মিয়ানমারে জান্তা সরকারের বাহিনীর সঙ্গে বিরতিহীনভাবে চলছে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) লড়াই। সোমবার থেকে মিয়ানমারে টানা গুলিবর্ষণ, মর্টার শেল নিক্ষেপ ও হেলিকপ্টার থেকে গুলি-বিস্ফোরণ চলছেই।
এসব ঘটনায় প্রতিনিয়তই কেঁপে উঠছে মিয়ানমার সীমান্ত-সংলগ্ন বাংলাদেশের বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম, তুমব্রু, কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী থেকে শুরু করে টেকনাফের হ্নীলা। মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত গুলি-বিস্ফোরণ চলছিল।
এদিকে এ পরিস্থিতিতে বুধবার সীমান্ত এলাকা পরিদর্শনে যাচ্ছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী।
সোমবার মিয়ানমার থেকে ছোড়া গোলার আঘাতে বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হওয়ার পরদিনই গতকাল ছুটে আসা গুলিতে গুরুতর আহত হয়েছেন আরেকজন। এরই মধ্যে সীমান্তের বাসিন্দারা বাড়িঘর, গবাদি পশু আর ফসলি জমি ফেলে নিরাপদে চলে যাচ্ছেন। সীমান্তের দোকানপাট বন্ধ হয়ে এক ভয়ার্ত পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। ঝুঁকিতে থাকা সীমান্তবাসীর জন্য আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে জেলা প্রশাসন।
বিদ্রোহীদের সঙ্গে তুমুল লড়াইয়ে টিকতে না পেরে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর সদস্যদের সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়া অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি দেশটির চাকমা জনগোষ্ঠী ও রোহিঙ্গারাও অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে।
সার্বিক বিষয়ে গতকাল বাংলাদেশে নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। সকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিউ মোয়েকে তলব করে কড়া প্রতিক্রিয়া জানায় বাংলাদেশ। তাকে প্রতিবাদপত্র হস্তান্তর করা হয়।
পরে এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে আমাদের দেশের অভ্যন্তরে তাদের দেশের মানুষের প্রবেশ এবং সেখান থেকে গোলাবারুদ এসে পড়ার কারণে আমাদের মানুষ আহত-নিহত হওয়া–এই পুরো জিনিসটা নিয়েই তাদের প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য যখন আমরা কাজ করছি, সেই প্রেক্ষাপটে এ ধরনের ঘটনা অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত ও অগ্রহণযোগ্য। এটি আমরা জানিয়েছি। মিয়ানমার তাদের নাগরিকদের নিয়ে যাবে এই মর্মে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করছে।
এছাড়া পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন জানান, বান্দরবানের ঘুমধুম সীমান্তে কারা মর্টার শেল নিক্ষেপ করেছে, তা এখনো সুনিশ্চিত নয়। তবে ঘটনায় পুলিশ অজ্ঞাতদের আসামি করে একটি মামলা করেছে। তদন্তে যাদের নাম আসবে, পরবর্তী সময়ে সেভাবেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী সীমান্তে বিজিবি, পুলিশ ও প্রশাসন- সবাই মিলে কাজ করছে জানিয়ে আইজিপি বলেন, দেশের প্রয়োজনে দায়িত্ব পালনের জন্য পুলিশের প্রত্যেক সদস্য প্রস্তুত রয়েছেন।
এদিকে একজন রোহিঙ্গাকেও আর বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন বিজিবির নবনিযুক্ত মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী। গতকাল টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার সমাধি সৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর সাংবাদিকদের তিনি বলেন, মিয়ানমারে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সীমান্ত সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আমরা ধৈর্য ধারণ করে মানবিক দিক এবং আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ক বজায় রেখে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করছি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাও সেরকম। তিনি আমাদের ধৈর্য ধারণের নির্দেশ দিয়েছেন। সেই ধারাবাহিকতায় আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
এদিকে সীমান্তবাসী বলছেন, সোমবার রাত থেকে গতকাল বিকেল পর্যন্ত সীমান্তের দুটি বসতঘরে মর্টার শেল এবং আরও পাঁচটি ঘরে গুলি এসে আঘাত হেনেছে। বিকেলে রাইফেলের গুলিতে তুমব্রু কোনার পাড়ার বাসিন্দা সৈয়দ আলম (৪০) মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। তাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আনোয়ার হোসেন জানান, গতকাল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে স্থানীয় বেতবুনিয়া বাজার-সংলগ্ন একটি বসতঘরে মর্টার শেল এসে পড়েছে। এতে ঘরটির জানালা ভেঙে গেছে ও দেয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছে। একই সময়ে ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে একটি মর্টার শেল এসে পড়ে। এরপর ওপার থেকে অনবরত গুলি এসে পড়ছে এপারের ঘরবাড়িতে।
অন্যদিকে সীমান্তে উত্তেজনাকে কাজে লাগিয়ে ওপারের সশস্ত্র গোষ্ঠীর লোকজনও অস্ত্র নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অনুপ্রবেশ করছে। গতকাল উখিয়ার পালংখালী সাতটি পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় অস্ত্রসহ ২৪ জনকে আটক করছে স্থানীয়রা। অনুপ্রবেশে বাধা দেওয়ায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের ছোড়া হাতবোমার আঘাতে আহত হয়েছেন পাঁচজন। তারা হলেন থাইংখালী গ্রামের মোবারক, আনোয়ারা ইসলাম, আয়ুবুল ইসলাম, কালু ও আব্বু।
উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, সোমবার রাত থেকে দুই পক্ষের লড়াই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে বলে তারা এপার থেকেই আঁচ করতে পারছেন। তিনি ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেন, তারা সীমান্তের মানুষ। এ ধরনের গোলাগুলি তাদের কাছে নতুন কিছু নয়। তবে এবারের মতো এমন কম্পন আর কখনো দেখা যায়নি। একেকটি গোলা নিক্ষেপের পর পুরো এলাকা কেঁপে উঠছে।
সীমান্তের স্থানীয় লোকজন বলছেন, পালংখালী ইউনিয়নের উখিয়ার ঘাট, পূর্ব ফাঁড়ির বিল, নলবনিয়া, আঞ্জুমানপাড়া, বালুখালী ও দক্ষিণ বালুখালী এলাকা, ঘুমধুমের মধ্যমপাড়া, জলপাইতলী, কোনারপাড়া, মণ্ডলপাড়া, নয়াপাড়া, বেতবুনিয়া বাজারপাড়া, পশ্চিম কুলসহ আশপাশের এলাকা ওপারের বিস্ফোরণে কেঁপে উঠছে।
ঘরবাড়ি ছাড়ছে মানুষ:
সীমান্তের বাসিন্দারা বলছেন, কয়েকদিন ধরেই তারা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছেন। তবে গত দুদিনে পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় প্রায় সবাই চলে যাচ্ছেন। কিন্তু যাদের গবাদি পশু রয়েছে, তারা বিপাকে পড়েছেন। নারী ও শিশুদের নিরাপদে পাঠিয়ে দিয়ে অনেকেই নিজের ঘরে থাকছেন, কেউ ফসলি জমিতে কাজ করার জন্য থাকতে বাধ্য হচ্ছেন; কিন্তু দোকানপাট বন্ধ হওয়ায় খাদ্য সংকটে পড়েছেন তারা।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক মো. শাহ মোজাহিদ উদ্দিন জানান, ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার জন্য তিন দিন আগে থেকে বলা হচ্ছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় গতকালও ওই সব এলাকার জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে অনুরোধ জানানো হচ্ছে।
বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে মিয়ানমার বাহিনীর ২৬৪ জন:
ঢাকায় বিজিবি সদর দফতর জানিয়েছে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘর্ষের জেরে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিপি), মিয়ানমার সেনাবাহিনী, ইমিগ্রেশন সদস্য, পুলিশ ও অন্যান্য সংস্থার ২৬৪ জন সদস্য বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বিজিবি তাদের নিরস্ত্রীকরণ করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়েছে।
বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেছেন, গত রোববার রাত পর্যন্ত ১১৫ জন মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী, সেনাবাহিনী ও অন্য সদস্যরা আত্মসমর্পণ বা আমাদের কাছে আশ্রয় নিয়েছেন। গতকাল সকালে আরো ১১৪ জন যোগ হয়েছে। দুপুরে আরো ৩৫ জনসহ মোট ২৬৪ জনকে আশ্রয় দেওয়ার কথা জানান তিনি।
তিনি বলেন, তাদের খাবারেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। আহত ১৫ জনের মধ্যে আটজন গুরুতর অবস্থায় রয়েছেন। এদের মধ্যে চারজনকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ও চারজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।