নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের অন্যতম বৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠান দি সিটি ব্যাংক বাংলাদেশের প্রাক্তন নারী কর্মকর্তা মনিরা সুলতানা পপি মিডিয়াতে কিছুদিন ধরেই ব্যাংকটির বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করে যাচ্ছেন। এবার সংবাদ সম্মেলন করতে এসে উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছেও পপির মিথ্যাচার হাতেনাতে ধরা পড়ছে। নিজের মনগড়া বক্তব্য উপস্থাপন ছাড়া কোন প্রশ্নেরই সুদুত্তর দিতে পারেননি এই পপি। সিটি ব্যাংক ও ব্যাংকটির প্রধান তিন নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তাঁর ঢালাও মিথ্যাচারের এক পর্যায়ে উপস্থিত সাংবাদিকরা প্রমান হাজির করলে এক বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
শনিবার (১৯ অক্টোবর) বেলা ১২টায় সেগুনবাগিচাস্থ বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স এসোসিয়েশনে এই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে পপির পক্ষে আরও উপস্থিত ছিলেন নামসর্বস্ব আদর্শ সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গনাইজেশন (এএসডিও) জনৈক মোকসেদুল ইসলাম, জন বিজ্ঞান ফাউন্ডেশনের জোছনা মন্ডল পুতুল, মানবাধিকার কর্মী পরিচয়দানকারী কৃিষ্ট চাকমা, শ্রমজীবি নারী নেত্রী রাজিয়া সুলতানা প্রমুখ। এই ক’জনের মৌখিক পরিচয়দানের সঙ্গে বাস্তবের কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনকি এই ক’জন বাস্তবে পরিচয় দিতেও বিব্রতবোধ করছিলেন। সংবাদ সম্মেলনের মাঝামাঝি পপি যখন ব্যাংকের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগের স্বপক্ষে কোন সুদুত্তরই দিতে পারছিলেন না, তখন এসব মানবাধিকার কর্মী কিংবা শ্রমজীবি নারী নেত্রী পরিচয়দানকারীরা তড়িগড়ি মঞ্চ ছেড়ে পালিয়ে যেতে দেখা যায়। এসময় পপির ক্রমাগত মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে কিছু সংবাদকর্মী উল্টো একাধিক বাস্তব প্রমাণ তুলে ধরেন। এরপর সংবাদ সম্মেলনের শেষ দিকে পপিও কোনমতে পালিয়ে বাঁচেন।
গুলশান থানায় ব্যাংকটির প্রধান তিন নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পপির করা মামলার বিষয়টি এখন আইনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চলছে। সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের আইজি, পুলিশ কমিশনার, মামলার আইও, গুলশান থানার ওসি ও ডিসির বিরুদ্ধাচারন এবং বিচার ব্যবস্থা প্রভাবিত করার অভিযোগ তুললে পরিস্থতি আরও ঘোলাটে হয়ে পড়ে।
বিশেষ করে ব্যাংকের চাকরির আড়ালে একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতেন মনিরা সুলতানা পপি। লেগেসি মেকওভার (বিউটি পার্লার), লেগেসি ইন্টারন্যাশনাল প্রি স্কুল অ্যান্ড ডে-কেয়ার (স্কুল), লেগেসি গ্লোবাল কনসালটেন্সি (এজেন্ট ব্যাংকিং), এনএমসি এন্টারপ্রাইজ (এজেন্ট ব্যাংকিং) নামে তাঁর চারটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা সিটি ব্যাংকের সঙ্গে ব্যাংকের ২১ নং চাকুরিবিধির স্পষ্ট লঙ্ঘন কিংবা চাকরির শর্তের খেলাপ হয়েছে। তাঁর এইসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ট্রেডলাইসেন্স রয়েছে যা অধিকতর তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। তাঁর চারটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঠিকানাগুলো- (লেগেসি মেকওভার) এইচ-২৭৭, রোড-১৬, ব্লক-কে, দক্ষিণ বনশ্রী, ঢাকা, (লেগেসি ইন্টারন্যাশনাল প্রি স্কুল অ্যান্ড ডে-কেয়ার) এইচ-৭০, রোড-৬, ব্লক-বি, দক্ষিণ বনশ্রী, ঢাকা, (লেগেসি গ্লোবাল কনসালটেন্সি) বনশ্রী, ঢাকা, (এনএমসি এন্টারপ্রাইজ) এইচ-৭০, রোড-৭, ব্লক-বি, দক্ষিণ বনশ্রী, ঢাকা। একজন সংবাদকর্মী পপির নামে থাকা ট্রেড লাইসেন্স মেলে ধরলে পপি তা আর অস্বীকার করতে পারেননি। এরপরও কিভাবে ব্যাংকে চাকুরী করতে চান একজন সংবাদকর্মী প্রশ্ন করলে একেবারে নিশ্চুপ হয়ে যান পপি।
গত ১৮ আগস্ট গুলশান থানায় ব্যাংকটির প্রধান তিন নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পপি যৌন হয়রানির মামলা দায়ের করেছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে একজন সংবাদকর্মী তাঁরই মুঠোফোনে ব্যাংকের কাছে ৫ কোটি টাকা চাঁদা দাবির পপির একটি ভয়ের্স রেকর্ড আছে বলে জানালে সবাই নড়েচড়ে বসেন। একপর্যায়ে ভয়েস রেকর্ডটি শুনে দেখা যায়, মামলা দায়েরের একদিন আগে ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে দীর্ঘ কথোপকথনে পপি ৫ কোটি টাকা দাবি করেন এবং বলেন যে, এই টাকা দেওয়া হলে তিনি আর মামলা করবেন না। এই হুমকিতে পপি দেশের বিশিষ্ট কিছু ব্যক্তির নামও যুক্ত করেছিলেন। এই পুর্ণাঙ্গ কথোপকথনটির ৪৫ মিনিটের স্পষ্ট অডিও রেকর্ড ব্যাংকের কাছেও রয়েছে। গত ২০ আগস্ট সিটি ব্যাংকও পপির বিরুদ্ধে এই আলামতসহ একটি ব্লাকমেইলিং প্রচেষ্টা মামলা দায়ের করেছে। এই রেকর্ডের প্রসঙ্গে জানতে চাইলেও পপি আমতা আমতা শুরু করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংককে অডিট রিপোর্টে অসহযোগিতা সংক্রান্ত অভিযোগেরও কোন জবাব দিতে পারেননি পপি। এরপর ল্য মেরিডিয়েন হোটেলের রেস্টুরেন্ট/বেকারিতে নিজের ব্যক্তিগত লোকজন নিয়ে ব্যাংকের নামে ‘বকেয়া’ বিল করা এবং ব্যবহার খারাপ করার প্রসঙ্গও পপি এড়িয়ে গেছেন। ব্যাংকের নিজস্ব তদন্তে বেরিয়ে আসে যে, পপি মোট ২০০ রাতের বেশি ব্যাংকের পুলের গাড়ি নিয়ে বিভিন্ন স্থানে গিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে পপি কৌশলে তড়িগড়ি বলেন, ‘আমি চলে আসবার পর এসব তদন্ত হয়েছে।’
এরপর পপি ব্যাংক এমডিকে তার নতুন পদবীর একটি বিজনেস কার্ড পাঠান যাতে জাতীয় সংসদের লোগো ব্যবহার করে তিনি নিজেকে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের অভিবাসন ও উন্নয়ন বিষয়ক সংসদ ককাস চেয়ারম্যানের সচিব হিসেবে তুলে ধরেন। এদিকে অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত ভিজিটিং কার্ডে জাতীয় সংসদের লোগো ব্যবহার এবং সংসদ ভবনে প্রবেশের পাশ ফেরত না দেয়ায় ককাশ চেয়ারম্যান ও নওগাঁ-৬ আসনের সংসদ সদস্য ইসরাফিল আলমের নির্দেশে তাঁরই ব্যক্তিগত সহকারী আশিক মল্লিক গত ১৫ সেপ্টেম্বর শেরেবাংলা নগর থানায় পপির বিরুদ্ধে জিডি করেছিলেন। যার নম্বর ৯৪২। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পপি জানান, শেরেবাংলা নগর থানায় তারই স্বপক্ষে সব ডকুমেন্ট তিনি ইতিমধ্যে জমা দিয়েছেন। যদিও উপস্থিত সাংবাদিকদের কোন ডকুমেন্ট দেখাতে পারেননি পপি।
বিভিন্ন সংবাদকর্মীদের প্রশ্নের সুত্র থেকে আরও জানা যায়, চাকরিচ্যুত হওয়া পপির কাছে বর্তমানে ব্যাংকের পাওনা প্রায় ১ কোটি ৮ লক্ষ টাকা। টাকা ফেরত না দেওয়ার জন্যই এসব টালবাহানা করেছেন এই কর্মকর্তা। ব্যাংকের পাওনার বিষয়টি স্বীকার করে নিলেও পরিশোধ কেমন করে করবেন তার কোনই উত্তর পপি দিতে পারেননি। সিটি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হুসেইনের ব্যক্তিগত সহকারী মনিরা সুলতানা পপির বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা বিরোধী নানা অভিযোগ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তদন্তে প্রমাণিত হয়েছিল। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পপিকে পে-রোল ব্যাংকিং বিভাগে বদলি করা হয়। বদলির পর থেকে মনিরা সুলতানা পপি দীর্ঘদিন কর্মস্থলে কোনো ধরনের পূর্ব অনুমতি ছাড়াই অনুপস্থিত ছিলেন। ব্যাংকের নিয়ম ও প্রচলিত আইন অনুযায়ী তাকে তিনবার রেজিস্ট্রি ডাকযোগে নোটিস পাঠায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। তারপরও পপি কর্মস্থলে যোগদান না করায় এবং অননুমোদিত অনুপস্থিত থাকায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে অব্যহতি পান।
বর্তমানে প্রভিডেন্ট ফান্ড ঋণ, হাউজ বিল্ডিং ঋণ, ক্রেডিট কার্ড ও গাড়ির ঋণ, ব্যক্তিগত ঋণ খাতে মনিরা সুলতানা পপির কাছে তার চাকরিরত থাকাকালে যাবতীয় প্রাপ্ত টাকা সমন্বয় করার পরও ব্যাংকের প্রায় ১ কোটি ৮ লক্ষ টাকা পাওনা রয়েছে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এসব ঋণের টাকা পরিশোধ করার জন্য তাকে নোটিসও দিয়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গ সংবাদ সম্মেলনে পপি এলোমেলো কথাবার্তা বলেছেন। চাকরিরত ড্রাইভারদের বক্তব্য অনুযায়ী, মনিরা সুলতানা পপি মধ্যরাতে বিভিন্ন আবাসিক হোটেল, পার্লারসহ অন্যান্য স্থানে যেতেন। মধ্যরাতে ওইসব জায়গায় যাওয়ার সময় অপরিচিত লোকজন ব্যাংকের গাড়িতে উঠে বসতো। পপি নিয়মিত নেশা করতেন বলেও তাদের বক্তব্যে প্রকাশ পেয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে এসব প্রসঙ্গও উঠে এসেছে। এদিকে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াই পপির বেশ কিছু অশালীন ছবি ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। নেটিজেনরা দাবি করেছে, যে মেয়ে নিজেই অশালীন পোশাক পরে, তার আবার কিসের শ্লীলতাহানি! এসবের জন্য সংবাদ সম্মেলনে উল্টো ব্যাংক কতৃপক্ষকেই বারবার দায়ী করে গেছেন পপি। সংবাদ সম্মেলনে নানা প্রশ্ন থেকে আরও জানা গেছে, সিটি ব্যাংকে মনিরা সুলতানা পপির নিয়োগ প্রক্রিয়াটি ছিল অস্বচ্ছ। ব্যাংকে চাকরির কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। পপি সিটি ব্যাংকের আগে অন্য কোনও ব্যাংকেও চাকরি করেননি। এক সময় তিনি রেডিসন হোটেলের স্পা গার্ল হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সেখান থেকে সিটি ব্যাংকের সাবেক এক কর্মকর্তার মাধ্যমে ব্যাংকটিতে যোগদান করতে সমর্থ্য হন।
চাকরিতে যোগদানের পরবর্তী সময়ে ব্যাংকে কর্মরত অবস্থায় তার জীবনযাপন ও চলাফেরায় আগের উগ্রতা প্রকাশ পায়। এসব বিষয়ে প্রশ্ন করলে পপি কিছুটা স্বীকার করে জানান, এর আগে তিনি বাংলালিংকে সিটি ব্যাংকের একই পদবীতে চাকুরী করেছেন। তবে কোন ব্যাংকে তিনি ছিলেন না। এরকম চরম মুহুত্বে পরিবারের আপনজন কেউ উপস্থিত নেই কেন জানতে চাইলে পপি জানান, ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সিঙ্গল মাদার। বনিবনা না হওয়ায় স¦ামীর সঙ্গে তার আগেই ডিভোর্স হয়ে গেছে। তার গ্রামের বাড়ি কুিষ্টয়ায়। সেখানে তার বাবা রয়েছেন। ঢাকায় মনিরা তার মায়ের সঙ্গে থাকছেন। এটুকু বলেই এক পর্যায়ে মনিরা সুলতানা পপি সংবাদ সম্মেলন থেকে তড়িগড়ি সরে যেতে থাকেন। তার সঙ্গীরা আগেই সরে পড়েছিলেন।