গানটা আবদুল্লাহ শফিকের ভালো লাগে। সেই শৈশবে গিটারের টুংটাং শব্দে ঘুম ভাঙতো তার। বাবার দেখাদেখি নিজেও কখন যে এই মায়ার জালে জড়িয়ে যান। বয়সের গন্ডিটা ১০ বছর পেরোয় তখন তো বিভিন্ন শিল্পীদের গান দিনরাত শুনতেন। এরপর নিজেই গানের দলে নাম লেখান। গান শেখার চেষ্টা চালিয়ে যান৷ তার গাওয়া গান নেট দুনিয়ায়ও ভাইরাল হয়েছে। সেই শফিক এবার বিশ্বকাপের রঙিন ভুবনে রানের মূর্ছনায় করেছেন মুগ্ধ।
ঘরোয়া ক্রিকেটে রঙ ছড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙনে পা রেখেছিলেন। সেও বছর দুয়েক আগের কথা। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ঘরের মাঠে টি২০ দিয়ে শুরু হয় নতুন করে স্বপ্ন দেখা। যাত্রা ম্যাচেই জাত চিনিয়েছিলেন শফিক। সেদিন ওপেনিংয়ে নেমে অপরাজিত ৪১ রান করেছিলেন তিনি। যে ম্যাচে ৮ উইকেটের জয় পায় পাকিস্তান। সেই যে শুরু৷ এরপর ওয়ানডে এবং টেস্টের অভিষেক ক্যাপটাও পেয়ে যান তিনি। তবে নিয়মিত পাকিস্তান দলের সদস্য হয়ে থাকা হয়নি। এবার যখন বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে ডাক পড়লো। তখন তো ছেড়ে কথা বলার জো নেই। খেললেন এক বীরোচিত ইনিংস। করলেন ১১৩ রান। গড়লেন একাধিক রেকর্ড।
এতদিন বিশ্বকাপে পাকিস্তানের হয়ে অভিষেক আসরে সর্বোচ্চ ইনিংস ছিল মহসিন খানের ৮২। ১৯৮৩ সালে লংকানদের বিপক্ষে ওই স্কোর করেছিলেন তিনি। মঙ্গলবার হায়দরাবাদে সেই রেকর্ড ভেঙে চুরমার করে দিলেন শফিক। নিজের যাত্রা বিশ্বকাপ খেলতে নেমে ১১৩ রান করে ফেলেন তিনি৷ অথচ তার খেলারই কথা ছিল না। কিন্তু ফখর জামানের ফর্মহীনতায় কপাল খোলে শফিকের। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের মধ্যে দ্বিতীয় সবচেয়ে কম বয়সী হিসেবে বিশ্বকাপে সেঞ্চুরির কীর্তিও গড়েছেন। ২০১৯ বিশ্বকাপে লর্ডসে বাংলাদেশের বিপক্ষে নিজের অভিষেক আসরে সেঞ্চুরি করেছিলেন ইমাম উল হক। তখন তার বয়স ছিল ২৩ বছর ১৯৫ দিন। আর তার কাঁধে নিঃশ্বাস ফেলা শফিকের বয়স এখন ২৩ বছর ৩২৪ দিন।
এদিন লংকান ঝাঁঝের মাঝে মোহাম্মদ রিজওয়ানের সঙ্গে দারুণ এক জুটি গড়েন শফিক৷ যে জুটি থেকে পাকিস্তান পায় ১৭৬ রান। পাকিস্তানের বিশ্বকাপ ইতিহাস বলছে, এটাই যে কোনো উইকেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানের জুটি। যে তালিকায় একে ওয়াস্তি-আনোয়ারের করা ১৯৪। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে ম্যানচেস্টারে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে যে জুটি গড়েছিলেন তারা। লংকানদের বিপক্ষে সেঞ্চুরি হাঁকানোও চাট্টিখানি কথা নয়। তাও আবার বিশ্বকাপে। যেখানে ইমরান খান, জাভেদ মিয়াঁদাদ, সেলিম মালিকের নাম ছিল। মঙ্গলবার একদিনে আরো দুজন বাড়লো সেই তালিকায়। শফিকের পর রিজওয়ানও করো নিলেন সেঞ্চুরি।
শফিক আব্দুল্লাহর জায়গা এখন পোক্ত হয়ে গেলো। সামনের ম্যাচগুলোতে তাকে দেখা যাবে পাকিস্তান দলে। তার আগে এই নতুন ত্রাতাকে নিয়ে গল্প শোনা যাক। পাকিস্তানে জন্ম নিলেও একটা সময় দুবাইয়ে পাড়ি জমাতে হয় শফিককে। মূলত তার বাবা সেখানে দীর্ঘদিন ছিলেন। সেজন্য তাকেও দুবাইয়ে থাকতে হয়। সেখানে নতুন জীবন নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে ভালোই বেগ পেতে হয়েছিল শফিককে। তার চাচা আরশাদ আলী আরব আমিরাতের হয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচও খেলেছিলেন। তাকেও দেশটির হয়ে খেলার প্রস্তাব দেওয়া হয় কিন্তু শফিক রাজি হননি। পাকিস্তানের প্রতি তার টানটা ছিল বলেই এখন সেই দেশের হয়ে বিশ্বকাপে আলো ছড়াচ্ছেন।
টপ অর্ডার নিয়ে পাকিস্তানের দুশ্চিন্তা দীর্ঘদিন ধরে। বিশেষ করে এশিয়া কাপে তাদের ওপেনিং থেকে সেভাবে রান আসেনি৷ মূলত দলের এক সময়কার কান্ডারী বাবর আজম ফর্মে নেই। সেজন্য রান তোলার কাজটা স্থবির হয়ে যায়। যাক, শফিকের ওপর এখন থেকে আস্থা রাখতে পারবে পাকিস্তান। এরপর তো ক্রাইসিস ম্যান খ্যাত মোহাম্মদ রিজওয়ান আছেন। এখন পর্যন্ত চলমান বিশ্বকাপে সবচেয়ে সলিড ব্যাটার তিনি। রানও তার বেশি। প্রতি ম্যাচেই দেখেশুনে ঠান্ডা মাথায় দলের রানের চাকা ঘুরিয়ে যাচ্ছেন এই উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান। সামনের ম্যাচগুলোতেও হয়তো এই দুয়ের (রিজওয়ান-শফিক) মাঝে জয়ের আশা বুনবে পাকিস্তানি দর্শকরা।