বাচনে হেরে অধ্যাপক জসিম উদ্দিন পদ ছাড়তে বাধ্য হন।
শরীফ এনামুল কবির : নিজস্ব বলয় তৈরির জন্য গণহারে শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগ ও ছাত্র রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ ওঠে অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবিরের বিরুদ্ধে। এছাড়া ২০১২ সালের ৯ জানুয়ারি ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতেই আরেক ছাত্রলীগ কর্মী জোবায়ের নিহত হন। এসব অভিযোগের দায়ে শিক্ষকদের সম্মিলিত আন্দোলনে দায়িত্ব শেষ হওয়ার ৯ মাস আগেই পদত্যাগে বাধ্য হন তিনি।
মো. আনোয়ার হোসেন : ২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী আবদুল মালেক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে মারা যান। হাসপাতালে নেয়ার জন্য সময়মতো অ্যাম্বুলেন্স না পাওয়ায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসায় ও মেডিকেলে ব্যাপক ভাঙচুর চালান। হামলা ও ভাঙচুরের এই ঘটনায় উপাচার্য আনোয়ার হোসেন দায়ী করেন জামায়াত-শিবিরকে। এমনকি আওয়ামীপন্থী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদেরও তিনি জামায়াত-শিবির বলে আখ্যা দেন। এসব ঘটনায় উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলনে নামে শিক্ষক সমিতি। ৯ মাসব্যাপী আন্দোলনে শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই উপ-উপাচার্য, রেজিস্ট্রার এবং দুই দফায় উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। এ ছাড়া উপাচার্যকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা, ক্লাস বর্জন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনিক ভবন অবরোধ, সিনেট-সিন্ডিকেট ছাড়াও অন্যান্য প্রশাসনিক সভা প্রতিরোধসহ নানা কর্মসূচিতে ভেঙে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম। এরই জেরে ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি।