নিজস্ব প্রতিবেদক,সিটিজেন নিউজ: রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে পাঁচ বিষয়ের ওপর জোর দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ। সেগুলো হলো- রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, প্রযুক্তিগত ও ভূ-রাজনৈতিক।
‘রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট : টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে’ শীর্ষক এক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন উপলক্ষে মঙ্গলবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বইটির এডিটরও।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য বাংলাদেশকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, প্রযুক্তিগত ও ভূ-রাজনৈতিক- এ পাঁচটি বিষয়ের ওপর জোর দিতে হবে। সমস্যার সমাধানে এ পাঁচটি বিষয়কে ব্যবহার করতে হবে।
এর মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মিয়ানমারের সঙ্গে প্রতিবেশী তিন দেশ চীন, জাপান ও ভারতের খুবই ভালো সম্পর্ক। মিয়ানমার মনে করছে এ তিন দেশ যেহেতু তাদের পক্ষে আছে তাই কেউ কিছু করতে পারবে না। মিয়ানমারে দেশ তিনটির বিনিয়োগ রয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান না হলে এটা সবার জন্যই ক্ষতির কারণ হবে। বিষয়টি ওই তিন দেশকে বোঝাতে হবে। এ উদ্যোগ বাংলাদেশকেই নিতে হবে।
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের দুই বছর পূর্তির দিন ছিল গত ২৫ আগস্ট। এ উপলক্ষে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং মধুরছড়া (ক্যাম্প-৪) আশ্রয়শিবিরের তিনটি পাহাড় ও মাঠে জড়ো হন লাখো রোহিঙ্গা। সমাবেশে তারা পাঁচ দফা দাবি উপস্থাপন করেন এবং বলেন, যদি মিয়ানমারে ফিরে যেতে হয়, একসঙ্গে যাব, একসঙ্গে সীমান্ত পার হব। যদি জোর করে পাঠানোর চেষ্টা করা হয় তাহলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হবে বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তারা।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইন থেকে রোহিঙ্গা ঢল শুরু হয়। বর্তমানে টেকনাফ ও উখিয়ায় ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ৫০ হাজার। সর্বশেষ গত ২২ আগস্ট দ্বিতীয় দফার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দিন নির্ধারিত ছিল। কিন্তু শর্ত ছাড়া কোনো রোহিঙ্গা ফিরে যেতে রাজি না হওয়ায় প্রত্যাবাসন স্থগিত করা হয়।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের উদ্যোগ নেয়ার পরও ব্যর্থ হওয়ায় সরকারের কঠোর সমালোচনা করে বিরোধীপক্ষ। সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেন, সরকার রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধানে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। দুই বছর ধরে রোহিঙ্গারা এ দেশে এসেছে। এ দুই বছরে সরকার এতই ব্যর্থ হয়েছে যে, দিনক্ষণ তারিখ ঠিক করেও গত তিনদিন আগে সাড়ে তিন হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠাতে পারেনি। অন্যদিকে সরকারপক্ষ অর্থাৎ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘সব বিষয়ই আমাদের নলেজে আছে, রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্য ও আশ্রয় আমরা দিয়ে যাচ্ছি। তাদের নিয়ে যারা খেলতে চায়, রোহিঙ্গাদের নিয়ে নোংরা খেলা যারা করতে চায়, তাদের ব্যাপারেও আমাদের কাছে তথ্য আছে। সময়মতো ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
এর আগে সিটিজেন নিউজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেছিলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্বকে চাপ দেয়ার সময় এসেছে। ভারত বা চীন কী করল, সেদিকে চেয়ে বসে থাকলে চলবে না। নিজেদের তৎপরতা বাড়াতে হবে। ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধী যে ভূমিকা রেখেছিলেন, বাংলাদেশকেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে সেই ভূমিকা নিতে হবে।
বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে এখন সবার নজর বাংলাদেশের দিকে। কিন্তু এখন সমস্যার সমাধানের জন্য সবার নজর মিয়ানমারের দিকে থাকতে হবে। কারণ বাংলাদেশ গণহত্যা করেনি। গণহত্যা করেছে মিয়ানমার। তাই সবাইকে মিয়ানমারের দিকে নজর রাখতে হবে।
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের জুন-জুলাইতে যদি বাংলাদেশের শরণার্থীদের আগরতলা দিয়ে বাংলাদেশে যেতে বলা হতো তাহলে কি হতো? ক্লাস টু’র ছাত্রও ‘না’ বলতো। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বরের পরে যে কেউ স্বেচ্ছায় ফিরে আসতো। রোহিঙ্গারাও যখন নিরাপদ বোধ করবে তখন নিশ্চয়ই মিয়ানমারে ফিরে যাবে। এজন্য আইনের পরিবর্তন করতে হবে এবং সেফ জোন করতে হবে। আইনের পরিবর্তন ও সেফ জোন করলেই রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাবে।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত বিষয়ের ওপর জোর দেয়ার আহ্বান জানিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এ অধ্যাপক বলেন, মিয়ানমারের বহু মানুষ আছে যারা মনে করে যে, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে। তাই ব্যবসায়ীদের বলতে হবে, তোমার দেশে গণহত্যা হয়েছে, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ, অ্যাকশন এইড ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড স্টাডিজের যৌথ আয়োজনে এ অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি মিয়া সেপ্পো, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সৈয়দ রিফাদ আহমেদ, ঢাকায় নিযুক্ত কানাডার রাষ্ট্রদূত বেনোয়েট প্রিফন্টেইন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (এশিয়া প্যাসিফিক) মাহবুব উজ জামান, এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক কে এম আব্দুস সালাম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক মানজুর হাসান, অ্যাকশন এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির প্রমুখ।