আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয় পার্টিতে (জাপা) আবারও বিভক্তির আলামত শুরু হয়েছে। অনেকটা হঠাৎ করেই আগামী ২৬ নভেম্বর জাপার দশম কাউন্সিল ডেকেছেন দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ। ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রওশন নিজের স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে গতকাল মঙ্গলবার এই কাউন্সিল ডাকেন।
চিঠিতে রওশন এরশাদ দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে লিখেছেন, ‘আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে এরশাদের লড়াকু সৈনিকদের সমন্বয়ে মূল জাপাকে শক্তিশালী পার্টি হিসেবে আবির্ভূত হতে হবে। এই কর্মকাণ্ডে যোগ্যতর নেতৃত্ব প্রদানে ব্যর্থতার কারণে কাউন্সিলে জাপার নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের এখন সময়। তাই জাপার গঠনতন্ত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আমি আগামী ২৬ নভেম্বর ২০২২ শনিবার সকাল ১০টায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে জাপার দশম কাউন্সিলের তারিখ ঘোষণা করছি।’
কাউন্সিল প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক হয়েছেন রওশন নিজেই। আর সদস্য সচিব করেছেন তার রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসিহকে। রওশনের চিঠির বিষয়ে গোলাম মসিহ গতকাল বলেন, ‘চিঠিটি সত্য ও সঠিক। ম্যাডাম নিজেই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন। কাউন্সিল সফল করতে ম্যাডাম দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।’
তবে দলের কাউন্সিল ডাকার কোনো এখ্তিয়ার রওশনের নেই বলে মন্তব্য করেছেন জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের। তিনি গতকাল রাতে বলেন, ‘বিষয়টি একেবারেই হাস্যকর। গঠনতন্ত্রের কোথাও প্রধান পৃষ্ঠপোষককে (রওশনকে) এধরনের কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। কাজেই এনিয়ে বিভ্রান্তির কোনো সুযোগ নেই। কাউন্সিল ডাকার এখ্তিয়ার কেবলমাত্র চেয়ারম্যানকে দেওয়া হয়েছে পার্টির গঠনতন্ত্রে।’
রওশন তার চিঠিতে লিখেছেন, ‘আমি দীর্ঘদিন যাবৎ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) এবং ব্যাংককে চিকিৎসাধীন ছিলাম। এসময় আমি লক্ষ্য করি, জাপার গঠনতান্ত্রিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, নিয়মাবলি এবং পার্টির মূল আদর্শ সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। বর্তমানে পার্টি গঠনতন্ত্রে গৃহীত আদর্শ, নিয়ম ও নীতিমালা থেকে সরে গিয়ে ভ্রান্তপথে অগ্রসর হচ্ছে। জাপা একটি মাল্টিক্লাস গণতান্ত্রিক দল হিসেবে নির্বাচন বর্জনের সংস্কৃতি লালন করেনা। জাপার অব্যাহত সমর্থন-সহযোগিতার কারণেই আজ পদ্মা সেতুর মত বিশে^র অন্যতম বৃহত্তর অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে। জাপা এই সেতু নির্মাণের অন্যতম কৃতিত্বের অংশীদার। জাপার নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গের উচিত এই কৃতিত্বের অংশীদার হয়ে জাতিকে আশ^স্ত করা। কিন্তু নেতৃত্বের শীর্ষস্থান দখল করা নেতৃবৃন্দ এই কৃতিত্বের অংশীদারত্বের বিষয়টি জনগণের কাছে তুলে ধরার বিষয়ে অনীহা পোষণ করছেন, যা পার্টির মূল নীতিমালাবহির্ভূত কাজ।’
নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে রওশন চিঠিতে আরো লিখেছেন, ‘দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, জাতীয় অর্থনীতিতে লুটপাট এবং রাষ্ট্রীয় অর্থ বিদেশে পাচার ইত্যাদি বিষয়ে গোটা দেশবাসীকে সচেতন করা একান্ত আবশ্যক। এসব গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জাপার ভূমিকা অত্যন্ত দুর্বল। আমি সাংগঠনিকভাবে তৃণমূলের কর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে যোগ্যতর নেতৃত্ব নির্বাচন এবং বিপরীত গোষ্ঠীর অসৎ আয়ের বিনিময়ে নেতৃত্ব প্রদান ও ত্যাগী নেতাকর্মীদের বসিয়ে দেওয়ার প্রবনতা জাপার ঘোষিত নীতির বিপরীত।’ দল ছেড়ে যাওয়া নেতাদের পার্টিতে ফিরিয়ে আনার কথাও বলেছেন রওশন।
জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুসহ কো-চেয়ারম্যানদের কাউন্সিল প্রস্তুতি কমিটির যুগ্ম-আহ্বায়ক হিসেবে রেখেছেন রওশন। চুন্নু ছাড়াও যুগ্ম আহ্বায়করা হলেন- পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা ও সালমা ইসলাম।
এবিষয়ে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু গতকাল রাতে বলেন, ‘আমার নাম দেখে আমি নিজেই বিষ্মিত। ম্যাডামের সাথে আমার এবিষয়ে কথাই হয়নি। আমি কিছুই জানি না। ম্যাডাম এটা করতে পারেন না। পার্টির গঠনতন্ত্রে তাকে এধরনের কোনো এখ্তিয়ার দেওয়া হয়নি। একমাত্র পার্টি চেয়ারম্যান কাউন্সিল ডাকতে পারেন। কাজেই রওশন এরশাদের কাউন্সিল ডাকা সম্পূর্ণ অবৈধ ও অগ্রহণযোগ্য। যুগ্ম-আহ্বায়ক হিসেবে অন্য যাদেরকে তিনি রেখেছেন তারাও এবিষয়ে কিছুই জানেন না।’
এদিকে, গতকাল রাতে জাপার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ পার্টির কাউন্সিলের জন্য যে আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেছেন, তা সম্পূর্ণ অবৈধ, অনৈতিক ও গঠনতন্ত্র পরিপন্থী। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জাপার আহ্বায়ক কমিটি গঠন ও কাউন্সিল ঘোষণার কোনো এখ্তিয়ার নেই প্রধান পৃষ্ঠপোষকের। কাউন্সিলে গঠিত একটি বৈধ কমিটি ভেঙে দেওয়ার কোনো ক্ষমতা পার্টি চেয়ারম্যান ছাড়া আর কারো নেই। গঠণতন্ত্র অনুযায়ী শুধু পার্টি চেয়ারম্যান আহ্বায়ক কমিটি গঠন এবং কাউন্সিল আহ্বান করতে পারেন।’
উল্লেখ্য, জাপার গঠনতন্ত্রের ধারা ১২, উপধারা ১/২ অনুযায়ী কাউন্সিলের তারিখ, স্থান ও সময় প্রেসিডিয়াম কর্তৃক নির্ধারিত হবে। তাছাড়া প্রেসিডিয়ামেরও সভাপতি হিসেবে পার্টি চেয়ারম্যান কাউন্সিলের অনুমোদন দেবেন।
জাপার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়েছে, ‘পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা ও অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম আহ্বায়ক কমিটি গঠন ও কাউন্সিল ঘোষণার বিষয়ে অবগত নন।’