মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৯ পূর্বাহ্ন
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ::
সিটিজেন নিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে। যারা আগ্রহী আমাদের ই-মেইলে সিভি পাঠান

রাহুল গান্ধীর দণ্ডাদেশ: যেভাবে লাভবান হতে পারে কংগ্রেস

  • আপডেট টাইম : বুধবার, ৫ এপ্রিল, ২০২৩
  • ৯৭ বার পঠিত

ভারতের কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলায় দুই বছরের সাজা সম্প্রতি স্থগিত করেছেন আদালত। পাশাপাশি এ মামলায় তাকে জামিনও দেয়া হয়েছে। ‘মোদি’র পদ নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্যের দায়ে গত ২৩ মার্চ রাহুলকে দুই বছরের সাজা দেন গুজরাটের একটি আদালত। এ রায় ঘোষণার পরপরই লোকসভায় অযোগ্য ঘোষণা করায় সেখানে বাতিল হয়ে যায় তার সদস্যপদ।

আইনের মারপ্যাঁচে রাহুল গান্ধী এবং কংগ্রেসের কাছে লোকসভা থেকে তার বহিষ্কারাদেশই সবচেয়ে বড় ইস্যু। আইন অনুসারে, সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় আর লোকসভার সদস্য থাকতে পারবেন না রাহুল গান্ধী। তবে তারচেয়েও বড় আশঙ্কার বিষয় হলো, এ দণ্ডাদেশ বহাল থাকলে তিনি মোট আট বছর কোনো ধরনের নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না (সাজার দুই বছর এবং সাজা শেষে ৬ বছর)।

চলতি বছরের জুনে ৫৩ বছরে পা দেবেন রাহুল গান্ধী। তাই তাকে যদি ৮ বছর সব ধরনের নির্বাচনের বাইরে থাকতে হয়, তবে ৬০ বছরের আগে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রিত্বের জন্য লড়তে পারবেন না। কারণ, তার সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তিনি কেবল ২০৩৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। সে সময় রাহুলের বয়স হবে ৬৪ বছর। অবশ্যই এর মাঝে কোনো মধ্যবর্তী নির্বাচন হলে আলাদা কথা। এ একটি মামলাই শেষ নয়, রাহুলের বিরুদ্ধে আরও মামলা চলমান। বিশেষ করে কংগ্রেসের দলীয় পত্রিকা ন্যাশনাল হেরাল্ড দুর্নীতি মামলাও এগিয়ে চলেছে জোরশোরে।

এসব কিছুকে আলাদাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, এ সাজা এমন একসময় এসেছে, যখন কংগ্রেস থেকে বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা চলে গেছেন। এদের আবার অনেকেই কংগ্রেসের প্রধান বিরোধী বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। এ অবস্থায় রাহুল গান্ধীর ওপর এমন দণ্ডাদেশ মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিতে পারে। কিন্তু রাহুলের এ দণ্ডাদেশ থেকে লাভবান হতে পারে কংগ্রেস।

১৯৭৭-এর পুনরাবৃত্তি নয়
অনেকে মনে করছেন, রাহুল গান্ধী যে পরিস্থিতিতে পড়েছেন, তাতে ১৯৭৭ সালের মতো অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। সে সময় ইন্দিরা গান্ধী ও তার দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস জনতা পার্টির কাছে নির্বাচনে হেরে গিয়েছিল। এর পরপরই ইন্দিরা গান্ধীকে সিবিআইর কড়া জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়। সে সময় ইন্দিরা নিজেকে প্রথমে ‘রাজনীতির শিকার’ এবং পরে ‘যোদ্ধা’ হিসেবে জনগণের সামনে নিজেকে উপস্থিত করতে পেরেছিলেন।

সে বছর অর্থাৎ ১৯৭৭ সালে ইন্দিরার জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছিল বিহারের বেলখি গ্রামের গণহত্যা। ইন্দিরা এ গণহত্যাকে নিজের কাজে লাগান এবং গ্রামটি পরিদর্শনের সুযোগ নেন। তিনি প্রথমে ট্রেন যোগে, তারপর কিছুটা পথ জিপে করে, এরপর কিছুটা পথ টানা বৃষ্টিতে ভিজে ট্রাক্টরে করে সেই গ্রামে পৌঁছান। এমনকি তাকে হাতির পিঠেও সওয়ার হতে হয়েছিল। সেখানে তিনি গ্রামবাসী এবং হতাহতদের পরিবারে সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ১৯৮০ সালে আবারও ক্ষমতায় ফিরে আসেন।

কিন্তু আজকের পরিস্থিতি কোনোভাবেই ১৯৭৭ সালের মতো নয়; বরং অনেকটাই আলাদা। কারণ তখনকার জনতা পার্টি ছিল একটি ‘খিচুড়ি দল’। ফলে কংগ্রেসের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইকে হটিয়ে তার জায়গায় চরণ সিংকে বসাতে এবং তারপর চরণ সিংকে একটি নতুন নির্বাচন দিতে বাধ্য করাতেও খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি।

কিন্তু রাহুল গান্ধী তার দাদির মতোও নন এবং জনতা পার্টির মতো বিজেপিও নরম দল নয়। তার চেয়েও বড় কথা হলো রাহুলকে পার্লামেন্টারি এবং নির্বাচনের রাজনীতিতেই থাকতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। ফলে রাহুলের জন্য বাকি থাকে কেবল একটি পথ। সেটি হলো ‘বেলখি মুহূর্ত’। তবে সেই সুযোগ আদৌ রাহুলের জন্য আসবে কিনা কিংবা এলেও কত দেরিতে আসবে, সে বিষয়ে কারোরই জানা নেই।

নতুন রাহুল গান্ধী
রাহুল গান্ধীর সাজা কী কংগ্রেসের জন্য কেবলই খারাপ সংবাদ, আসলে তা নয়। রাহুল গান্ধী নির্বাচনের জন্য যোগ্য হন বা অযোগ্য হন এটি আন্দাজ করা যেতে পারে যে, তিনি এসব বিষয় নিয়ে ভেবে তার রাজনৈতিক লক্ষ্যকে বাধাগ্রস্ত করবেন না। তার চেয়ে বরং বিজেপির বিকল্প হিসেবে কংগ্রেস দেশবাসীর সামনে কী হাজির করতে পারে তার সে বিষয়ে মনোযোগ দেয়া উচিত।

বিরোধী দল হিসেবে কংগ্রেস ক্ষমতাসীন দল এবং এর নেতাদের সমালোচনা করতেই পারে। তবে এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, মানুষ কেবল সমালোচনা শুনতে আগ্রহী নয়, তারা শুনতে চায় সমস্যার কথা এবং সেগুলোর সমাধানের কথা। একই সঙ্গে কংগ্রেসকে এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশের বিশাল অংশের মধ্যেই জনপ্রিয়। তার জনপ্রিয়তাকে টেক্কা দিতে চাইলে কংগ্রেসকে নতুন এবং উদ্ভাবনী ধারণা হাজির করতে হবে জনগণের সামনে এবং জনমনে এ ধারণা রয়েছে যে, রাহুল গান্ধী নতুন নতুন উদ্ভাবনী ধারণা হাজির করতে পারেন। এমনটা চালিয়ে গেলে তা সবশেষে কংগ্রেসের জন্যই ফলদায়ক হবে।

আর নয় মোদি বনাম রাহুল লড়াই
যদি রাহুল গান্ধী লোকসভা থেকে চূড়ান্তভাবে বহিষ্কৃত হন এবং পরবর্তী ৮ বছর নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন, তবে তা নিঃসন্দেহে কংগ্রেসের জন্য একটি বড় আঘাত হবে। যদি এমনটা ঘটেই এবং রাহুল যদি পর্দার অন্তরালে অবস্থান নেন, তবে তা কংগ্রেসকে নানাভাবেই সহায়তা করতে পারে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।

যদিও বিজেপি প্রায়ই মজা করে বলে থাকে যে, রাহুল গান্ধীর কারণেই তারা নির্বাচনে জেতে। কিন্তু বাস্তবে সেটা সত্য নয়। কারণ, বিজেপির জয়ের মূল চালিকাশক্তি হলো নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তা, হিন্দু-জাতীয়তাবাদী ভাবধারার প্রচার, উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা এবং খণ্ডিত বিরোধী দল। বরং সত্য হলো, গেরুয়া শিবির তথা বিজেপি চায় লড়াইটিকে মোদি বনাম রাহুলে সীমাবদ্ধ করতে। আর এ থেকেই বোঝা যায়, বিজেপির কাছে রাহুলের গুরুত্ব কতটা।

মোদি বনাম রাহুল বিজেপির জন্য লাভজনক। কারণ, এ লড়াইয়ের বাইরে গিয়ে কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে তৃতীয় জোট গঠনের কথা ভাবছেন অনেকে। তাদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যতম। তিনি বলেছেন, রাহুল গান্ধীই মোদির সবচেয়ে বড় প্রচারক। ফলে কথিত রয়েছে যে, কংগ্রেস যদি দল হিসেবে বড়ভাই সুলভ আচরণ বন্ধ না করে এবং রাহুল যদি নেতা হিসেবে আরও আগ্রাসী মনোভাব না দেখান, তাহলে তৃতীয় জোট গঠিত হবে এবং তা অবশ্যই কংগ্রেসের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে না।

কারণ, তৃণমূল নেত্রী মমতা থেকে শুরু করে তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও এবং তার কন্যা কবিতা, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারসহ আরও অনেকেই রয়েছেন, যারা ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু এদের সবাই এখনো রাহুল গান্ধীর মা সোনিয়ার সঙ্গেই আলাপ-আলোচনা বা ডিল করতে পছন্দ করেন। এটা রাহুলের জন্য নিঃসন্দেহে একটি বড় বাধা। এমনকি দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল পর্যন্ত রাহুলকে প্রায়ই ব্যঙ্গ করেন।

তবে বৃহস্পতিবার কেজরিওয়াল তার সেই চিরাচরিত পথ থেকে বের হয়ে আসেন। এক টুইটে কেজরিওয়াল রাহুলকে কারাদণ্ড দেয়ার ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, ‘কংগ্রেসের সঙ্গে আমাদের মতভেদ আছে; কিন্তু রাহুল গান্ধীকে এভাবে মানহানির মামলায় জড়ানো ঠিক নয়। বিজেপিবিরোধী দলগুলোর নেতা ও দলগুলোকে মামলা দিয়ে শেষ করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।’ এই টুইটকে রাহুলের প্রতি কেজরিওয়ালের সমর্থন হিসেবে বিবেচনা করছেন অনেকে। তবে আবার অনেকে মনে করছেন, কেজরিওয়াল মূলত দুর্নীতির দায়ে তিহার জেলে বন্দি তার দলের দুই নেতার পক্ষে সহানুভূতি এবং জনমত টানতেই এমনটা বলেছেন।

তবে কেজরিওয়ালের এ পক্ষ নেয়া গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তৃণমূল, আম আদমি পার্টির মতো বিরোধীদলগুলো যখন আইনি সংস্থা দিয়ে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের হয়রানি না করার বিষয়ে চিঠি লিখেছিল যৌথভাবে, সেখানে কংগ্রেসকে সঙ্গে নেয়া হয়নি। যাই হোক, রাহুল গান্ধীর দণ্ডাদেশের পরদিন ভারতের ১৪টি বিরোধী দল সুপ্রিম কোর্টে সরকার সিবিআই এবং ইডির অপব্যবহার করছে মর্মে পিটিশন দায়ের করে। যেখানে কংগ্রেসও অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফলে এটি কংগ্রেস এবং রাহুল উভয়ের জন্যই একটি ইতিবাচক দিক হতে পারে।

প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর কী হবে
রাহুল গান্ধীর এ সংকট আশার আলো হয়ে দেখা দিতে পারে তার বোন প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর জন্য। এটি প্রিয়াঙ্কার জন্য দলীয় দায়িত্ব আরও ভালোভাবে বুঝে নেয়ার এবং নিজেকে এগিয়ে নেয়ার সুযোগ হতে পারে। দেখতে-শুনতে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী অনেকটাই তার দাদি ইন্দিরা গান্ধীর মতো। এছাড়া প্রিয়াঙ্কা গান্ধী জনসমাবেশে কথাও বলেন ভালো। পাশাপাশি তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও বেশ সাড়া জাগানো। পরিশ্রমী বলে খ্যাতিও রয়েছে তার। ফলে রাহুলের জায়গায় যদি তিনি এগিয়ে আসেন, তবে বিজেপি তার চিরচেনা প্রতিপক্ষের মুখ হারাবে। একই সঙ্গে বিজেপির পক্ষে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে আক্রমণ করাটাও কঠিন হবে। কারণ, ভাই রাহুলের মতো প্রিয়াঙ্কার বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা নেই।

তবে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী নিজে পরিচ্ছন্ন হলেও তার স্বামী রবার্ট ভদ্রের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। একাধিকবার রবার্টকে কেন্দ্র করে প্রিয়াঙ্কার বিরুদ্ধে তোপ দাগা হলেও তা তেমন কাজে আসেনি। দীর্ঘদিনের বিরতিতে বিষয়টিতে মরচেও ধরে গেছে। যাহোক, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভাইয়ের পক্ষ নিয়ে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন এক টুইটার পোস্টে। তবে তার উচিত হবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছেড়ে বেরিয়ে এসে ভাইয়ের ছায়া কাটিয়ে দলের সম্মুখসারিতে নিজের অবস্থানকে পোক্ত করা।

প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর একটি প্লাস পয়েন্ট আছে। আর সেটি হলো তিনি নারী এবং নারীর ক্ষমতায়ন সম্পর্কে তার যে ধারণা, সেটিকে কাজে লাগিয়ে তিনি দেশের নারী ভোটারদের কাছে পৌঁছাতে পারেন। যেমন, তিনি উত্তর প্রদেশে নারীর ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গে একটি ক্যাম্পেইন চালু করেছিলেন, ‘লাড়কি হুঁ, লাড় সাঁকতি হুঁ’ বা ‘আমি নারী, আমি লড়াইও করতে পারি’। সেটি খুব বেশি আলোচিত কিংবা সফল না হলেও ব্যর্থও হয়নি। তাই এক্ষেত্রে প্রিয়াঙ্কার হারানোর কিছু নেই। বরং বল এখন কংগ্রেসের কোর্টে। দেখা যাক কংগ্রেস সেটিকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।

(ইন্ডিয়া টুডে থেকে অনূদিত)

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved  2019 CitizenNews24
Theme Developed BY ThemesBazar.Com