ইমরান খান
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশি-বিদেশি সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে। মানুষের শক্তিতে তিনি বিশ্বাস করেন। দেশবাসী তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিল বলেই পদ্মা সেতু মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।
২২ জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় বৃদ্ধির কারণও ব্যাখ্যা করেছেন। বলেছেন, পদ্মা সেতুর নকশা ২০১০ সালে চূড়ান্ত হয়। পরের বছর জানুয়ারিতে সংশোধিত ডিপিপি দাঁড়ায় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। সেতুর দৈর্ঘ্য ৫ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার থেকে বাড়িয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার করায় ব্যয় বাড়ে। এরপর ৪১টি স্প্যানের মধ্যে ৩৭টির নিচ দিয়ে নৌযান চলাচলের সুযোগ রাখা হয়েছে। যুক্ত করা হয়েছে রেলসংযোগ। কংক্রিটের বদলে ইস্পাতের অবকাঠামো যুক্ত হয়েছে। পাইলিংয়ের ক্ষেত্রেও গভীরতা বেড়েছে। বেড়েছে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ব্যয়। ২০১৭ সালে সরকার জমি অধিগ্রহণে জমির দামের তিন গুণ অর্থ দেওয়া শুরু করে। ২০১৬ সালে সেতুর খরচ আবার বাড়ে। ওই সময় ডলারের বিপরীতে টাকার মান ৯ টাকা কমে যায়। নদীশাসনে নতুন করে ১ দশমিক ৩ কিলোমিটার যুক্ত হয়। নিরাপত্তায় সেনাবাহিনীকে যুক্ত করা হয়। সব মিলে পদ্মা সেতুর প্রকল্প ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২১ জুন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২৭ হাজার ৭৩২ কোটি ৮ লাখ টাকা। পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে বাংলাদেশ পরনির্ভরতার অচলায়তন ভাঙতে পেরেছে। নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু করার ফলে বাংলাদেশের সম্মান ফিরে এসেছে। বিশ্বব্যাংক অযৌক্তিক অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতুর জন্য প্রতিশ্রুত ঋণসহায়তা থেকে সরে আসে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে হীনমন্যতার অবসান ঘটেছে। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক। সমালোচকদের নেতিবাচক সমালোচনার জবাবও তিনি দিয়েছেন যথার্থভাবে। পদ্মা সেতু যে বাংলাদেশের সামর্থ্যরে প্রতীক সে সত্যটি উঠে এসেছে তাঁর বক্তব্যে। আগামী দিনের পথচলায় যা অনুপ্রেরণা হিসেবে বিবেচিত হবে।
পদ্মা সেতুর কারণে জিডিপিতে যোগ হবে আরও দশ বিলিয়ন বা এক হাজার কোটি ডলার, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৯৩ হাজার কোটি টাকা। এটি পদ্মা সেতু নির্মাণে যে ব্যয় হয়েছে, তার চেয়ে তিনগুণ বেশি অর্থ যোগ করবে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে। উল্লেখ্য, পদ্মা সেতু নির্মাণে এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। অবশ্য রেল সেতুর জন্য আলাদা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই সেতু থেকে যে টোল আদায় হবে তার চেয়ে প্রাধান্য দেয়া হবে বিনিয়োগ ও শিল্পায়নের ওপর। বাংলাদেশের বর্তমান জিডিপির আকার ৪২০ বিলিয়ন ডলার। পদ্মা সেতুকে বিবেচনা করতে হবে এই অঞ্চলের করিডর হিসেবে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের ১৩টি দারিদ্র্যপীড়িত জেলার উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। আগামীতে আন্তঃদেশীয় যোগাযোগসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধিতে পদ্মা সেতুর অবদান আরও বাড়বে সুনিশ্চিত। সেতুটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলাকে সংযুক্ত করবে সারাদেশের সঙ্গে। সেতুর মাধ্যমে মংলা ও পায়রা বন্দর এবং বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী ঢাকা এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হবে, যা এককথায় যুগান্তকারী। সেতুকে ঘিরে যেমন সর্বস্তরের মানুষের আয়-উপার্জন বাড়বে, তেমনি গড়ে উঠবে পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্র। ঘটবে কৃষি বিপ্লব। জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে পদ্মা সেতুর অবদান থাকবে ২ দশমিক ৩ শতাংশের বেশি।
এই সেতু নির্মাণের অগ্রদূত হিসেবে এগিয়ে আসেন দেশীয় প্রকৌশলীরাই। নিজস্ব অর্থায়নে চীনের সহযোগিতায় নির্মিত এই সেতুর কাজ করোনা অতিমারীর কারণে বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে মনে করা হলেও সেটি হয়নি। পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে রাজধানীসহ সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী অবদান রাখতে সক্ষম হবে। পদ্মা সেতু আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশের সক্ষমতাসহ ভাবমূর্তি সমুজ্জ্বল করেছে। এর সার্বিক রক্ষণাবেক্ষণসহ নিয়মিত দেখভাল ও নিরাপত্তা নিয়ে অবহেলার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলের। ইতোমধ্যে পদ্মা সেতুর দুই পাড়ে উত্তর ও দক্ষিণ থানার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন এর স্বপ্নদ্রষ্টা ও বাস্তবায়নকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। থানা দুটি পদ্মা সেতুর সার্বিক নিরাপত্তা বিধানসহ নিয়মিত দেখভাল এবং স্থানীয় জনপদে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার পাশাপাশি অপরাধ দমনে কার্যকর অবদান রাখতে সক্ষম হবে নিশ্চয়ই।
লেখক: আওয়ামী লীগ নেতা ও কলামিস্ট। সিনিয়র সহ সভাপতি, বাংলাদেশ আওয়ামী মটর চালক লীগ।