জলদস্যু কিংবা পাইরেটস- শব্দটি শোনার পরে চোখের সামনে কেমন চিত্র ভেসে ওঠে? এক চোখ কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা। একটি পা খোঁড়া। রুক্ষ মেজাজ। ঘাড়ে একটি ঈগল পাখি। ঝাঁকড়া চুলে কোমরে হাত দিয়ে অদূরে তাকিয়ে এক বীর পুরুষ। অন্তত হলিউডের বিখ্যাত মুভি ‘পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান’ এ জনি ডেপের লুক দেখে জলদস্যুদের জীবন সম্পর্কে এমনই ধারণা পেয়েছেন নিশ্চয়ই।
ফ্রান্সিস ড্রেক, ব্ল্যাকবার্ড কিংবা ক্যাপ্টেন কিড– জগতে এমন বিখ্যাত সব জলদস্যুদের ভিড়ে নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিয়েছেন- ঝেং শি নামের চীনা নারী; দক্ষিণ চীন সাগরে যিনি রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ইতিহাসে ঝেং শি নামে পরিচিত হলেও তার আসল নাম ছিল শিল জিয়াং গু। ‘ঝেং শি’ শব্দদ্বয়ের অর্থ ‘ঝেং এর বিধবা স্ত্রী’। তার প্রথম স্বামীর নাম ছিল ঝেং য়ি। সেখান থেকেই হয়তো তার এই নাম এসেছে। ধারণা করা হয় দারিদ্র্যের কারণে অল্প বয়সেই জন্মস্থান গুয়াংডু প্রদেশের একটি ভাসমান পতিতালয়ে পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত হন ঝেং শি। তার তরুণ বয়সে তৎকালীন চীনে প্রবল শক্তিশালী জলদস্যু ছিলেন ‘ঝেং য়ি’। এই দস্যুরাজের সঙ্গে পতিতালয়েই পরিচয় হয় ঝেং শি’র।
ঝেং য়ি সেই সময়ের নামকরা দস্যু ছিলেন। তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী জলদস্যু গ্রুপগুলোর সঙ্গে জোট তৈরি করেন। ফলে একটি বিশাল দস্যু-জোট তৈরি হয়, যে জোট ক্রমেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। এই জোটের সাহায্যে ঝেং য়ি ম্যাকাউ-এর পর্তুগিজ বন্দরে অবরোধ জারি করেন। পর্তুগিজরা তাদের সমৃদ্ধ নৌশক্তি নিয়ে বাধা দিতে আসলে উল্টো পরাজিত হয়ে ফিরে যায়।
ব্যক্তিত্ব আর বুদ্ধিমত্তার জোরে দস্যুদলে নিজের প্রভাব– প্রতিপত্তিও বাড়িয়ে তুলেছিল ঝেং শি। বৈবাহিক সূত্রে সম্পত্তির ভাগ তো ছিলই, পাশাপাশি দলের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোতেও এই সময় থেকেই বেশ ভূমিকা নিতে শুরু করেন ঝেং শি। ঝেং য়ি ও ঝেং শি- দুজনের নেতৃত্বে ২০০ জাহাজের নৌবহর কিছুদিনের মধ্যেই বাড়তে বাড়তে প্রথমে ৬০০ , তারপর প্রায় ১৮০০ জাহাজের এক বিরাট নৌসেনায় পরিণত হয়। নানা রঙের পতাকা দিয়ে সেসব জাহাজের ক্ষমতা প্রকাশ করা হতো। দস্যুদলের সর্দারদের জাহাজে থাকত লাল পতাকা। বাকি জাহাজগুলোর মাথাতেও ক্ষমতা আর কাজ অনুসারে নীল, কালো, সবুজ নানারঙের পতাকা।
সে সময় আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন ঝেং শি। ওই এলাকার আরেক কুখ্যাত জলদস্যু ইয়ু শি’র সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি করেন। ফলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, দস্যুদের নিজেদের মধ্যে মারামারি, লোকক্ষয়-এসব অনেকটাই কমে যায়। দক্ষিণ সমুদ্রে ক্যান্টোনিজ জলদস্যুদের একটা শক্তিশালী জোট গড়ে ওঠে। তবে দস্যু দলপতি ঝেং ই- বিয়ের মাত্র দু’বছর পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে মাঝসমুদ্রে ভয়ংকর দুর্ঘটনার মুখে পড়েন এবং মারা যান।
স্বামীর মৃত্যুর পর পুরনো জীবনে ফেরেননি ঝেং শি। ঝেং য়ি মারা গেলেও সেই দস্যুদলই হয়ে ওঠে তার নিজের পরিবার। সর্দারের মৃত্যুতে প্রথম প্রথম নেতৃত্ব নিয়ে কিছু অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল ঠিকই, তবে দল ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ার আগেই ক্ষমতার রাশ শক্ত হাতে চেপে ধরেন ঝেং শি। সঙ্গে নেন পালিত ছেলে চ্যাং পাও’কেও। বিয়ের পরপরই চ্যাং পাও’কে দত্তক নিয়েছিলেন এই দস্যু দম্পতি। এবার সেই দত্তক নেয়া ছেলেই সর্বশক্তি নিয়ে এসে দাঁড়ালেন ঝেং শি’র পাশে।
নেত্রী হিসাবে একদিকে যেমন দক্ষ ছিলেন, তেমনই কঠোর ছিলেন ঝেং শি। সামরিক কৌশল, ব্যবসার ফন্দিফিকির সবটাই খুব ভালো বুঝতেন। নিয়মকানুনের বাঁধনে পুরো দলকে বেঁধে রেখেছিলেন তিনি। নিয়ম করে দস্যুরানিকে রীতিমতো ট্যাক্স দিতে হতো সেসময়। সর্দার বা ক্যাপ্টেনের কথাই ছিল দলের শেষ কথা।
ঝেং শি নিয়ম করলেন, সমুদ্র তীরের গ্রাম থেকে যেসব মেয়েদের ধরে আনা হয়, তাদের মধ্যে বেশিরভাগ মেয়েদেরই বিনা শর্তে মুক্তি দিতে হবে। সুন্দরী বন্দিনীদের ওপর কোনো রকম শারীরিক নির্যাতন বা যৌন অত্যাচার করা যাবে না। নারী বন্দিদের সঙ্গে দস্যুদলের কেউ সঙ্গম করার চেষ্টা করলে তার জন্য থাকত কঠিন শাস্তি। তবে বন্দিনী মেয়েটির ইচ্ছে অনুসারে, তার মত নিয়ে যদি দস্যুদের কেউ তাকে বিয়ে করতে চায়, একমাত্র তবেই অনুমতি মিলত। সেখানেও শর্ত ছিল, বিবাহিত মেয়েটির প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হত সেই দস্যুকে।
মেয়েরা যাতে কোনো ভাবেই জলদস্যুদের লালসার শিকার না হয়, সে ব্যাপারে বেশ কঠোর ছিলেন ঝেং শি। সমুদ্র উপকূলীয় এলাকাগুলোতে তার দস্যুবাহিনী নিয়মিত আক্রমণ করত। ফলে সমুদ্র তীরবর্তী বিশাল অঞ্চলে ঝেং শির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পায়। এসব অঞ্চল থেকে তিনি তার দস্যুবাহিনীর মাধ্যমে কর আদায় করতেন। একসময় ঝেং শির আধিপত্য এত বেশি অঞ্চলে বিস্তৃত হয় যে, চীনা রাজবংশের আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। চীনা রাজবংশ ব্রিটেন এবং পর্তুগালের সাহায্য নিয়ে তাকে পরাস্ত করতে নৌ-অভিযান চালায়। তবে ঝেং শির বিশাল বাহিনীর কাছে তারা টিকতেই পারেনি। শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে হয় তাদের। এমনকি সম্মিলিত রাজকীয় বাহিনীর ষাটটি জাহাজ দখল করে নেয় ঝেং শির দস্যুরা।
অতঃপর চীনা রাজবংশ দস্যুরানি ঝেং শি’কে সমঝোতার প্রস্তাব দেয়। সমঝোতা অনুযায়ী, লুটের মালামাল নিজের কাছে রাখার নিশ্চয়তা পান। যেসব অঞ্চলের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেসব রাজবংশের হাতে ন্যস্ত করেন। এ ছাড়াও সমঝোতার ফলাফল হিসেবে দস্যুরানি তার ‘ডান হাত’ খ্যাত পালিত পুত্র চ্যাং পাওকে বিয়ে করেন। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এটাই সত্য।
কিন্তু হঠাৎ করেই কেন প্রতাপশালী দস্যুরানি সরকারের সমঝোতা প্রস্তাবে সাড়া দিলেন? এর জবাবে অনেক ইতিহাসবিদ বলেন, প্রয়াত ঝেং য়ির সময় যে দস্যুগ্রুপগুলো নিয়ে জোট গঠন করা হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। এ ছাড়াও ঝেং শির ‘সমুদ্রে ভেসে ভেসে বেড়ানো’ জীবন আর ভালো লাগছিল না। তাই তিনি রাজবংশের সমঝোতা প্রস্তাবে সায় দেন।