আগামী দিনে বৈশ্বিক বাণিজ্যের লড়াই আর জ্বালানি তেলকে কেন্দ্র করে থাকবে না। জীবাশ্ম জ্বালানির নেতিবাচক ফলাফল, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানির বাজারের নতুন মোড়সহ বিভিন্ন কারণে আগামী দিনে সবুজ জ্বালানি বাস ক্লিন এনার্জির প্রতি ঝুঁকবে বিশ্ব। বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্ব। তাই আগামী দিনের বাণিজ্যিক লড়াইটা জমে উঠবে বিভিন্ন প্রকার ধাতু এবং ক্লিন এনার্জি সংশ্লিষ্ট খাতের কাঁচামালকে ঘিরে।
ইউক্রেন যুদ্ধ দেখিয়ে দিয়েছে, জ্বালানি চাহিদা মেটানোর জন্য কোনো একনায়কতান্ত্রিক দেশের ওপর নির্ভর করলে তার ফলাফল কী হতে পারে! তারপরও যদি শিগগিরই ইউরোপের জ্বালানি সংকট মিটে যায়, ইউরোপের নজর থাকবে জ্বালানি তেল-গ্যাসের বিকল্প তৈরি করার দিকে। আর এক্ষেত্রে বিভিন্ন ধাতু এবং বিরল মৃত্তিকা ধাতু এবং সংশ্লিষ্ট খাতের কাঁচামালই হবে আগামী দিনে বাণিজ্যিক লড়াইয়ের মূল বিষয়বস্তু। একই সঙ্গে বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউরোপ তুলনামূলক একটি পরিষ্কার অর্থনীতি গড়ে তুলতেও এসব ধাতু নিয়ামক ভূমিকা পালন করবে।
ইউরোপ যদি ক্লিন এনার্জি এবং ক্লিন ইকোনমি গড়ে তুলতে চায় তবে বিশ্লেষকদের হিসাব ২০৫০ সাল নাগাদ তাদের অন্তত ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির তথ্যানুসারে, একই সঙ্গে কপার, লিথিয়াম, গ্রাফাইট, নিকেল এবং অন্যান্য বিরল মৃত্তিকা ধাতুর উৎপাদন ২০৪০ সালের মধ্যে অন্তত ৬ গুণ বাড়াতে হবে।
তবে গোলটা বাঁধবে এখানেই। কারণ বর্তমানে চীনই একচ্ছত্রভাবে এসব ধাতব পদার্থের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করছে। যেমন বৈশ্বিক লিথিয়াম পরিশোধনের ৫৮ শতাংশ একা করে চীন। তেমনিভাবে ৬৫ শতাংশ কোবাল্ট, এক-তৃতীয়াংশ নিকেল কপারের পরিশোধন এবং উৎপাদন এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করে চীন। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে প্রায় এক ঘরে হয়ে যাওয়া রাশিয়াও এসব ধাতব পদার্থের বড় একটি অংশ উৎপাদন ও পরিশোধন করে। বিশেষ করে নিকেল, কোবাল্ট, প্যালাডিয়ামের বড় উৎপাদক মস্কো। বিপরীতে ইউরোপই এসব ধাতব পদার্থের চাহিদার ৭৫ থেকে ১০০ ভাগই আমদানি করে থাকে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ইউরোপ নিজের পরিকল্পনার কাছে নাজুক।
এক্ষেত্রে চীন-রাশিয়ার ওপর থেকে নির্ভরতা কমাতে পশ্চিমা কোম্পানিগুলো বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তি করতে পারে। নিজ দেশে থাকা খনি চালু করতে পারে। এরইমধ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তি করা শুরু হয়ে গেছে। পশ্চিমা গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে গেছে। বিমা প্রতিষ্ঠান ফিচ সল্যুশনসের তথ্য বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের জেনালের মোটরস অস্ট্রেলিয়ার কুইনসল্যান্ড প্যাসিফিক মেটালের সঙ্গে চুক্তি করেছে। তারা জেনারেল মোটরসকে নিকেল এবং কোবাল্ট সরবরাহ করবে। এসব ধাতব পদার্থ গ্রিন এসইউভি নির্মাণে ব্যবহার করা হবে।
অন্য দেশের সঙ্গে চুক্তিটি সহজ হলেও নিজ দেশে খনি চালু করার বিষয়টি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ার বিষয়। লিথিয়ামের কথাই ধরা যাক। ইউরোপের দেশগুলো এখনও পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে এক আউন্স লিথিয়ামও উৎপাদন করে না। বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনের এই অত্যাবশ্যকীয় উপাদানটির বৈশ্বিক চাহিদার মাত্র ২ শতাংশ সরবরাহ করে যুক্তরাষ্ট্র। তবে এখন পরিস্থিতি বদলাচ্ছে।
স্বর্ণখনির ব্যবসাকারী বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান সিবনে স্টিলওয়াটার ২০২৫ সালে ফিনল্যান্ডে তাদের প্রথম লিথিয়াম খনি খনন শুরু করবে বলে মনস্থির করেছে। প্রতিষ্ঠানটি ২০২৮ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরে ৩৪ হাজার টন লিথিয়াম হাইড্রোক্সাইড আহরণ করার লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করেছে। যদি ইউরোপের সব লিথিয়াম খনি একসঙ্গে কাজ শুরু করে তবে ২০৩০ সাল নাগাদ ইউরোপে লিথিয়াম কার্বোনেটের যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে তার অন্তত ৪০ শতাংশ পূরণ করতে পারবে। কেবল ইউরোপই নয়, লিথিয়াম উৎপাদনে এগিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের ৩ শতাংশ লিথিয়ামের মজুত থাকা দেশটি লিথিয়ামসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খনিজ ধাতু আহরণ শুরু করতে নতুন একটি আইনও পাশ করেছে।
তবে পশ্চিমা বিশ্বের এসব উদ্যোগের কোনোটাই নিশ্ছিদ্র নয়। কারণ, পরিবেশ বিপর্যয় একটি বড় ইস্যু হতে পারে এক্ষেত্রে। এছাড়া খনির আশপাশে থাকা লোকদের উচ্ছেদ করার বিষয়টিও ঝামেলা তৈরি করতে পারে। সেক্ষেত্রে স্থানীয় জনগণ এবং পরিবেশবাদীরা মিলে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে। ফলে আইনি জটিলতাও তৈরি হতে পারে। এর বাইরেও বিভিন্ন খনি মালিকরা মিলে মূল্যবান ধাতুর দাম নিজেদের ইচ্চামতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, উৎপাদনও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। ফলে যেকোনো সময় চাহিদার বিপরীতে যোগান কমে যেতে পারে, বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
সেক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে একটি টেকসই পদ্ধতি হতে পারে, যেসব বস্তুতে প্রয়োজনীয় মূল্যবান ধাতুগুলো ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো থেকে ধাতব পদার্থগুলো সর্বোচ্চ পরিমাণে পুনরাহরণ কিংবা রিসাইকেল করা। ইউমিকোর এবং রেডউডের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে এরইমধ্যে লিথিয়াম ব্যাটারি এবং স্মার্টফোন রিসাইকেল করার মতো প্রযুক্তি রয়েছে। কেবল তাই নয়, ইউরোপ এখনো বিশ্বে যে পরিমাণ ব্যাটারি উৎপাদিত হয় তার ১৭ শতাংশ রিসাইকেল করে উৎপাদন করে। তবে ফিচ সল্যুশনসের সুপারিশ হলো, নির্ভরতা কমাতে চাইলে এই হারকে ২০২৫ সালের মধ্যেই ৪৮ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। তবে এই বিষয়টিও সহজলভ্য নয়, বরং ব্যয়বহুল।
মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম ব্লুমবার্গের গবেষণা উইং ব্লুমবার্গএনইএফ একটি গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে বলেছে, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে মুক্তি পেতে চাইলে হাইড্রোজেন জ্বালানি, সোলার সিস্টেম ইত্যাদি ক্লিন এনার্জি খাতে ২০৫০ সাল নাগাদ অন্তত ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে হবে।
ফলে, ইউরোপের হাতে প্রযুক্তিগত দক্ষতা, আর্থিক সংস্থান থাকলেও খুব সহজেই তারা মূল্যবান ধাতু এবং খনিজ পদার্থের একচেটিয়া বাজার থেকে চীন-রাশিয়াকে হটাতে পারবে না। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় জীবাশ্ম জ্বালানিকে বাদ দিয়ে বিশ্ব যতই ক্লিন এনার্জি এবং ক্লিন ইকোনমির দিকে হাটবে আগামী দিনের বাণিজ্যিক লড়াই ততই জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে বিভিন্ন মৌলিক ধাতু এবং তৎসংশ্লিষ্ট কাঁচামালের বাজারকে ঘিরে আবর্তিত হবে।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স