শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৫০ অপরাহ্ন
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ::
সিটিজেন নিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে। যারা আগ্রহী আমাদের ই-মেইলে সিভি পাঠান
সংবাদ শিরোনাম ::

মালয়েশিয়ায় ‘মানুষ বিক্রি’

  • আপডেট টাইম : বুধবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৯
  • ২৩২ বার পঠিত

মালয়েশিয়ায় মানবপাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি উঠলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের হত্যা, গণকবর দেওয়া, ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন, মুক্তিপণ আদায়সহ যেসব অপরাধ মানবপাচারকারীরা করছে, সেগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধ। আন্তর্দেশীয় ওই অপরাধী চক্রকে চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ উপেক্ষিত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন থেকে।

সম্প্রতি মালয়েশিয়ার মানবাধিকার কমিশন ও বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা ফরটিফাই রাইটসের যৌথ প্রতিবেদনে মিয়ানমার, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া এই চার দেশের মানবপাচারকারী চক্রের তৎপরতা তুলে ধরা হয়। ছয় বছরের অনুসন্ধান শেষে ‘মাছের মতো মানুষ বিক্রি’ শিরোনামের ১২১ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংস্থা দুটি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১২ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ১ লাখ ৭০ হাজারেরও বেশি মানুষ বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ছেড়ে সাগরপথে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাড়ি জমায়। ওই সময় সন্ধান পাওয়া গণকবরে বাংলাদেশি আর মিয়ানমারের নাগরিকদের ওপর মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত হয় বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

এতে বলা হয়, ভালো আয় আর আশ্রয়ের প্রলোভনে পাচারকারীরা এসব মানুষকে সমুদ্রপথে পাচারের ব্যবস্থা করে। এর মাধ্যমে তারা বছরে ৪০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। চার বছরে এর পরিমাণ দেড় হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, পাচার হওয়াদের একটি বড় অংশ রোহিঙ্গা। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে পাচারকারীরা বাংলাদেশিদের ওপরও নজর দেয়।

মানবাধিকার কমিশনের কমিশনার জেরাল্ড জোসেফ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ঘটনার শিকার ব্যক্তি ও তাদের পরিবার যে ভয়ানক ও জঘন্য অপরাধের শিকার হয়েছে, সেটা যাতে ভবিষ্যতে মালয়েশিয়া বা পৃথিবীর কোথাও না ঘটে, তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার সময় এসেছে। এই প্রতিবেদন ভুক্তভোগীদের বিচার পাওয়া, সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির আওতায় আনা এবং মালয়েশিয়া ও আঞ্চলিক পর্যায়ে নীতিগত পরিবর্তনের সুযোগ তৈরির জন্য পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ নিয়ে আসতে পেরেছে।

এই প্রতিবেদন তৈরিতে সংস্থা দুটি প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনার শিকার, পাচারকারী, সরকারি কর্মকর্তাসহ ২৭০ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। সমুদ্র, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের পাচার ক্যাম্পে রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুদের উপর পাচারকারীদের বিভিন্ন ধরনের অপরাধের তথ্যপ্রমাণ নিয়েছে। ওয়াং কেলিয়াংয়ে গণকবর ও পাচার ক্যাম্পের খবর পাওয়ার পর মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষ কীভাবে সাক্ষ্য প্রমাণ মিটিয়ে দিয়েছে তাও তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে।

২০১৫ সালের ৩০ এপ্রিল থাইল্যান্ডের কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে যে মালয়েশিয়া সীমান্তের কাছাকাছি একটি গণকবরে ৩০ জনের মরদেহ পাওয়া গেছে। ধারণা করা হয়, এরা পাচারের শিকার বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা। ৩০ মে মালয়েশিয়ার ওয়াং কেলিয়াংয়ে ১৩৯টি কবর ও ২৮টি মানবপাচার ক্যাম্প পাওয়ার কথা জানায় মালয়েশিয়ার রাজকীয় পুলিশ।

এ ঘটনায় ২০১৭ সালে থাইল্যান্ডের সরকার পাচারকারী চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে ৯ সরকারি কর্মকর্তাসহ ৬২ জনকে অভিযুক্ত করে। মালয়েশিয়া এ পর্যন্ত মাত্র চারজনকে অভিযুক্ত করে। তাদের সবাই অন্য দেশের নাগরিক।

প্রতিবেদনে উঠে আসা নির্যাতনের চিত্র : প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের বরাত দিয়ে পাচারকারীদের অত্যাচার ও নির্যাতনের নির্মম চিত্র তুলে ধরা হয়। কীভাবে ফুসলিয়ে, মিথ্যা তথ্য দিয়ে কিংবা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে সমুদ্রপথে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় তার তথ্য পাওয়া গেছে। এদের কেউ কেউ চেয়েছিল একটু ভালোভাবে বাঁচার জন্য মালয়েশিয়ায় যেতে।

আবার কেউ চেয়েছে ভালো একটি কাজ। সমুদ্রে গিয়ে পাচারকারীদের হাতে কীভাবে বারবার বিক্রি হয়েছে তাও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে মুক্তিপণও।

একজন পাচারকারীর বক্তব্য উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘মানুষ মাছের মতো বিক্রি হয়ে এক হাত থেকে আরেক হাতে গেছে। এ কারণে দাম (মুক্তিপণ) বেড়েছে। পাচারকারীরা অগণিত নারী, পুরুষ ও শিশুকে নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণসহ নানা ধরনের নিপীড়ন চালিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই তাদের বেচাকেনা করা হয়েছে।’

প্রতিবেদনের তথ্যমতে, চক্রের সদস্যরা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নৌকায় তোলার পরই জিম্মি করে ফেলত। তাদের জন্য তখন তিনটি পথ খোলা ছিল। এক. প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা দিয়ে মুক্তি পাওয়া। দুই. আরেক চক্রের কাছে বিক্রি হওয়া। তিন. বন্দি অবস্থায় মারা যাওয়া।

২০১৪ সালে এবাদুল্লাহ নামের একজন মালয়েশিয়া থাইল্যান্ড সীমান্তের একটি ক্যাম্পে তিন মাস কাটিয়েছেন। তিনি অনেক মানুষ মরতে দেখেছেন। এ সময় ২০০ জন মারা গেছে। অনাহারে অনেকে মারা গেছে। এবাদুল্লাহ বলেন, ‘মারা যাওয়ার পর তাদের মরদেহের সামনে আমরা প্রার্থনা করেছি। কিন্তু কিছুক্ষণ পর তাদের গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে জানি না।

রহিম উল্লাহ নামে রাখাইনের এক রোহিঙ্গা তার জবানবন্দিতে শিবিরগুলোতে ভয়ংকর নির্যাতনের কথা তুলে ধরেন। ১৬ বছর বয়সী রহিম জানায়, মালয়েশিয়া থাই সীমান্তের ক্যাম্পে তাদের কাছে প্রতিদিন টাকা চাওয়া হতো। দিতে না পারলেই মাথা ও শরীরে গরম পানি ঢেলে দেওয়া হতো। এটা তারা প্রতিদিনই করত। আমার পা চেতনাহীন হয়ে যেত। যারা টাকা দিতে পারত না তাদের কোনো খাবার, ওষুধ দেওয়া হতো না। এতে অনেকেই মারা গেছে।

থাইল্যান্ডে পাচারকারীদের শিবিরে ছয় মাস জিম্মি জীবন কাটানো নূর বেগম বলেন, প্রতিদিনই মানুষ মরেছে। কোনো দিন বেশি, কোনো দিন কম। বর্বর নির্যাতনের কারণে তারা তাদের স্বজনদের ফোন করে টাকা পাঠাতে অনুরোধ করতেন। তিনি বলেন, পাচারকারীরা অমানুষিক নির্যাতন করত এবং অন্যদের তা দেখতে বাধ্য করত। শিশুরা কাঁদলে তাদের ওপরও নির্যাতন চালাত।

থাইল্যান্ডের এক পাচারকারী স্বীকার করেছে, যেসব রোহিঙ্গা নারী মুক্তিপণ দিতে পারত না তাদের বিক্রি করে দেওয়া হতো। গবাদিপশুর মতো বেচাকেনা হতো। তার তথ্যমতে, অনেকে বিয়ের জন্য ওই নারীদের মুক্তিপণ দিয়ে কিনেছেন। অনেকে কিনেছেন গৃহস্থালি বা অন্যান্য কাজের জন্য। এই বেচাবিক্রিতে দালালরাই ছিল মূল মাধ্যম।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিক্রির জন্য দর কষাকষির একাধিক কথোপকথনের রেকর্ড তারা পেয়েছেন। জাহাজে সহযাত্রী পুরুষের কাছ থেকে আলাদা করে রাখা হতো নারী ও শিশুদের। সেখানে অনেক নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

থাইল্যান্ডে পাচার হওয়া বাংলাদেশি মোহাম্মদ খান বলছেন, এক সহযাত্রী পকেট থেকে দুটি সন্তানের ছবি বের করে কাঁদতে কাঁদতে সাগরে ঝাঁপ দেন। সেখানেই মারা যান তিনি। তিনি বলেন, ‘চারদিকে পানি। অথচ পান করার মতো এক ফোঁটা পানিও ছিল না। বৃষ্টি না হলে আমরা সবাই হয়তো মারা যেতাম। পাচারকারীরা পাঁচ দিনে একবার খাবার দিলেও পানি দিত না। পানির তৃষ্ণায় অনেকেই সাগরে ঝাঁপ দিয়ে মারা গেছে।’

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved  2019 CitizenNews24
Theme Developed BY ThemesBazar.Com