আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ শ্রীলঙ্কায় গতকাল অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছে। চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেই অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে এখন চলছে ভোট গণনা। আর ভোট গণনায় প্রাথমিকভাবে এগিয়ে আছেন মার্ক্সবাদী নেতা হিসেবে পরিচিত অনুড়া কুমারা দিসানায়েক।
রোববার এক প্রতিবেদনে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, নির্বাচন কমিশনের তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, রোববার সকাল পর্যন্ত প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে ভোট গণনায় বড় সংগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আছেন দিসানায়েক। গণনাকৃত ভোটের প্রায় ৫০ শতাংশ জিতেছেন তিনি। দেশটিতে একজন প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করতে মোট ভোটের ৫১ শতাংশ প্রয়োজন।
শনিবার স্থানীয় সময় সকাল ৭টায় ভোট গ্রহণ শুরু হয়ে একটনা চলে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। এরপরই ভোট গণনা শুরু হয়।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, এক কোটি ৭০ লাখ ভোটারের মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশ এ নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন।
দিশানায়েক ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) জোটের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। তার মার্ক্সবাদী দল জনতা বিমুক্তি পেরেমুনা (জেভিপি) এই জোটের অন্যতম অংশীদার। জেভিপি ঐতিহ্যগতভাবে জোরালো রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ, কম কর ও আরও নিয়ন্ত্রিত বাজার অর্থনীতির পক্ষের দল।
শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টে জেভিপির মাত্র তিনটি আসন থাকলেও দিশানায়েক (৫৫) কঠোর দুর্নীতিবিরোধী প্রতিশ্রুতি ও দরিদ্রপন্থি নীতির মাধ্যমে জনগণের কাছে পৌঁছতে পেরেছেন।
রয়টার্স লিখেছে, তিনি নিজেকে পরিবর্তনের প্রার্থী হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলে তিনি ৪৫ দিনের মধ্যে বর্তমান পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এর মাধ্যমে নিজের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য জনগণের কাছে আরও সমর্থন চাইবেন তিনি।
শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলি সাবরি সামাজিক মাধ্যম এক্স এ বলেছেন, “দীর্ঘ ও কঠিন প্রচারণার পর এখন নির্বাচনের ফল পরিষ্কার। যদিও আমি প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহের পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছি, শ্রীলঙ্কার জনগণ তাদের সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর আমি অনুরা কুমারা দিশানায়েকের প্রতি তাদের সমর্থনের বিষয়ে পুরোপুরো শ্রদ্ধাশীল।”
দুই বছর আগে রাজস্ব আয় বাড়ায় না এমন অনুৎপাদনশীল প্রকল্পগুলোতে অত্যধিক ঋণ গ্রহণের ফলে শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ অর্থনৈতিক অর্থনৈতিক সঙ্কট তৈরি হয়। এছাড়া কোভিড মহামারীর প্রভাব এবং স্থানীয় মুদ্রাকে চাঙ্গা করতে বৈদেশিক রিজার্ভ ব্যবহার করার জন্য সরকারের জেদ অর্থনীতির দ্রুত পতনে ভূমিকা রেখেছিল।
তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কটে ওষুধ, খাদ্য, রান্নার গ্যাস এবং জ্বালানির মতো প্রয়োজনীয় জিনিসের মারাত্মক ঘাটতি দেখা দেয় দেশটিতে। সে সময় লঙ্কানদেরকে নিত্যপণ্যের জন্য দিনের পর দিন লাইনে অপেক্ষাও করতে হয়েছে।
এক পর্যায়ে দেশটিতে জনবিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে ২০২২ সালের ৩১ জুলাই পরবর্তীতে বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্টের বাসভবন, তার কার্যালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলো দখল করে নেয়। এর ফলে তখনকার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
গোতাবায়া ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হওয়ার এক সপ্তাহ পর দেশটির পার্লামেন্ট ৭৫ বছর বয়সী রাজনীতিক বিক্রমাসিংহেকে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দেয়।
দেশের হাল ধরা প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংকটপূর্ণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কঠোর শর্ত মানতেও রাজি হয়। ২৯০ কোটি ডলারের ঋণ পরিশোধের জন্য দ্বিগুণ কর বৃদ্ধি, বিদ্যুতে ভর্তুকি বাতিলসহ নানা রকম কৃচ্ছ্রতা কর্মসূচি গ্রহণ করেন বিক্রমাসিংহে।
অন্তর্বর্তী সরকারের নানা পদক্ষেপে অল্প সময়ের মধ্যেই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি। বিক্রমাসিংহে মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে আনার পাশাপাশি স্থানীয় মুদ্রাকে শক্তিশালী করতেও সফল হন।
তবে এতো কিছুর পরও লড়াই করতে হচ্ছে দেশটির মানুষকে।
৩২ বছর বয়সী ইয়েশান জয়ালাথ বলেন, “চাকরি খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে কঠিন বিষয়। অ্যাকাউন্টিং ডিগ্রি নিয়েও আমি স্থায়ী চাকরি পাচ্ছি না।
২০২২ সালে কলম্বোর উত্তরে নিজের টালির কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হওয়া নরবেট ফার্নান্দো বিবিসিকে বলেন, মাটি, কাঠ ও কেরোসিনের মতো কাঁচামালের দাম দুই বছর আগের তুলনায় এখন তিনগুণ বেশি। খুব কম লোকই বাড়ি তৈরি করছে বা ছাদের টাইলস কিনছে।
“৩৫ বছর পর আমার কারখানা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে দেখে কষ্ট হচ্ছে। ২০২২ সালের পর এই এলাকার ৮০০ কারখানার মধ্যে মাত্র ৪২টি কারখানা চালু আছে।
দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২ এবং ২০২৩ সালে অর্থনীতির অবস্থা হতাশাজনক হলেও ২০২৪ সালে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। তবে এখনও পুরোপুরি সঙ্কট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।
কঠিন সময়ে দেশের হাল ধরতে প্রেসিডেন্ট হওয়ার লড়াইয়ে নামা পাঁচ প্রার্থী আলোচনায় ছিলেন। তাদের মধ্যে বামপন্থী ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার জোটের অনুরা কুমারা দেশানায়েক দুর্নীতিবিরোধী কঠোর পদক্ষেপ এবং সুশাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের নতুন নিয়ম অনুযায়ী, একজন ভোটার তিন প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন। প্রার্থীদের মধ্যে কেউ কমপক্ষে ৫০ শতাংশ বা এর চেয়ে বেশি ভোট পেলে তাকেই বিজয়ী ঘোষণা করা হবে।
আর কোনো প্রার্থী ৫০ শতাংশ ভোট না পেলে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া দুই প্রার্থীর মধ্যে দ্বিতীয় দফা ভোট হবে। দ্বিতীয় দফা ভোটে যিনি এগিয়ে থাকবেন তিনিই হবেন দেশটির প্রেসিডেন্ট।