দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হতে যাচ্ছেন বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী রনাঙ্গণের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। ছাত্ররাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, আইন পেশা, বিচারকের দায়িত্ব, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালনের পর বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হতে যাচ্ছেন মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু।
পাবনা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সভাপতি ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে। বাকশালের পাবনা জেলা শাখার যুগ্ম মহাসচিব পদেও অধিষ্ঠিত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রতিবাদী ভূমিকার জন্য গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। নির্যাতনেরও শিকার হন আপসহীন মনোভাবের জন্য। ১৯৪৯ সালে পাবনা শহরের জুবিলি ট্যাঙ্কপাড়ায় (শিবরামপুর) জন্মগ্রহণ করেন মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। শহরের পূর্বতন গান্ধী বালিকা বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে রাধানগর মজুমদার অ্যাকাডেমিতে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৬৬ সালে এসএসসি পাসের পর পাবনার এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হন। এরপর শুরু করেন রাজনীতি।
এরপর এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে এইচএসসি ও ১৯৭১ সালে (অনুষ্ঠিত ১৯৭২ সালে) বিএসসি পাস করেন করেন মো. সাহাবুদ্দিন। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর এবং পাবনা শহীদ অ্যাডভোকেট আমিনুদ্দিন আইন কলেজ থেকে ১৯৭৫ সালে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।
কলেজ জীবনে প্রবেশের আগেই ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পাবনায় তার সাক্ষাৎ করেন সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর এডওয়ার্ড কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক, অবিভক্ত পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি থেকে ছয় বছর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
১৯৭১ সালে পাবনা জেলার স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়কের পদে দায়িত্ব পালন করেন সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। এ সময় মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন তিনি। ছাত্রলীগের সক্রিয় কাজের ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সালে পাবনা জেলা যুবলীগের সভাপতির দায়িত্ব পান।
১৫ অগাস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকেও গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। কারামুক্তির পর পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পান তিনি।
পাবনা জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য ছিলেন সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। ১৯৮২ সালে বিসিএস (বিচার) পরীক্ষা দিয়ে বিচারক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯৫ ও ১৯৯৬ সালে পরপর দুইবার বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব নির্বাচিত হন তিনি।
বিচারালয়ে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন শেষে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে ২০০৬ সালে অবসরে যান মো. সাহাবুদ্দিন। এরমধ্যে শ্রম আদালতের চেয়ারম্যান পদেও তিনি ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আইন মন্ত্রণালয় নিযুক্ত সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তখনকার বিচারক সাহাবুদ্দিন। বিচারক জীবনের ইতি টানার পর আবারও আইন পেশায় ফেরেন তিনি।
২০০৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী থাকার মধ্যে সরকার তাকে দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার হিসাবে দায়িত্ব দেয়। ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি সেই দায়িত্ব পালন করেন।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পরপরই আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা হয়। সে সময়ের ‘হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের’ মতো ঘটনার পরবর্তীতে সরকার ক্ষমতায় গিয়ে তদন্ত কমিশন গঠন করে আওয়ামী লীগ। ওই কমিশনের প্রধান ছিলেন সাহাবুদ্দিন চুপ্পু।
বিচারকের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালনের পর ২০০৬ সালে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে অবসর নেন। ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের কমিশনার পদে দায়িত্ব পালন করেন। পরে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য পদে অধিষ্ঠিত হন। ছাত্রনেতা, সাংবাদিকতা, আইনজীবী, বিচারক, দুদক কমিশনারের বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু যখন যে দায়িত্ব পালন করেছেন, তা নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন। দুদকের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বিশ্বব্যাংকের কথিত পদ্মা সেতুসংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন তিনি। তদন্তে অভিযোগটি মিথ্যা ও অন্তঃসারশূন্য বলে প্রমাণিত হয়। কানাডার কোর্টেও প্রতিবেদনটি সমর্থিত হয়। বাংলাদেশের মর্যাদা রক্ষায় যা অনন্য ভূমিকা পালন করে। দেশের ২১তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে মো. আবদুল হামিদ দুই মেয়াদে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর সততা, দায়িত্ববোধ এবং সৎ সাহসের ঐতিহ্য তাঁকে রাষ্ট্রপতি মনোনয়নে আওয়ামী লীগকে উদ্বুদ্ধ করেছে।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর আওয়ামী লীগের সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিলে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
রাষ্ট্রপতি পদটি দলনিরপেক্ষ পদ। এ পদে শপথ নেওয়ার পর তিনি কোনো দলের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারবেন না। তবে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে রাষ্ট্রপতি পদকে তিনি রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে রাখবেন আমরা এমন আস্থা রাখতে চাই। ২২তম রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে আমাদের অভিনন্দন। সেইসঙ্গে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সর্বোচ্চ সম্মান দেখিয়ে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনীত করার জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনাকে দেশের সমস্ত মুক্তিযোদ্ধার পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা ও মোবারকবাদ।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সভাপতি বাংলাদেশ ম্যাচ ম্যানুফ্যাকচারার এসোসিয়েশন, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট এফবিসিসিআই, মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩ নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা।