১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত বাঙালির জীবনে নেমে আসে এক ভয়ংকর, নৃশংস ও বিভীষিকাময় অন্ধকার রাত। এই দিনটি অন্যান্য দিনের মতোই স্বাভাবিক ছিল। রাতে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালির ওপর যখন ঝাঁপিয়ে পড়ে ইতিহাসের বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ আর ধ্বংসের উন্মত্ত তাণ্ডব চালায়, সেদিন থেকে ‘স্বাধীনতা’ কথাটি বাঙালির হয়ে যায়।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, বলেন তখন থেকেই বাঙালির বুঝে গিয়েছিলো লড়াই করতেই হবে। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতেই হবে। গৌরবময় এই যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ পাই আমরা। একই সঙ্গে পাই হাজার হাজার কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, নাটক, শিল্পকলা ও চলচ্চিত্র। বাঙালির সৃজনশীলতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মুক্তিযুদ্ধ দারুণ ভাবে প্রভাব ফেলেছে। যার ফলে এসব শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বিধৃত হয়েছে বাঙালির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও বিজয়ের মহৎ লাবণ্য গ্রন্থিত উৎসার। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র, স্বল্পদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র, প্রামাণ্য চিত্র এবং তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে।
২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা এবং পাকিস্তান বাহিনীর হত্যা, খুন, নুশংসতা, লুণ্ঠন শুরুর পর পরই চলচ্চিত্র শিল্পী-কলাকুশলীরা কলকাতায় আশ্রয় নেয়। ওখানে জহির রায়হানের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘স্বাধীন বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পী ও কলাকুশলী সমিতি’। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ১৯৭১ সালে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে।
এই প্রতিষ্ঠানের প্রযোজনায় ও স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার এবং ভারতীয় চলচ্চিত্রকর্মীদের সহায়তায় প্রাথমিক পর্যায়ে চারটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়। এগুলো হচ্ছে জহির রায়হান পরিচালিত ‘স্টপ জেনোসাইড’, ‘এ স্টেট ইজ বর্ণ’, আলমগীর কবির পরিচালিত ‘লিবারেশন ফাইটার্স’ ও বাবুল চৌধুরী পরিচালিত ‘ইনোসেন্ট মিলিয়নস’। এসব প্রামাণ্যচিত্রে বিধৃত হয়েছে পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা, ১৯৪৭-১৯৭১ পর্যন্ত পাকিস্তানী শোষকদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের আন্দোলন-সংগ্রাম, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ও শরণার্থীদের দুঃখ-কষ্ট।
এই প্রামাণ্যচিত্রগুলোর নামকরণ করা হয় ‘জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র’। এই চারটি প্রামাণ্যচিত্রই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র। এগুলো প্রদর্শিত হয় মুক্তাঙ্গনে এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে। এসব চিত্র নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান বাহিনীর নৃশংসকতা রেকর্ড করা, বিশ^বিবেককে নাড়া দেয়া এবং বাঙালির শৌর্যবীর্য ও প্রতিরোধকে অগ্রায়ন করা।
১৯৭১ সালে বহু বিদেশি চলচ্চিত্রকার, টিভি টিমও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চিত্র নির্মাণ করেছে এবং শুটিং করেছে। মার্কিন নির্মাতা লিয়ার লেভিনের তোলা এমনি শুটিংকৃত দৃশ্য পরবর্তীকালে সংগ্রহ করে তারেক মাসুদ নির্মাণ করেছেন প্রামাণ্যচিত্র ‘মুক্তির গান’ (১৯৯৫)। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে গঠিত চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের পরিচালক ছিলেন আব্দুল জব্বার খান। এই দপ্তরের উদ্যোগেও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। তবে তা হারিয়ে গেছে।
দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র নির্মাণের হিড়িক পড়ে যায়। ১৯৭২ সালে মুক্তি পায় প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র চাষী নজরুল ইসলামের ‘ওরা ১১জন’। এতে বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত ৬ দফা ও ছাত্রদের ১১ দফা ও মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরের চেতনাকে প্রতীকি করা হয়েছে। ছবির ১১টি মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রই বাস্তবের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অভিনয় করানো হয়েছে। চাষী নজরুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পরে আরো কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এসবের মধ্যে রয়েছে ‘সংগ্রাম’ (১৯৭৪), ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ (১৯৯৭), ‘মেঘের পরে মেঘ’ (২০০৪), ‘ধ্রুবতারা’ (২০০৬)। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অন্যান্য কাহিনীচিত্রের মধ্যে রয়েছে সুভাষ দত্তের ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ (১৯৭২), মমতাজ আলীর ‘রক্তাক্ত বাংলা’ (১৯৭২), আনন্দের ‘বাঘা বাঙালী’ (১৯৭২), আলমগীর কবিরের ‘ধীরে বহে মেঘনা’ (১৯৭৩), আলমগীর কুমকুমের ‘আমার জন্মভূমি’ (১৯৭৩), খান আতাউর রহমানেরে ‘আবার তোর মানুষ হ’ (১৯৭৩), মিতার ‘আলোর মিছিল’ (১৯৭৪), হারুনর রশীদের ‘মেঘের অনেক রং’ (১৯৭৬), শহীদুল হক খানের ‘কলমীলতা’ (১৯৮১), নাসির উদ্দীন ইউসুফের ‘একাত্তরের যীশু’ (১৯৯৩) ও ‘গেরিলা’ (২০১১), হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমনি’ (১৯৯৫) ও ‘শ্যামল ছায়া’ (২০০৪), কাজী হায়াৎ-এর ‘সিপাহী’ (১৯৯৪) ও ‘জয় বাংলা’ (২০২২), শামীম আখতারের ‘ইতিহাস কথা’ (২০০০), ‘শিলালিপি’ (২০০২) ও ‘রীনা ব্রাউন’, তৌকীর আহমেদের ‘জয়যাত্রা’ (২০০৪), খিজির হায়াতের ‘অস্তিত্বে আমার দেশ’ (২০০৭), মোরশেদুল ইসলামের ‘খেলাঘর’, ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ (২০১১), ‘অনীল বাগচীর একদিন’ (২০১৫), তানভীর মোকাম্মেলের ‘নদীর নাম মধুমতী’ (১৯৯৭), ‘রাবেয়া’, ‘জীবনঢুলী’ (২০১৪), ‘রূপসা নদীর বাঁকে’, জাহিদুর রহিম অঞ্জনের ‘মেঘমল্লার’, মাসুদ পথিকের ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ ও ‘মায়া- দি লস্ট মাদার, রিয়াজুল মাওলা রিজু’র ‘বাপজানের বায়োস্কোপ’ (২০১৫), নূরুল আলম আতিকের ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ (২০২১) প্রভৃতি।
অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক স্বল্পদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্রও (এক ঘন্টার কম) তৈরি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্যচিত্র নির্মাণ করেন মোরশেদুল ইসলাম ‘আগামী’ (১৯৮৪) নামে। তিনি পরে নির্মাণ করেন সূচনা (১৯৮৮), শরৎ’৭১ (২০০০)। অন্যান্য উল্লেখ্য যোগ্য স্বল্পদৈর্ঘ্যচিত্রের মধ্যে রয়েছে মোস্তফা কামালের ‘প্রত্যাবর্তন’ (১৯৮৬), জামিউর রহমান লেমনের ‘ছাড়পত্র’ (১৯৮৮), হাবিবুল ইসলাম হাবিবের ‘বঘাটে’ (১৯৮৯), খান আখতার হোসেনের ‘দূরন্ত’ (১৯৮৯), এনায়েত করিম বাবুলের ‘পতাকা’ (১৯৮৯), দিলদার হোসেনের ‘একজন মুক্তিযোদ্ধা’ (১৯৯০), আবু সায়ীদের ‘ধূসর যাত্রা’ (১৯৯২), হারুনর রশীদের ‘গৌরব (১৯৯৮), ছটকু আহমেদের ‘মুক্তিযুদ্ধ ও জীবন’ (২০০৭), দেবাশীষ সরকারের ‘শোভনের একাত্তর’ (২০০০), কবরী সারওয়ারের ‘একাত্তরের মিছিল’ (২০০১), মান্নান হীরার ‘একাত্তরের রং পেন্সিল’ (২০০১), রহমান মুস্তাফিজের ‘হৃদয়গাথাঁ’ (২০০২), সৈয়দ রেজাউর রহমানের ‘যন্ত্রণার জঠরে সূর্যোদয়’ (২০০৪), তারেক মাসুদের ‘নরসুন্দর’ (২০১১) প্রভৃতি। এসব চলচ্চিত্র দৈর্ঘ্যে স্বল্প হলেও বিষয়ের মাহাত্যে অনেক বড়, আমাদের জাতীয় চেতনা, মুক্তি-সংগ্রাম ও ইতিহাসের স্বর্ণখ-।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অসংখ্য প্রামাণ্য চিত্র নির্মিত হয় স্বাধীনতার পর। এসবের মধ্যে রয়েছে আলমগীর কবিরের ‘ডায়েরিজ অব বাংলাদেশ’ (১৯৭২), ‘প্রোগ্রাম ইন বাংলাদেশ’ (১৯৭২), ডিএফপি’র ‘মুক্তিযোদ্ধা’ (১৯৭৬), সৈয়দ শামসুল হকের ‘৭ জন বীর শ্রেষ্ঠ’ (১৯৮৩, ১৯৮৪ ও ১৯৮৫), ইয়াসমীন কবিরের ‘স্বাধীনতা’ (২০০০), চাষী নজরুল ইসলামের ‘কামালপুরের মুক্তিযুদ্ধ’ (২০০১), সাজ্জাদ জহিরের ‘মৃত্যুজয়ী’ (২০০১), কাওসার চৌধুরীর ‘সেই রাতের কথা বলতে এসেছি’ (২০০১), তানভীর মোকাম্মেলের ‘তাজউদ্দিনের নিসঙ্গ সারথী’ (২০০৭) ও ‘১৯৭১’ (২০১১), লুৎফুন্নার মৌসুমীর ‘অন্য মুক্তিযোদ্ধা’ (২০০৭), পলাশ বকুলের ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ (২০১০), ফখরুল আরেফীন খানের ‘আল বদর’ (২০১১), কাওসার মাহমুদ ও সজল খালেদের ‘একাত্তরের শব্দ সৈনিক’ (২০১২), প্রকাশ রায়ের ‘বাংলাদেশ: একটি পতাকার জন্ম’ (২০১৪), আজাদ কালামের ‘বিরহ গাঁথা’ (২০১০), শবনম ফেরদৌসীর ‘জন্ম সাথী’ (২০১৩), মানজারে হাসীনের ‘এখনো একাত্তর’ (২০১৬), ফরিদ আহমেদের ‘লাল সবুজের দীপাবলী’ (২০১৭), আমিরুল হকের ‘অপারেশন জ্যাকপট’ (২০১৭) ও ‘পাহাড়ে মুক্তিযুদ্ধ’ (২০১৭) প্রভৃতি।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের সহায়তার জন্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর, অধিদপ্তর ও প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে। এজন্যে নেয়া হয়েছে বিভিন্ন কার্যক্রম। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এক্ষেত্রে বিশেষ অনুদানের ব্যবস্থা করেছে। চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর স্বাধীনতার পর থেকে প্রতি বছরই মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রামাণ্য চিত্র ও কাহিনী চিত্র নির্মান করছে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনুদান নীতিমালায়ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে আলাদা কোটা রয়েছে। এছাড়া উক্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ও নিদর্শন সংগ্রহ, রেকর্ড ও সংরক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থা করেছে। এসবই বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, ত্যাগ ও গৌরবকে সমুন্নত রাখা সংগ্রহ ও সংরক্ষণের শুভ প্রচেষ্টা। চলচ্চিত্র হচ্ছে প্রত্যক্ষ গণমাধ্যম। এই মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের নির্মাণ, উপস্থাপন, পরিবেশন, প্রদর্শন যত বেশি হবে ততই মঙ্গল। মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র মাধ্যমে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম স্বাধীনতার আগে মহীয়ান ও বলীয়ান হয়ে দেশ-রাষ্ট্র-সমাজ-সংস্কৃতি ও উন্নয়নে অবদান রাখবে, এটাই কাম্য।