যখন ভাবছেন ইট-পাথর আর কংকিটের শহরে আপনি হাঁপিয়ে উঠেছেন। তখন শহরের অতি কাছ থেকেই একটু বেড়িয়ে আসুন। আর শরীরে একেবারে গাও-গ্রামের নির্মল মুক্ত বাতাস লাগান। আপনার চোখ জোড়াটি প্রশান্তি দিতে দেখে আসুন সবুজের বন-বনানী। মনে তৃপ্তি মিটাতে নদী-নালা, খাল-বিলের কাছে ছুটে যান। শুনুন কোকিলের কুহু-কুহু ডাক আর নানা জাতের পাখির কিচির-মিচির শব্দ। শুনতে পারে হাঁস-মুরগির ডাকও।
তবে এত কিছু করতে গিয়ে ‘ক্ষুদার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন জলশানো রুটি’ মনে না হয় সে ব্যবস্থাও করতে হবে। সে ক্ষেত্রে শহরের খুব কাছেই একবেলার অবকাশে ঘুরে আসা আর খাওয়া সেরে নেয়ার জন্য ‘ছনের ঘর’ হতে পারে আদর্শ স্থান। রেস্তোরাটি সাঁজাতে প্রকৃতি থেকে প্রদত্ত সম্পদের অকৃত্রিম ব্যবহার চোখ জুড়িয়ে যায়। ছনের ঘরে বসার প্রতিটি ঘরে ব্যবহার করা হয়েছে ছনের ছাউনি। এখানে বসে খাওয়ার টেবিল-চেয়ারগুলো বানানো হয়েছে বাঁশ দিয়ে। গ্রামীণ প্রাচীন ঐতিহ্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে তৈজসপত্র হিসেবেও ব্যবহার হচ্ছে মাটির তৈরি জিনিস। ছনের ঘরের পরিবেশ এবং খাবারের স্বাদ খুবই রুচিশীল। ছনের ঘরের পরিবেশ দেখলেই বুঝা যাবে এখানকার খাবার খুব সুস্বাদু। খাওয়া শেষ করে ছনের ঘরের ছাউনির নিচেই বাঁশের চেয়ার-টেবিলে বসে দিতে পারেন জমিয়ে আড্ডা। ঢাকা থেকে সকাল ১০/১১টার দিকে বের হয়ে খেয়ে-দেয়ে সবুজ প্রকৃতি সাথে প্রেম নিবেদন আর গ্রামীণ স্বাদ উপভোগ করে বিকেল ৫/৬ টার মধ্যে ফিরতে পারবেন ইট-পাথর আর কংকিটের ঢাকা শহরে। তবে ফেরার আগে ছনের ঘরে তৈরি এক কাপ লেবুপাতা আর লেবু চা খেয়ে আসবেন। কারণ এই চায়ের অসাধারণ স্বাদই আপনাকে পরের বার ছনের ঘরে যেতে উদ্ভুদ্ধ করবে।
গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়নের পানজোড়া গ্রাম। আর ছনের ঘর রেস্তোরাটি এই পানজোড়া গ্রামেই। এই গ্রামেরই কৃষক আব্দুস সামাদের ছেলে মো. সাদেক মিয়া চলতি বছরের শুরুর দিকে ৫ শতাংশ জমিতে প্রতিষ্ঠা করেন ছনের ঘর রেস্তোরাটি। কাঞ্চন-গাজীপুর বাইপাস থেকে কালীগঞ্জের দিকে এগুলেই পানজোড়ায় পেয়ে যাবেন ছনের ঘর। আর গুগল ম্যাপ ধরে এগোলে সহজেই খুঁজে পাওয়া যাবে। এছাড়া তাদের ফেইসবুকে ঢুঁ দিতে পারেন অথবা যোগাযোগ করতে পারেন ০১৮৭৫৫৯৩২৩৪ নম্বরে।
রাস্তা দিয়ে গাড়ি, রিক্সা বা হেঁটে গেলে ভেতরে যাওয়ার চুম্বুক আকর্ষন আপনাকে করবেই। ভেতরে ঢুকতেই প্রকৃতির দক্ষিনা বাতাসে আপনার শরীর আর মন শীতল হবে। উপরে ছনের ছাউনি। চারপাশে কোন দেয়াল নেই। দু’চোখ ভরেই সবুজ আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে পারবেন। আর বৃষ্টি হলে তো কোন কথাই নেই। দু’হাত বারিয়ে করতে পারেন বৃষ্টি বিলাস।
ছনের ঘরের সত্বাধীকারী সাদেক মিয়া জানান, ব্যক্তি জীবনে তিনি ৩ ছেলের জনক। দুই ছেলে পিএসসি শেষ করে মাদ্রাসায় হাফিজি পড়ছে। বাকী ছেলেকেও দেওয়া হবে মাদ্রাসায়। আল্লাহ চান তো ৩ ছেলেকেই হাফেজ বানানোর ইচ্ছা তার। স্ত্রী গৃহিনী। ৪ ভাইয়ের মধ্যে তিনি সর্ব কনিষ্ট। আছে ৩ বোনও। ছোট বেলা থেকেই তিনি ছিলেন খুব ডানপিঠে। যে কারণে এসএসসি’র পর আর লেখাপড়া এগোয়নি। পরিবার চাইলেও তিনি তার দুষ্টমির কারণে লেখাপড়া আগাতে পারেননি। ১৯৯৭ সালে চলে যান ভারতে। সেখানে তিনি বম্বে গিয়ে একটি রেস্টুরেন্টে কাজ নেন। নিজের দূরন্তপনার কারণে বেশি দিন স্থায়ী হয়নি সেই চাকুরী। পর্যায়ক্রমে বদল করেন ৪/৫টি রেস্টুরেন্টের কাজ। এভাবে কেটে যায় সাড়ে ৩ বছর। এই সাড়ে ৩ বছরে তিনি বুঝে যান রান্না আসলেই একটি শিল্প এবং তৃপ্তির বিষয়। বম্বেতে রান্নার কাজে তার কিছুতেই তৃপ্তি পাচ্ছিলেন না। সেখান থেকে ২০০০ সালের আগস্টে পারি জমান মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানে। ওমানে গিয়ে চাকুরী নেন সেখানকার শেরাটন হোটেলে।
৫ বছর শিখার পর ২০০৫ সালের মে মাসে চলে যান মিশরে। মিশরে তিনি শিখেন ১ বছর। সেখান থেকে ইন্ডিয়া হয়ে দেশে ফিরেন। কিছু দিন দেশে অবস্থানের পর আবার চলে যান ওমানে। এবারও তিনি সেখানকার একটি ৫ তারকা হোটেলে কাজ নেন। সেখানে তিনি ৩ বছর অবস্থান করেন। পরে ওমানের নামি-দামি আরো কয়েকটি হোটেল ঘুরে অবস্থান নেন ওমান বিমান বন্দরের ৫ তারকা একটি হোটেল। এতো চাকুরী বদল করেছেন তিনি পয়সার জন্য নয়, শিখার জন্য। মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় ২৪ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি ফিরে আসেন দেশে। দীর্ঘদিন প্রবাসে কাটালেও দেশের মাটি ও মানুষ তাকে খুব টানতো। কিন্তু কাজ শিখার ব্যাপারে কোন কিছুকেই প্রাধান্য দেননি। বরং বিসর্জন দিয়েছেন অনেক কিছু। জীবনের স্বার্ণালি সময়টাই তিনি কাটিয়েছেন প্রবাসে।
তবে এবার দেশকে দেবার পালা। দেশে এসেই রাজধানী অভিজাত এলাকা ঢাকার গুলশান-বারিধারার একটি নাম করা হোটেলে চাকুরী নেন। অস্থির সাদেকের কৈশোরের দূরন্ত পনা এখনো কাটেনি। সেখান থেকে চাকুরী ছেড়ে চলে আসেন শিকড়ের টানে গ্রামে। যেখানে কাঁদা মাটির গন্ধ, সবুজ প্রকৃতি হাতে ইশারা করে ডাকে। আর সেখানেই তার ছনের ছাউনের ছনের ঘর। তাতে বাঁশের আসবাব ও মাটির তৈজসপত্র।
সাদেক মিয়া আরও বলেন, ওমান, মিশর ও ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘুরে রান্নায় হাত পাঁকিয়েছেন, শুধু দেশি না চাইনিজ, থাই, ইতালিয়ান, ফ্রেন্স ও ইন্ডিয়ান যে কোনো খাবার রান্না করতে পারেন তিনি। ছনের ঘরে একবার যে অতিথি হয়েছেন দ্বিতীয়বার তাকে আসতে হয়েছে শুধু তার হাতের রান্নার যাদুর কারণে। এখানে প্রতিদিনের খাবার প্রতিদিন রান্না হয়। রান্নায় ব্যবহৃত সবজি স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। স্থানীয় বিভিন্ন চাতালের চাল, জেলে জালে ধরা পড়া বিলের দেশী মাছ ও কৃষাণীর পালের দেশী মুরগী হয় রেস্তোরেন্টের রান্নার মূল উপকরণ। এজন্য টাটকা স্বাদের জন্য মুখ ফেরানো যায় না। খাবারের দামও রয়েছে সাধ এবং সাধ্যের মধ্যে। প্রতিদিন সকাল ১০/১১টার মধ্যে জানিয়ে দিলে সেই হিসেবে খাবারের আয়োজন করা হয়। তবে কয়েকজনের জন্য বাড়তি খাবারের ব্যবস্থা সবসময়ই থাকে। রাত্রি যাপনের জন্য ছনের ঘরে কোন ব্যবস্থা নেই। তবে ভবিষ্যতে রাত্রি যাপনেরও ব্যবস্থা করবেন বলে জানান সাদেক মিয়া। এখানে স্থানীয় অনেক বেকার যুবকের কর্মসংস্থান করতে চান তিনি। এ জন্য ভবিষ্যতে এই ছনের ঘর নিয়ে রয়েছে তার অনেক পরিকল্পনা।
যেভাবে যাবেন: ঢাকার কুড়িল-বিশ্বরোড থেকে ৩শ ফিট রাস্তার শেষ মাথায় পাবেন কাঞ্চন ব্রীজ। আর বাঁয়ে কাঞ্চন-গাজীপুর বাইপাস সড়ক। ওই সড়ক দিয়ে একটু এগোলেই কালীগঞ্জ শহরে যেতে পানজোড়া গ্রামে পেয়ে যাবেন ছনের ঘর। আবার উত্তরা-টঙ্গী-আব্দুল্লাহপুর থেকে বালু নদীর উপর দিয়ে তেরমূখ ব্রীজ হয়েও আসা যায় ছনের ঘরে।