ধর্ম ডেস্ক: বিশেষ প্রয়োজন তথা মারাত্মক বিপদের সময় মুসলমানদের জন্য ফজরের ফরজ নামাজের দ্বিতীয় রাকাআতে রুকু থেকে দাঁড়িয়ে কুনুতে নাজেলা পড়া মুস্তাহাব। মালয়েশিয়ার প্রধান মুফতি ড. আব্দুর রহমান ওসমান দেশটির বিভিন্ন মসজিদে অবস্থানকারী তাবলিগ জামাতের সাথীদেরকে কুনুতে নাজেলা পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
কুনুতে নাজেলা কেন পড়তেন বিশ্বনবি?
মুসলমানদের উপর কোনো বিপদ-আপদ আসলে, ইসলামের শত্রুদের জন্য হেদায়েতের দোয়া কিংবা বদদোয়ার ক্ষেত্রে কিংবা বিশেষ কোনো প্রয়োজনীয় মুহূর্তে ফজরের ফরজ নামাজের দ্বিতীয় রাকাআতে রুকু থেকে দাঁড়িয়ে কুনুতে নাজেলা পড়তেন বিশ্বনবি। কুনুতে নাজেলা সম্পর্কে হাদিসে এসেছে-
>> হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের নামাজে সব সময় কুনুত (নাজেলাহ) পড়তেন না। শুধু পড়তেন কোনো জাতির জন্য দোয়া করতে বা বদদোয়া করার প্রয়োজন হলে। তিনি কুনুত পড়তেন যখন ফজরের (ফরজ) নামাজের দ্বিতীয় রাকাআতের রুকু থেকে মাথা উঠাতেন।’ (ইবনে খুজায়মা)
>> রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিপদে পতিত হলে ফজরের নামাজের দ্বিতীয় রাকাআতে রুকু থেকে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন সময় কুনুতে নাজেলা পড়েছেন।’ (বুখারি, মুসলিম)
মুসলমানদের উপর যদি কোনো ব্যাপক বালা-মুসিবত ও বিপদ আসে, তাহলে সেক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার কাছে সাহায্য কামনায় কুনুতে নাজেলা পড়া মুস্তাহাব। ফতোয়ার কিতাব শামীতে এসেছে-
‘কাফের, মুশরিক ও জালেমদের পক্ষ থেকে কিংবা আসমানি কোনো বিপদ-আপদ আসলে কুনুতে নাজেলা পড়া উচিত।’
কুনুতে নাজেলা-
اللَّهُمَّ اهْدِنَا فِيمَنْ هَدَيْتَ ، وَعَافِنَا فِيمَنْ عَافَيْتَ ، وَتَوَلَّنَا فِيمَنْ تَوَلَّيْتَ ، وَبَارِكْ لَنَا فِيمَا أَعْطَيْتَ ، وَقِنَا شَرَّ مَا قَضَيْتَ ، إِنَّكَ تَقْضِى وَلاَ يُقْضَى عَلَيْكَ ، إِنَّهُ لاَ يَذِلُّ مَنْ وَالَيْتَ وَلَا يَعِزُّ مَنْ عَادَيْتَ تَبَارَكْتَ رَبَّنَا وَتَعَالَيْتَ
اللَّهُمَّ اغْفِرْ لَنَا ، وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَالْمُسْلِمِينَ وَالْمُسْلِمَاتِ ، وَأَلِّفْ بَيْنَ قُلُوبِهِمْ ، وَأَصْلِحْ ذَاتَ بَيْنِهِمْ ، وَانْصُرْهُمْ عَلَى عَدُوِّكَ وَعَدُوِّهِمْ ، اللَّهُمَّ الْعَنْ كَفَرَةَ أَهْلِ الْكِتَابِ الَّذِينَ يَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِكَ ، وَيُكَذِّبُونَ رُسُلَكَ ، وَيُقَاتِلُونَ أَوْلِيَاءَكَ اللَّهُمَّ خَالِفْ بَيْنَ كَلِمَتِهِمَ ، وَزَلْزِلْ أَقْدَامَهُمْ ، وَأَنْزِلْ بِهِمْ بَأْسَكَ الَّذِى لاَ تَرُدُّهُ عَنِ الْقَوْمِ الْمُجْرِمِينَ بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ اللَّهُمَّ إِنَّا نَسْتَعِينُكَ وَنَسْتَغْفِرُكَ وَنُثْنِى عَلَيْكَ وَلاَ نَكْفُرُكَ ، وَنَخْلَعُ وَنَتْرُكُ مَنْ يَفْجُرُكَ بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ اللَّهُمَّ إِيَّاكَ نَعْبُدُ ، وَلَكَ نُصَلِّى وَنَسْجُدُ ، وَلَكَ نَسْعَى وَنَحْفِدُ ، نَخْشَى عَذَابَكَ الْجَدَّ ، وَنَرْجُو رَحْمَتَكَ ، إِنَّ عَذَابَكَ بِالْكَافِرِينَ مُلْحَقٌ.
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মাহদিনা ফিমান হাদাইতা, ওয়া আফিনা ফিমান আফাইতা, ওয়া তাওয়াল্লানা ফিমান তাওয়াল্লাইতা ওয়া বারিকলানা ফিমা আত্বাইতা, ওয়া ক্বিনা সাররি মা ক্বাদাইতা, ইন্নাকা তাক্বদি ওয়া লা ইউক্বদা আলাইকা, ইন্নাহু লা ইয়াজিল্লু মান ওয়ালাইতা ওয়ালা ইয়াইজ্জুমান আদাইতা তাবারাকতা রাব্বানা ওয়াতাআলাইতা।’
‘আল্লাহুম্মাগফিরলানা, ওয়া লিলমুমিনিনা ওয়াল মুমিনাতি ওয়াল মুসলিমিনা ওয়াল মুসলিমাতি, ওয়া আল্লিফ বাইনা কুলুবিহিম, ওয়া আসলিহ জাতা বাইনিহিম, ওয়াংচুরহুম আলা আদুয়্যিকা ওয়া আদুয়্যিহিম। আল্লাহুম্মালআন কাফারাতা আহলিল কিতাবিল্লাজিনা ইয়াচুদ্দুনা আন সাবিলিকা, ওয়া ইউকাজ্জিবুনা রুসুলাকা, ওয়া ইউক্বাতিলুনা আওলিয়াআকা আল্লাহুম্মাখলিফ বাইনা কালিমাতিহিমা, ওয়া যালযিল আক্বদামাহুম, ওয়া আংযিল বিহিম বাসাকাল্লাজি লা তারুদ্দুহু আনিল ক্বাওমিল মুঝরিমিনা বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিমি আল্লাহুম্মা ইন্না নাসতায়িনুকা ওয়ানাসতাগফিরুকা ওয়া নুছনি আলাইকা ওয়া লা নাকফুরুকা, ওয়া নাখলাউ ওয়া নাতরুকু মাইয়্যাফঝুরুকা বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিমি আল্লাহুম্মা ইয়্যাকা নাবুদু, ওয়া লাকা নুসাল্লি ওয়া নাসঝুদু, ওয়া লাকা নাসআ ওয়া নাহফিদু, নাখশা আজাবাকাল ঝাদ্দা, ওয়া নারঝু রাহমাতাকা, ইন্না আজাবাকা বিলকাফিরিয়না মুলহাক্ব।’
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! হেদায়েত কর আমায়, যাদের তুমি হেদায়েত করেছ তাদের সাথে। শান্তি-স্বস্তি দান করো আমায়, যাদের তুমি শান্তি স্বস্তি দান করেছ তাদের সাথে। অভিভাবকত্ব গ্রহণ করো আমার, যাদের তুমি অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেছ তাদের সাথে। বরকত দান করো আমায়, যা তুমি দান করেছ আমায় তাতে এবং রক্ষা করো আমায় পর অনিষ্ট হতে, যা তুমি নির্ধারণ করেছ (আমার জন্য)। কেননা তুমি নির্দেশ দান করো, তোমার ওপর নির্দেশদান করা চলে না। বস্তুত সে ব্যক্তি অপমানিত হয় না যাকে তুমি মিত্র ভেবেছ। আর সম্মানিত হয় না সেই ব্যক্তি, যাকে তুমি শত্রু ভেবেছ। বরকতময় তুমি হে আমাদের প্রতিপালক আর তুমিই সুউচ্চ। আমরা তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং তোমার দিকে রুজু হই। হে আল্লাহ! ক্ষমা করো আমাদেরকে এবং মুমিন নর ও মুমিন নারীদেরকে আর মুসলমান নর ও মুসলমান নারীদেরকে তাদের অন্তরসমূহ জুড়িয়ে দাও আর তাদের মাঝে মীমাংসা করে দাও। সাহায্য করো তাদেরকে তোমার শত্রু ও তাদের শত্রুর বিরুদ্ধে। হে আল্লাহ! লানত বর্ষণ করো কাফেরদের প্রতি, যারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তোমার পথে এবং অস্বীকার করে তোমার রাসূলদেরকে আর যুদ্ধবিগ্রহ করে তোমার অলিদের সাথে। হে আল্লাহ! বিভেদ সৃষ্টি করে দাও তাদের কথার মাঝে এবং কম্পন সৃষ্টি করে দাও তাদের পদযুগলে আর নাজিল করো তোমার এমন শাস্তি যা তুমি অপরাধীগণ থেকে অপসারণ করো না।
কুনুতে নাজেলা পড়ার পদ্ধতি: ফজরের নামাজের ফরজের দ্বিতীয় রাকাআতে রুকু থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ইমাম আওয়াজ করে দোয়া পড়বেন। আর মুসল্লিগণ আস্তে আস্তে আমিন বলবেন। দোয়া শেষ করে নিয়মানুযায়ী সেজদা ও শেষ বৈঠকের মাধ্যমে নামাজ শেষ করবেন। (এলাউস সুনান)
নামাজ পড়া প্রসঙ্গে মালয়েশিয়ার প্রধান মুফতি বলেন, ‘যারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, তারা তাদের ঘরে নামাজ আদায় করবেন। করোনা আক্রান্তরাসহ অন্য যারা করোনা আক্রান্ত অঞ্চলে অবস্থান করছেন তারা মসজিদে না আসলেই সবার জন্য ভালো হবে।
মসজিদে না আসা প্রসঙ্গে তিনি ফতোয়া দিয়ে বলেন, ‘মসজিদে যাওয়া থেকে বিরত থাকা জায়েজ রাখা হয়েছে অসুস্থতার জন্য, ব্যথা, ভয় ও ভারী বৃষ্টিপাতের জন্য।’ তিনি মসজিদে মসজিদে কুনুতে নাজেলা পড়ারও আহ্বান জানান।
মহামারী করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে আল্লাহর সাহায্য লাভে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন মসজিদে কুনুতে নাজেলা পড়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
বিশ্বের ১২৪ দেশ ও অঞ্চলে মহামারী করোনাভাইরাসে লক্ষাধিক লোক আক্রান্ত। মারা গেছে প্রায় ৫ হাজার লোক। ভয়াবহ এ ভাইরাস থেকে মুক্তি লাভে দেশের প্রতিটি মসজিদে আল্লাহর সাহায্য লাভে কুনুতে নাজেলা পড়া জরুরি।
উল্লেখ্য যে, কুনুত দুই ধরনের রয়েছে। একটি হলো সবসময় নামাজের ওজিফা হিসাবে পড়া, যাকে কুনুতে রাতেবা বলা হয়। আর অপরটি হলো কখনো কখনো প্রচণ্ড বিপদ মহামারি ও ব্যাপক দুর্যোগকালে নামাজে একধরনের কুনুত (দোয়া) পড়া, যাকে কুনুতে নাজেলা বলা হয়। আবার এই দু ধরনের কুনুতের ব্যাপারে ইমামদের মতবিরোধও রয়েছে।
ইমাম শাফেঈ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘স্বাভাবিক অবস্থায় সব সময় নামাজের ওজিফা হিসাবে ফজরের নামাজে আর রমজান মাসের শেষ অর্ধেকে বিতির নামাজে কুনুতে রাতেবা পড়া হবে। আর প্রচণ্ড দুর্যোগ কালে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে কুনুতে নাজেলা পড়া হবে। আবার দুর্যোগ শেষ হয়ে গেলে তা বর্জন করে দেবে।
পক্ষান্তরে হানাফি মাজহাবের আলেমরা বলেন, ‘নামাজের ওজিফা হিসাবে শুধু বিতির নামাজে বৎসরের সব সময়-ই কুনুতে রাতেবা পড়বে। অন্য কোনো নামাজে নয়। আর প্রচণ্ড দুর্যোগকালে শুধু ফজরের নামাজে কুনুতে নাজেলা পড়বে অন্য কোনো নামাজে নয়।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে ভয়াবহ মহামারী করোনা থেকে মুক্ত থাকতে কুনুতে নাজেলাসহ আল্লাহর ক্ষমা ও রহমত লাভে বেশি বেশি তার কাছে দোয়া করার তাওফিক দান করুন। আমিন।