বিগত কয়েক বছর ধরেই অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরাইলি অভিযান নিয়মিত ঘটনা। এসব অভিযানে গত বছরই ইসরাইলি সেনাদের গুলিতে দুই শতাধিক ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। তবে বৃহস্পতিবারে (২৬ জানুয়ারি) পশ্চিম তীরের জেনিনে ইসরাইলি অভিযানে ১০ জন নিহত হওয়ার পর এবং তার পরপরই গাজায় ইসরাইলি সেনাদের নৃশংস অভিযানের পর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হাজির হয়েছে। তা হলো, ফিলিস্তিনে কি তবে তৃতীয় ইন্তিফাদা বা পুনর্জাগরণ আসন্ন?
ফিলিস্তিনিদের পক্ষ থেকে ইসরাইলের অস্তিত্বের জন্য ন্যূনতম হুমকি হাজির করতে না পারলেও ইসরাইল নিয়মিত ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে রক্তাক্ত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ জেনিনে পরিচালিত ইসরাইলের নৃশংস অভিযান আমাদের ২০০২ সালে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা চলাকালীন ইসরাইলি নিপীড়নের কথা মনে করিয়ে দেয়।
২০০২ সালে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা চলাকালে সপ্তাহব্যাপী ব্যাটল অব জেনিনের সময় (মূলত ইসরাইলের অভিযানের বিপরীতে ফিলিস্তিনিদের ন্যূনতম প্রতিরোধ) অন্তত ৫২ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিল, যাদের অধিকাংশই ছিল বেসামরিক নাগরিক। সে সময় অবশ্য ২৩ ইসরাইলি সেনাও নিহত হয়েছিল।
দ্বিতীয় ইন্তিফাদার শেষ বছর অর্থাৎ ২০০৫ সালের পর থেকে ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে বিবেচনা করার নীতি গ্রহণ করে এবং ১৯৬৭ সাল থেকে প্রতিনিয়ত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করার যে নীতি ছিল তা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও বিষয়টি আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে অবৈধ তারপরও তারা সেটিই চালিয়ে যেতে থাকে এবং ফিলিস্তিন সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যার বদলে সামরিক সমস্য বলে বিবেচনা করতে থাকে।
তারই ধারাবাহিকতায় ইসরাইল পশ্চিম তীরকে ঘিরে ফেলতে থাকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে। ইসরাইলকে আরও নিরাপদ রাখতে অভিযান অব্যাহত থাকে পশ্চিম তীরের জনবসতিতে। ইসরাইলের হয়ে যে নেতা এমন নীতি বাস্তবায়নে সবচেয়ে বেশি অগ্রগামী সেই বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আবারও ইসরাইলের ক্ষমতায় ফিরেছেন। ফিরেই ফিলিস্তিনিদের রক্তে আরও রঞ্জিত করেছেন হাজার বছরের পুরনো রক্তাক্ত ভূখণ্ডের মাটিকে।
ইসরাইলের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের ও বেশিবারের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দাবি, তার নৃশংস নীতি কাজ করেছে। সফলতা হিসেবে তিনি আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ২০২০ সালে স্বাক্ষরিত সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ চুক্তির কথা উল্লেখ করেন। সেই চুক্তির আওতায় আরব আমিরাত, মরোক্কো এবং ওমান ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে।
গত বুধবার (২৫ জানুয়ারি) এক সম্মেলনে নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘বিগত দশকে আমাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা আমাদের সতর্ক করে বলেছিল, আমরা যদি ফিলিস্তিনিদের জন্য ছাড় না দেই তবে আমাদের এমন একটি কূটনৈতিক ঝড়ের মুখোমুখি হতে হবে যা খুব দ্রুতই ভয়াবহ অর্থনৈতিক ঝড়ে পরিণত হবে। কিন্তু বাস্তবে তার সম্পূর্ণ বিপরীত হয়েছে। আমাদের নীতি ইসরাইলকে আরব দেশগুলোর সঙ্গে চারটি ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তির পাশাপাশি একটি অভূতপূর্ব কূটনৈতিক উন্নতি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়েছে।’
নেতানিয়াহুর দাবির সারবত্তা রয়েছে। কারণ আগে থেকেই ইসরাইলের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ অতি সামান্যই ছিল। এই চুক্তিগুলো ইসরাইলকে আরও শক্তি জুগিয়েছে এবং ফিলিস্তিনিদের আরও কঠিন থেকে কঠিনভাবে চেপে ধরার সুযোগ দিয়েছে। তাই এখন নেতানিয়াহু মনে করেন, তার দেশের এখন ফিলিস্তিনের অবশিষ্ট ভূখণ্ড-পশ্চিম তীর এবং গাজা-নিয়ন্ত্রণ করারও সক্ষমতা রয়েছে।
তবে নেতানিয়াহু এর আগে রাজনীতি থেকে শুরু করে প্রতিবাদের ময়দানে যেসব ফিলিস্তিনিকে সুযোগ সুবিধা দিয়েছেন-তারা মূলত পুরনো প্রজন্ম। যাদের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে অধিকাংশ তরুণ ফিলিস্তিনি বিরক্ত এবং তারা ইসরাইলকে পাল্টা আঘাত করার জন্য মুখিয়ে। মূলত এ কারণেই বিগত কয়েকে বছরে পশ্চিম তীরে সশস্ত্র সংগঠনের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। দৃশ্যত এসব সশস্ত্র গোষ্ঠী ফিলিস্তিনের পুরোনো স্বাধীনতাকামী দল ফাতাহ, হামাস এবং ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদের মতো ঐতিহ্যবাহী দলের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয় না। এমনকি তারা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্বও স্বীকার করে না। এসব গোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো ‘সিংহের ডেরা’ নামের একটি দল। যাদের মূল ঘাঁটি নাবলুসে। দলটির অধিকাংশ সদস্যই তরুণ। এসব তরুণের অনেকেই ফিলিস্তিনের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতি গোষ্ঠীর সদস্য হলেও তারা বরং নিজেদের মতাদর্শ অনুসারে পথ চলতে বেশি পছন্দ করেন এবং সেই পথ হলো ইসরাইলি সেনাদের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ করা।
এ কারণেই ২০২২ সালের প্রথমার্ধে ইসরাইলি সেনাদের ওপর ফিলিস্তিনি হামলা বৃদ্ধি পেয়েছিল। তারই সূত্র ধরে বৃদ্ধি পেয়েছিল পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি অভিযানও। যেটিকে ইসরাইলিরা নাম দিয়েছে ‘অপারেশন ব্রেক দ্য ওয়েভ’। তরুণদের সমন্বয়ে গঠিত এসব গোষ্ঠী স্বাধীনতার দাবির বাইরেও একাধিক ইস্যুতে আওয়াজ তুলেছে। যা পুরনোপন্থী রাজনীতিবিদদের পছন্দ নয়।
তরুণ ফিলিস্তিনিরা যেসব বিষয়ে আওয়াজ তুলেছে তার মধ্যে রয়েছে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের বিষয়টিও। ৮৭ বছরের এই নেতার শরীর বর্তমানে খুব একটা ভালো নয়। এমনকি তিনি ফিলিস্তিনিদের মধ্যে জনপ্রিয়ও নন। তার চেয়ে বড় সংকট হলো তার কোনো যোগ্য উত্তরসূরী নেই।
ফলে যোগ্য নেতৃত্বের অভাব এবং তরুণ স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীর আবির্ভাবের মানে হলো বিদেশি শক্তির জন্য ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরীণ বিবাদ মেটানো সহজ হবে না একইসঙ্গে মতাদর্শগত ব্যবধান থাকায় ইসরাইলের সঙ্গেও কোনো ধরনের সমঝোতায় পৌঁছা সহজ হবে না। ইসরাইলি সরকার যদি এমন দমন-পীড়ন অব্যাহত রাখে তবে তা আরও সম্ভব হবে না।
কারণ, নতুন এই গোষ্ঠীগুলোর কাছে আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য পরিস্থিতি শান্ত করা নয় বরং পরিপূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করা। বিপরীতে ইসরাইলে কট্টর ডানপন্থীদের উত্থানের ফলে ফিলিস্তিনিদের দমনে আরও নির্মম, আরও সংহত হবে বলেই অনুমান করা যায়।
এরইমধ্য, পশ্চিম তীরে অবৈধ ইসরাইলি বসতি ৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত সেই সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ইসরাইলি সরকার এসব বসতিকে বৈধ বলে চালানোর অপচেষ্টা করে যাচ্ছে। এমনকি ইসরাইলি আইনে এধরনে বসতি স্থাপন বেআইনি বলে স্পষ্টভাবে ষোষিত থাকার পরও বসতি স্থাপন করেই ক্ষান্ত থাকেনি ইসরাইল। কয়েক হাজার ফিলিস্তিনিকে কারাগারে বন্দী করে রেখেছে। তাদের মধ্যে অন্তত ৮০০ জনকে বন্দী করে রেখেছে কোনো বিচার ছাড়াই। এর বাইরে জেনিনে পরিচালিত অভিযানের মতো রক্তক্ষয়ী অভিযান তো নিয়মিত চলছেই।
তবে এসব ঘটনার পরিমাণ বৃদ্ধির মানে হলো ফিলিস্তিনে তৃতীয় ইন্তিফাদার আশংকা বৃদ্ধি পাওয়া। বিশেষ করে অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদে সংঘর্ষ, গাজায় ইসরাইলের আরও আরও আক্রমণ, পূর্ব জেরুজালেম এবং পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করা এবং ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরে ইসরাইলি হামলা কেবল সেই আশংকাকে আরও উসকে দেবে।
কারণ প্রথম ও দ্বিতীয় ইন্তিফাদার আগে এমন সব লক্ষণই দেখা দিয়েছিল। ফলে ২০২২ সালের মতো একটি রক্তক্ষয়ী ভয়াবহ বছরের পর এটি স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে যে, তৃতীয় ইন্তিফাদা এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
আল-জাজিরা থেকে অনূদিত