নিজস্ব প্রতিবেদক
উপাধ্যক্ষ কামাল আতাউর রহমান ওরফে সাইক্লোনের চালচলন আর আচরণ দলীয় ক্যাডারকেও হার মানায়। যোগ্যতা না থাকার পরও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে সহকারী অধ্যাপক হওয়া, সহকর্মীদের মারধর, লাঞ্ছনা, সরকারের অর্থ আত্মসাতসহ তার অপকর্মেরও যেন শেষ নেই।
কামাল আতাউর রহমান ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা আদর্শ কলেজের উপাধ্যক্ষ। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) এক তদন্ত প্রতিবেদনে কামাল আতাউর রহমানের নানা অনিয়ম উঠে এসেছে। গত ২২ আগস্ট মাউশির ঢাকা অঞ্চলের পরিচালক অধ্যাপক মো. মনোয়ার হোসেন প্রতিবেদনটি জমা দেন।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কামাল আতাউর রহমান (ইনডেক্স নম্বর: ৪১১৩৫৯) কলেজ কর্তৃপক্ষের আবেদন ছাড়াই জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে ২০০৪ সালের জুলাই মাস থেকে বকেয়াসহ সহকারী অধ্যাপকের স্কেলে বেতন-ভাতা উত্তোলন করেন। ২০০৮ সালের ৪ মে মাউশি এক আদেশে তাকে সহকারী অধ্যাপকের পরিবর্তে প্রভাষক এবং বেতন কোড ৬-এর পরিবর্তে ৮ করে। একইসঙ্গে ২০০৪ সাল থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বেতন-ভাতায় নেওয়া অতিরিক্ত অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা দিতে কামাল আতাউর রহমানকে নির্দেশ দেওয়া হয়, যা এখন পর্যন্ত তিনি ফেরত দেননি।
পরবর্তীতে কামাল আতাউর রহমান প্রভাষক পদ ছেড়ে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে একই কলেজে উপাধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন এবং ২০১২ সালের জানুয়ারিতে এমপিওভুক্ত হন। কিন্তু ২০১১ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর তিন মাসের প্রভাষক স্কেলে অতিরিক্ত অর্থ উত্তোলন করে নেন।
কামাল আতাউর রহমানের বিরুদ্ধে সহকর্মীদের সঙ্গে বাজে আচরণ করার বিষয়টিও উঠে এসেছে মাউশির প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়, ২০১৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হয়। ওই অনুষ্ঠানে তৎকালীন অধ্যক্ষ মো. মোরশেদুর রহমানের সঙ্গে চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণভাবে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন।
এছাড়া তুচ্ছ কারণে সহকারী অধ্যাপক অবনী মোহন বিশ্বাসকে (প্রয়াত) শারীরিক ও মানসিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। ২০২২ সালের ৬ মে এম এম মুজিবুর রহমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব নেন। এর পরদিন ৭ মে কলেজের স্টাফ কাউন্সিল সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভয় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে অশ্রাব্য গালিগালাজ ও চরম অসৌজন্য আচরণ করেন কামাল আতাউর রহমান।
কামাল আতাউর রহমানের বক্তব্য জানতে চেয়ে তাকে চলতি বছরের জুনে দফায় দফায় নোটিশ দেন মাউশির তদন্ত কর্মকর্তা। তিনি জবাবসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ১০ জুনের মধ্যে পৌঁছে দেবেন বলে লিখিতভাবে জানান। ১০ জুন তদন্তকারী কর্মকর্তাকে আবারো লিখিতভাবে জানান, সংশ্লিষ্ট ডকুমেন্টসমূহ ৩০ জুন জমা দেবেন। এরপর তিনি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে কিছু অংশ কম্পিউটার কম্পোজ করা এবং কিছু অংশ হাতে লেখা কাগজপত্র তদন্ত কর্মকর্তার কাছে পাঠান।
প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কামাল আতাউর রহমান ১৯৮২ সালে দ্বিতীয় বিভাগ নিয়ে মাধ্যমিক এবং ১৯৮৫ সালে একই বিভাগ নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। এরপর ১৯৮৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পাস কোর্সে বিএ ডিগ্রি এবং ১৯৮৯ সালে ইতিহাস নিয়ে মাস্টার্স করেন তিনি। অর্থাৎ তিনি কোনো বিষয়ের ওপর স্নাতক ডিগ্রিধারী নন।
২০১৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ একটি পরিপত্র জারি করে। সেখানে বলা হয়, বেসরকারি কলেজে উপাধ্যক্ষ নিয়োগের জন্য স্নাতকোত্তর ডিগ্রির সঙ্গে এমপিওভুক্ত উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অধ্যক্ষ বা উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে অধ্যক্ষ অথবা ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ পদে তিন বছরের অভিজ্ঞতাসহ মোট ১২ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই পরিপত্র অনুযায়ী উপাধ্যক্ষ হওয়ার কোনো শর্তই পূরণ করতে পারেননি কামাল আতাউর রহমান। তৎকালীন আওয়ামী লীগ এমপি আব্দুর রহমানের প্রভাব খাটিয়ে ২০১১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর আলফাডাঙ্গা আদর্শ কলেজের উপাধ্যক্ষ পদে বসেন তিনি। ২০১২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে উপাধ্যক্ষ পদে বেতন গ্রেড-৫-এ এমপিওভুক্ত হয়ে বেতন-ভাতাদি পেয়ে আসছেন তিনি। তদন্তকাল পর্যন্ত তিনি উপাধ্যক্ষ পদে কর্মরত এবং বেতন গ্রেড-০৫-এ এমপিওভুক্ত রয়েছেন বলে তদন্ত কর্মকর্তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন।
স্থানীয়দের এবং কলেজ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত উচ্ছৃঙ্খল উপাধ্যক্ষ সাইক্লোন। কেবল সহকর্মী শিক্ষকদের সঙ্গেই নয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তিনি অহেতুক দুর্ব্যবহার করেন। তিনি নিজে আওয়ামী লীগ নেতা এবং সে কারণে তিনি সকল অনিয়ম করেও পার পেয়ে যেতেন।
অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, সাবেক মন্ত্রী আব্দুর রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ কামাল আতাউর রহমান। মূলত ফরিদপুর-১ আসনের সাবেক এমপি আব্দুর রহমানের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে আতাউর রহমান কামাল চরম দাপুটে চলাফেরা করতেন। সুযোগ পেলেই সবখানে ক্ষমতার বাহাদুরি আর দাম্ভিকতা দেখাতেন।
মাউশির প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, আলফাডাঙ্গা আদর্শ কলেজের উপাধ্যক্ষ কামাল আতাউর রহমান কলেজের কোনো নিয়মনীতি মানেন না। প্রতিষ্ঠান ও চাকরিবিধি মেনে ক্লাস-পরীক্ষার কোনো দায়িত্বই সঠিকভাবে পালন করেন না। তিনি নিজের মতো অফিসে আসেন আর যান। প্রতিষ্ঠান প্রধানকে অবহিত না করে কলেজ ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন। এমনকি সরকারের নির্দেশিত কলেজের কোনো কর্মকাণ্ডেও তিনি উপস্থিত থাকেন না।
উপাধ্যক্ষ কামাল আতাউর রহমানের ব্যাপারে আলফাডাঙ্গা আদর্শ কলেজ কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময়ে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে রেজুলেশন নিলেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তিনি বারবারই রেহাই পেয়ে যান।
কামাল আতাউর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা অধ্যাপক মো. মনোয়ার হোসেন। তিনি বলেছেন, গৃহীত প্রভাষক পদের বেতন-ভাতাদি বিধি মোতাবেক সরকারি কোষাগারে ফেরত দেননি কামাল আতাউর রহমান।
এছাড়া কামাল আতাউর রহমানের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে তৎকালীন অধ্যক্ষের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করা; সহকারী অধ্যাপক অবনী মোহন বিশ্বাসকে শারীরিক ও মানসিকভাবে লাঞ্ছিত করা এবং ২০২২ সালের ৭ মে স্টাফ-কাউন্সিল সভায় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের সঙ্গে অশ্রাব্য ভাষায় অশালীন কথাবার্তা বলার অভিযোগও প্রমাণিত হয়েছে বলে উঠে এসেছে তদন্ত প্রতিবেদনে।
আলফাডাঙ্গার স্থানীয় সচেতন মহল বলছেন, আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে ধরাকে সরাজ্ঞান করতেন কলেজ শিক্ষক কামাল আতাউর রহমান। বছরের পর বছর নানা অনিয়ম করেও তিনি পার পেয়ে গেছেন। এখন ক্ষমতার পটপরিবর্তন হওয়ায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। নইলে এটি একটি বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। যেটি কোনোভাবেই কাম্য নয়।