নিজস্ব প্রতিবেদক
জাল-জালিয়াতি, দুর্নীতি ও আত্মসাতের মাধ্যমে ৭৪০০ কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগের দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধান চলার মধ্যেই গাজীপুর সিটি করপোরেশনের (জিসিসি) বরখাস্ত মেয়র মো. জাহাঙ্গীর আলম পদে ফিরতে নতুন জালিয়াতি করেছেন।
সিটি করপোরেশনটির কাউন্সিলরদের স্বাক্ষর জাল করে একটি দরখাস্ত জমা দিয়েছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে, যাতে জাহাঙ্গীরকে মেয়র পদে পুনর্বহালের আবেদন জানানো হয়।
ওই আবেদনপত্রে ৬১ জন কাউন্সিলরের স্বাক্ষর জুড়ে দেওয়া হলেও অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ভয়ঙ্কর তথ্য। স্বাক্ষর থাকা কাউন্সিলরদের বেশিরভাগই জানিয়েছেন তারা ওই আবেদনে স্বাক্ষর করেননি।
এছাড়া জাল করে যেসব কাউন্সিলরের স্বাক্ষর ওই আবেদনপত্রে ব্যবহার করা হয়েছে, তারা আইনি পদক্ষেপ নিবেন বলে জানিয়েছেন। বলেছেন, জাহাঙ্গীরের হাতে নতুন করে প্রতারিত হওয়ার বিষয়ে তারা সিদ্ধান্ত নিতে এতত্রিত হচ্ছেন। আলাপ-আলোচনার পর আইন পদক্ষেপের দিকে হাঁটবেন তারা। মেয়র জাহাঙ্গীরের জিসিসির অর্থ নামে বেনামে লোপাট করে সিটি করপোরেশনটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন উল্লেখ করে তার শাস্তিও দাবি করেছেন স্বাক্ষর জালিয়াতির শিকার হওয়া ৮০ শতাংশ কাউন্সিলর।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের বরখাস্তকৃত সাধারণ সম্পাদক ও জিসিসির বরখাস্তকৃত মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদে পুনর্বহালের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে গত রবিবার একটি আবেদন জমা পেড়েছে। ওই আবেদনে জিসিসির ৬১ জন কাউন্সিলরের স্বাক্ষর রয়েছে।
সাজানো ওই আবেদনে বিষয় হিসেবে লেখা হয়, ‘গাজীপুরের উন্নয়ন ও আগামী নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে জাহাঙ্গীর আলমকে মেয়রের দায়িত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আবেদন।’
এতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘নির্বাচিত মেয়র নগরীর কাউন্সিলরদের সঙ্গে আলোচনা করে উন্নয়ন কর্মকা- পরিচালনা করতেন। কিন্তু বিগত ১৫ মাসে প্যানেল মেয়রের স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম, দুর্নীতি ও সমন্বয়হীনতা চরম পর্যায়ে পৌছেছে। যার কারণে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন সম্পূর্ণরূপে অকার্যকর হয়ে পড়েছে।’
জাল স্বাক্ষর ব্যবহার করা ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘জাহাঙ্গীর আলম সিটি কর্পোরেশনে উন্নয়নের যে ধারা চালু করেছিলেন বর্তমান প্যানেল মেয়রের সমন্বয়হীনতা ও জনগণের চেয়ে নিজের উন্নয়নে অধিক মনোযোগী হওয়ার কারণে আজ তা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। এর কারণে লাখ লাখ সাধারণ জনগণ সিটি কর্পোরেশন থেকে প্রাপ্য নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কার্যত সিটি কর্পোরেশন অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এতে সরকার ও দলের সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে।’
‘এমতাবস্থায় নগরীর উন্নয়নের চাকা সচল রাখতে জাহাঙ্গীরকে মেয়রের দায়িত্ব ফিরিয়ে দিতে এবদন করর্ছি’,- এ কথাও লেখা হয় ওই সাজানো আবেদনে।
এই আবেদনে স্বাক্ষর থাকা জিসিসির ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর খোরশেদ আলম সরকার সোমবার বিকালে বলেন, ‘জাহাঙ্গীরকে মেয়র পদে পুনর্বহালের কোনো আবেদনে আমি স্বাক্ষর করিনি। আমার কাছে লোক পাঠানো হয়েছিল জাহাঙ্গীরের পক্ষ থেকে। আমি স্পষ্ট বলে দিয়েছি স্বাক্ষর দিব না।’
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে জমা পড়া আবেদনে তার স্বাক্ষর থাকার তথ্য শুনে বিস্মিত হন কাউন্সিলর খোরশেদ আলম। তিনি জানান জাহাঙ্গীরের এই জালিয়াতির বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা। বলেন, ‘বর্তমান ভারপ্রাপ্ত মেয়র রয়েছেন, অন্য কাউন্সিলররা রয়েছেন- তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে দ্রুত এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিব।’
এ বিষয়ে কথা হয় জিসিসির ২২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. মোশারফ হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘জাহাঙ্গীরকে মেয়র পদে পুনর্বহালের কোনো আবেদন আমি করিনি। কোনো আবেদনপত্রে স্বাক্ষরও করিনি।’
এদিকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বরখাস্তকৃত মেয়র মো. জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে ৭ হাজার ৪০০ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক।
দুদক সূত্র জানায়, বিশ্ব ইজতেমার খরচের ভাউচারে অনিয়ম, নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সড়ক প্রশস্তকরণের কাজে ইস্টিমেট অনুযায়ী কাজ বাস্তবায়ন না হওয়া, অনেক সড়কে ইস্টিমেটের অতিরিক্ত সড়ক প্রশস্তকরণের নামে বাড়ি-ঘর ভাঙা, ভাঙা বাড়ি-ঘরের জমি অধিগ্রহণে ও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের নামে অর্থ আত্মসাত ও জিসিসির অর্থ লুটপাটসহ মোট ৭৪০০ কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে। এসব দুর্নীতির বিষয় দুদকের অনুসন্ধান পর্যায়ে রয়েছে।
অন্যদিকে তদন্তের অংশ হিসেবে দুদকের তদন্ত কমিটির সদস্যরা গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নগর ভবন পরিদর্শন, কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংকসমূহ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে ইতোমধ্যেই। ওই প্রতিনিধি দল গাজীপুর সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং বিভিন্ন নথিপত্র সংগ্রহও করেছে।
দুদক সূত্র বলছে, সিটি করপোরেশনের কয়টি ব্যাংকে কয়টি হিসাব, কার নামে কীভাবে পরিচালিত হয়েছে বা হয়েছে। এরই মধ্যে গাজীপুরের কোণাবাড়ীতে একটি বেসরকারি ব্যাংকে সিটি করপোরেশনের নামে জাহাঙ্গীর আলমের একক স্বাক্ষরে অ্যাকাউন্ট খুলে আড়াই কোটি টাকা দুর্নীতির তথ্যও পাওয়া গেছে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে ভুয়া টেন্ডার, আরএফকিউ, বিভিন্ন পদে অযৌক্তিক লোকবল নিয়োগ, একই কাজ বিভিন্ন প্রকল্পে দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ এবং প্রতিবছর হাট-বাজার ইজারার অর্থ যথাযথভাবে নির্ধারিত খাতে জমা না রাখাসহ নানাবিধ অভিযোগে ২০২১ সালের ২৫ নভেম্বর সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরে গাজীপুর সিটির প্যানেল মেয়র মো. আসাদুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এর আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কটূক্তি ও মুক্তিযুদ্ধে বীর শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে ২০২১ সালের ১৯ নভেম্বর জাহাঙ্গীর আলমকে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও দলের সদস্যপদ থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়।
বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের অভিযোগে জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জেলায় করা ৭টি মামলা হয়। গত বছরের ২২ আগস্ট আগাম জামিন পান তিনি।
এর আগে গত ১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের স্বাক্ষরিত এক চিঠির মাধ্যমে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বহিষ্কৃত মেয়র এবং গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের বহিস্কৃত সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। যাতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। তারা বলছেন, ‘দুর্নীতিবাজকে দলে ফিরিয়ে নেওয়া পরোক্ষভাবে দুর্নীতিকে সমর্থন করার সামিল।’